চেতনায় জীবন্ত বঙ্গবন্ধু


 কেয়া চৌধুরী 
বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু জানি? এই ভাবনায় অণুপ্রানিত হয়ে যতবারই বঙ্গবন্ধুকে জানবার চেষ্টা করেছি, ইতিহাসের পাতা থেকে ততবারই ভিন্ন-ভিন্ন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে, কেবলই বঙ্গবন্ধু শক্তি জুগিয়ে চলেছেন। দুনিয়া কাপাঁনো গুনী ব্যক্তিদের মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈচিত্র্যপূর্ণ আদর্শিক চরিত্র; এখনো বাঙালির জাতির সামাজিক রাজনৈতিক আর্থসামাজিক জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, রাজনীতিতে তার নীতিগত অবস্থান, ব্যক্তিত্বে দৃঢ়তা, ও আদর্শিক প্রখরতা আমাদের নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ছিল একেবারই স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘অধিকার ভোগ করতে হলে, অন্যের অধিকার রক্ষা করতে হবে’।  প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট ‘জাতীয় শোক দিবস’ আসলেই মনের মধ্যে যে প্রশ্নটি বার-বার উঁকি দেয়; যে মহান নেতা স্বাধীনতা এনেদিলেন বাংলার এ বুকে, অধিকার ভোগের স্বাদ গ্রাহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তার জীবনের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার টুকু কেন আমরা; জাতি হিসাবে তা রক্ষা করতে পারলাম না? বঙ্গবন্ধুকে স-পরিবারে হত্যা করা কেন এত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের? 
‘নীতিহীন নেতা নিয়ে কখনো দেশ গড়ার কাজে নামতে নেই। / এতে জনগণের মঙ্গলের চেয়ে, অমঙ্গলই হয় বেশি’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আতœজীবনী’তে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এই কথাটি লিখতে পেরেছিলেন, কারণ ‘নীতি’ এবং ‘আদর্শ’কে তিনি তার সমস্ত জীবন দিয়ে লালন করেছেন। তা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।  দেশপ্রেমকে মূলমন্ত্র করে, তার রাজনৈতিক জীবনের সকল কর্মকান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশের সাথে, জনগণের সাথে যায় না, এমন কোন কিছুকেই  বঙ্গবন্ধু তার জীবনে গ্রহণ করেন নি। 
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আতœজীবনী’ পড়ে এমনটাই  মনে হয়েছে-আমার।  ছাত্র জীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন আলোকিত এক ব্যক্তিত্বের মানুষ।  যে কারণে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো বড় মাপের নেতার চোখে পড়তে সময় লাগেনি, ছাত্র শেখ মুজিবুরের।   সময় এবং অবস্থানের  গন্ডি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সব সময় বিপদগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন,  বন্ধু হয়ে। সেটি হোক বন্যা, দুভিক্ষ, মহামারি মত; কঠিন সময়।  সাহায্যের হাত বাড়িয়ে মানুষের জীবন রক্ষায় ছুটে চলেছেন। এমন উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আতœজীবনী’তে বার বার উঠে এসেছে।
১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে, ‘৬৬টির ৬ দফা’ বাঙালির জন্য এক অনন্য অধ্যায়। ৬ দফার মধ্যেই ছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিশাহীন জাতিকে আলোর ‘বাতি’ হয়ে সেই থেকে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধুর পথ দেখানো। তার পর থেকে আর ঘরে ফেরা হলনা। দেশ দেশের মানুষ, এই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। স্বপ্নপূরণের হ্যমিলনের বাঁশিওয়ালা হয়ে, তিনি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছেন। স্বপ্নে বিভোর করেছেন, তারপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালিকে তার স্বপ্নপূরণে সার্মথ্যবান করে তুলেছেন। 
