ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু


এ এইচ এম ফিরোজ আলী 

মাটির মানুষ-মাটির পৃথিবীতে যে সব তাৎপর্যময় কাজ কর্ম করেন, তাই হয় ইতিহাসের উপাদান। জগতে কিছু কিছু মানুষ মরেও অমরত্ব লাভ করেন। অনন্তকাল বেঁচে থাকেন নিজের কর্মের কারণে। বৈজ্ঞানিক আবিস্কার, সমাজ সংস্কার, রাজনীতি, সামাজিক, অর্থনীতি, শিল্প সাহিত্য, কবিতায় নানা শাখায় খ্যাতির শিখরে আরোহন করেছেন। মানব জন্মকে যারা নতুন এমন এক শীর্ষে নিয়ে যান, সেই শীর্ষারোহণে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষের মাঝেই সৃষ্টি কর্তা রয়েছেন। মানব কল্যাণই হচ্ছে প্রকৃত সৃষ্টি কর্তার বন্দনা। ফলে জাগতিক রঙ্গ মঞ্চ থেকে তাঁদের এমন এক শূন্যতা রেখে যায়, যা সহজে পূরন হবার নয়। সম্ভবত এমন এক মানুষ ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। গত ২৫ নভেম্বর শুক্রবার কিউবার রাজধানি হাভানার একটি হাসপাতালে স্থানীয় সময় ১০ টার অল্প সময় পর ইহলোক ত্যাগ করেন। ফিদেল ছিলেন সমাজত্রান্ত্রিক কিউবার মহান নেতা, সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের পরম বন্ধু, তৃতীয় বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের স্বপ্নের প্রতীক। সমাজ বিপ্লবের কিংবদন্তি কিউবার প্রবাদ প্রতিম এ পুরুষের মৃত্যুকালীন সময়ে বয়স ছিল ৯০ বছর। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাঁর ছোট ভাই রাষ্ট্রিয় টেলিভিশনে এক ভাষণে মৃত্যুর সংবাদ জানালে কিউবা সহ সারা বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। কিউবার জনগণ ৯দিন ব্যাপি শোক পালন করছেন। ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনের ইতিহাস খুবই রোমাঞ্চকর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রভাবিত হবে এই মহান নেতার কর্ম চিন্তায়। যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক চোখ রাঙানি, হুমকী, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পৃথিবীর বুকে কিউবা কে মর্যাদার উচ্চ আসনে বসিয়েছেন মৃত্যুঞ্জীয় ফিদেল। ফিদেল ছিলেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সন্ধানী। শক্তিধরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী। মানুষের জন্য তাঁর জীবন ছিল খুবই তুচ্ছ। কিউবা হারিয়েছে তাদের মহান নেতা, বিশ্ব হারিয়েছে বিপ্লবের এক মহান অভিভাবক। 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন ফিদেল। তখন তিনি ছিলেন কিউবার প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্যোগেও পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় ৪র্থ ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা হয়েছিল এ কিংবদন্তি নেতার। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন “আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিবুর রহমান। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাভ দ্য এক্রপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ”। অর্থাৎ আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষ হিমালয়ের সমান। এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ফিদেল কাস্ত্রো দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলেছিলেন, “শেখ মুজিুবের মুত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো তাঁদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে”। ১৯৬৬ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী এক সম্মেলনে ৬সদস্যের পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে হাভানায় গিয়েছিলেন। সেখানে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে কথা বলে তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে কথা শিল্পি সৈয়দ ওয়ালিউল্লা ইউনিসেফের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে কিউবায় গিয়েছিলেন। সেখানে মহান বিল্পবী চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে করমর্দন করে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। ভাষানী ও ওয়ালিউল্লা কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে ফিদেল কাস্ত্রোকে “ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী” সম্মাননায় ভূষিত করেছিল বাংলাদেশ। 
