বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন- মোঃ রফিকুল হক


১০ই জানুয়ারি ১৯৭২, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তান বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখে। এদিকে পাক হানাদার বাহিনী ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে নিয়াজী ও টিক্কাখানের নেতৃত্বে নিরস্ত্র ও নিরীহ স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে নির্বিচারে গুলি করে মারতে থাকে। এ যেন হত্যাযজ্ঞের এক মহাউৎসব। প্রাণভয়ে সাধারণ লোকজন দিকবিদিক ছুটতে থাকে। শহরের-বন্দরের মানুষজন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে থাকে। বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে এক মহা অমানিশা। 
সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যখন পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তির জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম করছিল তাদের সাংবিধানিক অধিকার বিশেষ করে ভোটাধিকার নিয়ে। তখন পাকিস্তানি শাসকদের মাথায় বাড়ি পড়ে। কিভাবে পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে তা থেকে বিচ্যুত করা যায়? জেল, জুলুম ও হত্যা চালিয়ে বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করা যায়। তারা সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যখন বাঙালিদের দমন করা যাবে না, তখন পেশি শক্তি ও অস্ত্রের জোরে পূর্বপাকিস্তানিদের আজকের বাংলাদেশকে শশ্মানে পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ ঘটেছিল তা তারা বুঝতে পারে নাই। 
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রাদেশিক স্বায়তশাসিত প্রভৃতি আন্দোলনে বাঙালিদের দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বুঝে ও অখন্ড পাকিস্তানের রক্ষায় হেন কাজ নেই যে তারা চালায় নাই। ব্রিটিশের দুইশত বছরের গোলামী মানুষের মন থেকে মুছে যেতে না যেতে পাকবাহিনী জোর করে আরো চব্বিশটা বছর গোলামীর জিঞ্জিরে বাঁধিয়ে রাখলো। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে ভারত উপমহাদেশ থেকে দ্বিখন্ডিত হলো তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশায় গুড়েবালি হলো। দিনকে দিন, মাসকে মাস, বছরকা বছর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী সর্বক্ষেত্রে বৈষ্যমের বেড়াজাল তৈরি করে। পূর্ব বাংলার জনগণকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে অট্টালিকা-প্রাসাদ, বাণিজ্য কেন্দ্র, ব্যাংক-বীমা, প্রশাসন, প্রশাসনিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে লাগলো। পূর্ব বাংলা প্রদেশটা যেন তাদের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শাসন-প্রশাসনে উপেক্ষিত হতে লাগল। বাংলার জনগণের ধৈর্য্যরে বাঁধ আস্তে আস্তে ভেঙে যেতে শুরু হলো। ভাষার প্রশ্নে স্বাধীকারের প্রশ্নে জাতির মহান নেতারা হোসেন সোহরাওয়ার্দী, একে এম ফজলুল হক, মৌলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন। 
তারা প্রথমেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ৩০৯ আসনের মধ্যে ৩০০ শত আসন লাভ করে। এই রায় ছিল ১৯৪৭-১৯৫৪ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের কুশাসনের ও বৈষ্যমের প্রতি বাংলার জনগণের ঘৃণার প্রতিফলন। এই রায়কে দেশে-বিদেশে ব্যালট বাক্স বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলাভাষা রাষ্ট্র ভাষায় স্বীকৃতি পায়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান যখন মার্শাল’ জারী করেন, তখন পূর্ব বাংলার জনগণের মনের মধ্যে স্বাধীকার আন্দোলনের বীজ দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। ইতোমধ্যে ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী-মুসলীম লীগ আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। আর তখন এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম শুরু করেন। 
১৯৬৬ সালে জাতির জনক বাঙালি জাতির সামনে ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন এবং ঘোষণা দেন এই ছয়দফা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর এই ছয় দফাকে নস্যাৎ করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্রের নাটক সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৮ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাবার জন্য নির্বিচারে ধরপাকড় শুরু করে অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে ঢুকায়। তাতে বাংলার জনগণ স্বাধীকারের স্বপ্নবাদ দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পূর্ব বাংলায় হরতাল, প্রতিরোধ, মিছিল-মিটিং বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। ছয় দফা বাঙালি জাতির কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা-বিদ্বেষ জন্মিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সমস্ত পূর্ব বাংলা যখন আন্দোলন-সংগ্রামে টালমাতাল, তখন আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পর্দার অন্তরালে চলে যায়। বঙ্গবন্ধু সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দিয়ে ইয়াহিয়া খান যথাসময়ে নির্বাচন দিবেন বলে পূর্ব বাংলার জনগণকে আশ্বস্থ করতে চেষ্টা চালান। 
