বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবে আগরতলায় গিয়েছিলেন আর কেনই বা গিয়েছিলেন তা নিয়ে নতুন কিছু তথ্য রয়েছে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে। কেনই বা তাকে সেখানকার জেলে একরাত কাটাতে হয়েছিল? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য ইংল্যান্ড থেকে টমাস উইলিয়ামসকে কীভাবে যোগাড় করা হল? ‘রোশনারা ব্রিগেড’ই বা কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলির সঙ্গে একটাই নাম জড়িয়ে রয়েছে, আর তা হল ত্রিপুরা। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে আগরতলা। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা নিয়ে তৈরি হওয়া প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হয়েছে। ত্রিপুরার গভর্ণর তথাগত রায় বুধবার রাতে আগরতলায় ওই চলচ্চিত্রটি উন্মোচন করেন।
কী রয়েছে
ছবিটিতে
প্রায় আড়াই বছর ধরে এই তথ্যচিত্রটি বানিয়েছেন চিত্র সাংবাদিক রাজু ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকা এতটাই বিস্তৃত যে এক ঘন্টার ছবিতে তা তুলে ধরা অসম্ভব। আমরা চেষ্টা করেছি কয়েকটা বিষয়ের ওপরে গুরুত্ব দিতে।’
এই তথ্যচিত্রের জন্য গবেষণা করেছেন আগরতলার সিনিয়র সাংবাদিক মানস পাল। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দলিল আমার হাতে আসে, আর তা হলো -শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক কবে আগরতলায় আসেন। শেখ মুজিবুর রহমান একবারই এখানে এসেছিলেন, যার সাল তারিখ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন তিনি ১৯৬৩ সালে এসেছিলেন। আমরা খোয়াইয়ের তত্কালীন সাবডিভিশনাল অফিসার স্মরজিত্ চক্রবর্তীর ডায়েরি পেয়েছি, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলায় আসার তারিখ উল্লেখ আছে।’’
সেই ডায়েরিতে ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ সাল, সোমবার -এই তারিখের পাতায় ইংরেজিতে যা লেখা রয়েছে তার বাংলা এরকম ‘‘শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন ব্যক্তি এবং তার সঙ্গে আমীর হুসেন এবং টি চৌধুরী (মনে করা হচ্ছে তারেক চৌধুরী) আসারামবারিতে (খোয়াই আর তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত) পৌঁছেছেন আজ দুপুর একটায় এবং তাদের জেলাশাসকের নির্দেশে তেলিয়ামুড়ায় পাঠানো হয়েছে।’’
শেখ মুজিবুর রহমান যে সেই যাত্রায় আগরতলায় যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে সমর্থন যোগাড় করতে, সেই খবর পৌঁছেছিল পাকিস্তানি গুপ্তচরদের কাছে। মানস পাল আরো বলেন, “ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ শেখ মুজিবের আর্জি পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন নেহরুর কাছে। তবে আইএসআই এই খবর জেনে যাওয়ায় তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর জন্য কিছুটা আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয়েছিল। তাকে পুশব্যাক করার আগে নিয়মরক্ষার জন্য একরাত আগরতলায় জেলে রাখতে হয়েছিল।’’
আগরতলা
ষড়যন্ত্র মামলা
পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা অভিযোগে জড়িয়ে দেওয়ার পরে ত্রিপুরার তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ তার হয়ে বড় ব্যারিস্টার খুঁজতে যে আগরতলার দৈনিক সংবাদপত্র ‘জাগরণ’ এর মালিক-সম্পাদক জিতেন পালকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন, সেই অজানা তথ্য উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রটিতে। মানস পাল বলেন, ‘‘জিতেন পালকে কলকাতায় পাঠানো হয় প্রখ্যাত ব্যারিস্টার ও কমিউনিস্ট নেতা স্নেহাংশু আচার্যের কাছে যাতে তিনি ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের হয়ে মামলা লড়েন। কিন্তু স্নেহাংশু রাজি হন নি, কারণ তাতে ভারতের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়ে যেত পাকিস্তান। তাই তিনি ইংল্যান্ডে নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় শেখ মুজিবের হয়ে ঢাকায় মামলা লড়তে আসেন টমাস উইলিয়ামস।’’
‘রোশনারা ব্রিগেড’
এর কল্পনা
যুদ্ধ চলাকালীন বেশ কিছু গল্প তৈরি করেছিলেন আগরতলার কয়েকজন সিনিয়ার সাংবাদিক। “রোশনারা বেগম নামে একজন অতি সাহসী নারী যোদ্ধার গল্প বানানো হয়েছিল, যিনি নাকি বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের সামনে শুয়ে পড়েছিলেন। মাইন ফেটে ওই ট্যাঙ্ক যেমন ধ্বংস হয়েছিল, তেমনই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল রোশনারা বেগমের দেহ। এইসবটাই আগরতলার কয়েকজন সাংবাদিকের বানানো যাতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানো যায় আর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে এই যুদ্ধে সামিল হওয়া নারী পুরুষের অসীম সাহসের কথা তুলে ধরা যায়।”
এই তথ্যচিত্রে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের কথা। এছাড়া রয়েছে কীভাবে বিশাল সংখ্যার শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া হয় এইসব তথ্যও। আরও রয়েছে ত্রিপুরার বিধানসভার বিখ্যাত প্রস্তাব, যেটিতে বাংলাদেশ যুদ্ধকে সমর্থন করা হয়েছিল।
বিবিসি