১৯৬২ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরাণ জেলার স্পেনিয় বংশোদ্ভূত এক অভিবাসি পরিবারে ফিদেল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুৎজে। বাবা ছিলেন আখের খামারি। একটি জে সুইট বোডিং স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের পর আইন বিভাগে ¯œাতক ডিগ্রী লাভ করে রাজধানী হাভানায় একজন আইনজীবী হিসাবে কর্ম জীবন শুরু করেন। দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে আইনী লড়াই করে অল্প সময়ের মধ্যে সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে কিউবার সেরা অলরাউন্ডার স্কুল অ্যাথলেট পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজের বাবার আখের খামারে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে শ্রমিক ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। ১৯৪৭ সালে নবগঠিত পিপলস পার্টিতে যোগদান করে মার্কিন সরকার ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতী, অবিচার, দরিদ্র, বেকারত্ব এবং নি¤œ মজুরীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে কিউবার এক ধনী রাজনীতিবিদের মেয়ে বার্টা ডিয়াজ, বালর্টিকে বিয়ে করেন। ১৯৫২ ফিদেল দলীয় সদস্যদের প্রার্থী হয়ে বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও নির্বাচনের আগে স্বৈরশাসক জেনারেল ফলজেন সিয়ো বাতিস্তা সামরিক এক আদেশের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করে নির্বাচন বাতিল করেন। যুক্ত রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন বাতিস্তা এবং বাতিস্তার নীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। যা ছিল কাস্ত্রোর বিশ্বাসের পরিপন্থি। বাতিস্তা প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রিয়রকে উৎখাত করেন। কিছুদিন পর দেশে যৌন ব্যবসা, জুয়া, মদ, চোরাচালান, ব্যাপক আকার ধারণ করলে ফিদেল ক্ষেপে উঠেন। তিনি বিল্পবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৫৩ সালে নারী পুরোষের ১২৩ জন সশস্ত্র দল নিয়ে মনকাডা আর্মি বেরেকে হামলা করলে ৮ জন নিহত হয় এবং ফিদেলের দল পরাস্ত হয়। বাতিস্তা সরকারের নির্দেশে ৮০ জন গেরিলা যোদ্ধাকে হত্যা করে ফিদেল কে জেলে আটক রাখা হয়। জেলে ফিদেলকে বিষ পানে হত্যার চেষ্টা করলে ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিশ্বের চাপের মুখে স্বৈরসাশক বাতিস্তা ফিদেলকে হত্যা না করে আইনী বিচার শুরু করেন। বিচারে ফিদেলের ১৫ বছর সাজা হলে আন্তর্জাতিক চাপে ২ বছর পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে বের হয়ে ফিদেল গেরিলা দল গঠনের জন্য মেক্সিকোয় পাড়ি জমান। চে গুয়েভারা, জুয়ান, আল মেইডা এবং অন্যান্যদের মিলিয়ে ৮০ জনের একটি বিল্পবী দল গঠন করে কিউবায় ফিরে আসেন। সে সময় বাতিস্তা সরকারের সেনাদের সাথে বার বার আক্রমন করেন। ১৯৫৮ সালের ফিদেল কিউবার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমর্থন লাভ করেন। এবছর আইনজীবী, চিকিৎসক, স্থপতি সহ ৪৫টি পেশাজীবী সংগঠন তাঁকে সমর্থন জানায়। বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় এক হাজার সেনা গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে যুক্তরাষ্ট্র গেরিলাদের হঠানোর চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৯ সালে ১লা জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল বাতিস্তা এবং ৯ জানুয়ারী ফিদেলের গেরিলা বাহিনি রাজধানী হাভানা দখল করে এবং ফিদেল