এদিকে তখন ছাত্র আন্দোলন প্রচন্ড রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ ছয় দফার সাথে এগার দফা যেন স্বাধীনতার জন্য আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র আন্দোলনের কর্ণধার হয়ে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বাংলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে গেলেন। এই ১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। 
ইয়াহিয়া খান ৭০ সালে নির্বাচন দিলেন। প্রাদেশিক পরিষদ এই নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭ আসন। নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পরিষদের গঠনের জন্য ১লা মার্চ নির্ধারণ করা হলো। কিন্তু ইয়াহিয়া খান পরবর্তীতে তা স্থগিত করেন। এতে বাঙালি বুঝে গেল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ কায়দায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তারা বঙ্গবন্ধুর আদেশ-নির্দেশের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগলেন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১-৬ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন করা হয়। অবশেষে সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তার আজীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতার নিরীখে ১৯ মিনিটের যে ভাষণ দেন তাতেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। প্রায় দশ লক্ষ জনগণের উপস্থিতিতে  করতালি ও সমর্থনে সেদিন ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তুমি কে আমি কে বাঙালি-বাঙালি ইত্যাদি। 
অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া-ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে এসে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে ১৬ মার্চ থেকে আলোচনা শুরু করে। কিন্তু তাদের এই আলোচনার পিছনে ছিল নাটক ও ষড়যন্ত্র। আলোচনা চলবে, আলোচনার দ্বার বন্ধ নয় বলে হঠাৎ ২৫ শে মার্চ ইয়াহিয়া-ভুট্টো গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। নির্দেশ দিয়ে যায় টিক্কা খান ও নিয়াজীকে বাংলা ও বাংলার জনগণকে খতম করে দেওয়ার জন্য। নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষ নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে এবং রাতের আঁধারে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিক্ষেপ করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের পূর্বে তার বার্তার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা করে যান। 
১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয় বৈদনাথ তলায়। ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে। কর্ণেল এম.এ.জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করে ১১টা সেক্টরের সৃষ্টি করা হয়। এসব সেক্টর প্রধানরা সামরিক বাহিনীর লোক ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী গঠন করে সারা পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ পরিচালিত হতে থাকে। স্বদেশি-বিদেশি-প্রতিবেশি রাষ্ট্রসমূহের সহযোগিতা ও সমর্থনে বাংলার সূর্যসন্তানরা দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার মরণপণ লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়। দীর্ঘ নয় মাস স্বশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ত্রিশলক্ষ শহীদের ও দু’লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রচিত হয়। 
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হায়েনারা বাঙালি মুক্তিবাহিনীর নিকট রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। তখনও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তাঁর অন্ধকার সেলের পাশে হানাদার বাহিনী কবর খুঁড়ে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমি ফাঁসির কাষ্ঠে গিয়েও বলব আমি বাঙালি, বাংলার আমার ভাষা, আমার বাঙালিকে মাথানত করতে দেব না। তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালিদের কাছে পাঠিয়ে দিও। পাকিস্তানি গোষ্ঠী জেলের মধ্যে তাকে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করে স্বাধীনতা থেকে সরে আসার জন্য চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু তিনি মেনে নেন নাই। শেষ পর্যন্ত বিশ্ব বিবেকের কাছে নরাধম, নিষ্ঠুর শাসকগোষ্ঠী ১০ই জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমানে করে ১মে লন্ডন, পরে ভারত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি ঢাকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম.এ.জি ওসমানীসহ মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা এয়ারপোর্টে রাষ্ট্রীয় সালাম দিয়ে ঐতিহাসিক জনসভায় নিয়ে আসেন। এখানে বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতার আন্দোলনের কথা ও নয় মাস কারা নির্যাতনের কথা জাতির কাছে তুলে ধরেন। জাতির কাছে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার করেন। 

SUMMARY

1822-1.jpg