প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালের কিউবাতে থাকা আমেরিকান সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করেন ফিদেল কাস্ত্রো। তখন যুক্ত রাষ্ট্র কিউবার উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ১৯৬৫ সালে ফিদেল কমিউনিস্ট পার্টি অব কিউবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে দিক থেকে অল্প দিনে কিংবদন্তি ফিদেলের কিউবা হয়ে হয়ে উঠে ছিল সমগ্র মধ্য ও লাতিন আমেরিকার দৃষ্টান্তমূলক এক দেশ। সমালোচকরা তাঁকে স্বৈরশাসক বললেও তাঁর সমর্থকদের ভাষায় তিনি স্বৈরশাসকের হাত থেকে কিউবার জনগণকে উদ্ধার করেছেন। 
২০০৬ সালের ৩১ জুলাই অন্ত্রের অস্ত্রোপাচারের পর ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে সাময়িক ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখন থেকে তাঁকে একদম জনসমক্ষে দেখা যেত না। বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর সমকালীন বিশ্বে দ্বিতীয় দীর্ঘ কালীন শাসক ছিলেন ফিদেল। তিনি ৪৯ বছর কঠোর হস্তে শাসন করেছিলেন কিউবাকে। বারাক ওবামা সহ আমেরিকার ১১ প্রেসিডেন্টকে সামাল দিয়েছেন ফিদেল। ৬৩৮ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তার নিরাপত্তারক্ষী ফেবিয়ান এস কালান্তে গণমাধ্যমে জানান ৪৯ বছরে ফিদেল কাস্ত্রোকে বার বার অভিনয় কায়দায় হত্যার চেষ্টা করা হয়। কাস্ত্রোর চুরুটের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা হয়, জুতা ও চোরুটের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য, খাবারে বিষ, কলমে বিষযুক্ত সুচ, পোষাকে জীবানু ছড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করে সিআইএ। ২০০০ সালে পানামার সফরে একটি মঞ্চে বক্তৃতার সময় ৯০ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা হয় এবং সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। একবার মারিতা নামের এক মহিলা বিষযুক্ত ক্যাপসুল নিয়ে ফিদেলকে হত্যার জন্য হাভানার একটি হোটেলে দেখা করতে যান। কাস্ত্রো এ খবর আগেই জানতে পেরেছেন। মারিতার হাতে নিজের পিস্তল তুলে দিয়ে কাস্ত্রো বলেন, বিষ দিয়ে নয় সরাসরি গুলি করে হত্যা কর। মারিতা গুলির পরিবর্তে ফিদেলকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। ফিদেলের প্রেমিকার মাধ্যমে এই হত্যার চেষ্টা করা হয়। চলতি বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কিউবা সফর করতে গেলে ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেননি। আমৃত্যুই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীতা করে গেছেন। 
ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর মার্কিন-কিউবান সাংবাদিক এল বার্টি সিগেল বলেছেন “ ফিদেল কাস্ত্রোর ছায়ায় আমার বেড়ে উঠা। সারা জীবন তাঁকে ঘৃনা করার শিক্ষা আমি পেয়েছি। প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাওয়ার পর আমি অবশ্য অনেক কিছু বুঝতে সক্ষম হই এবং ফিদেলকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি। আমার জীবনের একটি অংশ যেন ফিদেল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মৃত্যু নিয়ে কি ভাবতে হয় তা আমার জানা নেই। তবে ফিদেলের মৃত্যুর খবর শুনার পর আমি কেঁদেছি। 
ফিদেল বিদায় নিয়েছেন জগৎ সংসার থেকে, তবে রেখে গেছেন এমন কিছু ঐতিহ্য। যা বার বার বিশ্বকে মনে করিয়ে দেবে মানুষের কল্যাণে কিভাবে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া যায়, কীভাবে ভাল বাসতে হয় নিজের দেশের মানুষকে এবং কিভাবে রুখে দাড়াতে হয়, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তিনি আরও শিখিয়ে গেছেন সত্য ও ন্যায় নিয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে করলে জিরো থেকে হিরো হওয়া যায়--ফিদেল তাঁর জ্বলন্ত উদারহন। চিরনজীব ফিদেল আপনাকে অভিভন্দন কিউবা বাসিকে লাল সবুজ পতাকার শুভেচ্ছা। 
লেখক : কলামিস্ট।

SUMMARY

1824-1.jpg