তার পর থেকে দেশ ও বর্হিবিশ্বে আলোকিত এক ব্যক্তিত্বের নাম ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। যিনি স¦াধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন, সত্যিই বাঙালির জীবনের এক যুগান্তকারী ঘটনা।  বাংলার ৭ কোটি মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক ও প্রেরণায়, বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের আহবানে অসহযোগ আন্দোলন গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ এর ভাষনে, ৭ কোটি জনগণকে রুখে দাঁড়াবার প্রস্তুুতি নিতে নিদের্শ দেন তিনি।  অন্যায় ও অসত্য, নীতিহীনতা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর একটি আঙ্গুলির হেলনি; লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতীকে কোন কিছু না ভেবেই মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেবার সাহস যুগায়। যা ছিল নজিরবিহীন এক বীরত্বের অধ্যায়। একজন রাজনীতিবিদ কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে, রাষ্ট্রপরিচালনার কোন রকমের পূর্ব অভীজ্ঞতা ছাড়াই, পুলিশ, আর্মী বা প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া শুধুমাত্র জনগণের শক্তি দিয়ে, ভালবাসা পেয়ে, একটি জাতিকে তার নিদিষ্ট পথে এগিয়ে যাবার নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটি শুধু বঙ্গকন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। কারণ তিনি মানুষকে  ভালবাসতেন। জনগণকে বিশ্বাস করতেন। জনগণের স্বপ্নপূরনে নিজেকে নিবেদিত করবার শক্তি তিনি অর্জন করেছিলেন। আর এর সবটাই ছিল, বঙ্গবন্ধুর  নিজের জীবনকে  ঝুঁকিতে রেখে, মানুষের কল্যাণের প্রত্যয়ে।
বঙ্গবন্ধু যা বলতেন, বিশ্বাস থেকে বলতেন। তিনি যা করতেন, তিনি তার বিশ্বাস থেকেই বাস্তবায়ন করতেন। যা বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আতœজীবনী’তে খুব সহজভাবেই উঠে এসেছে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিস্ময়ের নাম। এটি  সবচেয়ে বেশি প্রমানিত হয়েছিল; পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ রেখেছিল। পাকিস্তানের কারাগারে ৯ মাস বন্দি থেকে, বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠে ছিলেন, বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান ছিল  একাত্তরের মুক্তির স্লোগান। মুক্তিযোদ্ধারের সাহস ও গতিবৃদ্ধি পেয়েছিল ‘জয়বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে। আর ‘শেখ মুজিব’ নামটি পাকিস্তানিদের  কাছে হয়ে উঠেছিল, ভীতি ও শংকার কারণ।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ দল হিসাবে ঘোষণা  করেছিল  ইয়াহিয়া খান। বাংলার ৭ কোটি মানুষের স্বপ্নের বাতিঘর।  যে আওয়ামীলীগ তৃনমূল থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক দল; তাকে নিষেধের কালো কাপড়ে বন্দী রাখা গেল না।  জনগণের ভোটে নির্বাচিত আওয়ামীলীগের জনপ্রতিনিধিরা সত্যিকার অর্থেই জনপ্রতিনিধি হিসাবে, সে সময় অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জীবন দিয়েছেন। জীবনের বিনিময়ে হলেও লক্ষ ছিল বাংলার মানুষকে, স্বাধীন করা। কারণ আওয়ামীলীগ জনগনের স্বপ্নপূরণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমার আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীকে এভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। 
বঙ্গবন্ধুর তার গণপরিষদে ‘সুপ্রীম বডি’ বিষয়ে মহান সংসদে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিলের আলোচনায় রাজনৈতিক দল  আওয়ামীলীগ, সম্পর্কে বলেন,  ‘আওয়ামীলীগ আমি বা আমার সহকর্মীরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করতে চাই না। ক্ষমতা চাইলে বহু ক্ষমতা ভোগ করতে পারতাম। আমার সহকর্মীরা বাংলার মন্ত্রীত্ব করতে পারত। কিন্তু বাংলার মানুষের কাছে ওয়াদা করেছিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে, বাংলার মানুষ সুখী  হবে, বাংলার সম্পদ বাঙালিরা ভোগ করবে। সেই জন্য এই সংগ্রাম করেছিলাম’। অবৈধ পাকিস্তানি সরকার, বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহামনের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এটি ছিল আর একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ধামা-চাপাঁ দেয়া। বঙ্গবন্ধুকে দুর্বল করে বাঙালিকে দুর্বল করা! কিন্তু এটি যে, কত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তা খুব সহজেই পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল।  সততার রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজার রাজা;। পোষাকী রাজনীতি বঙ্গবন্ধু জানতেন না। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। বঙ্গবন্ধু মুত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে বলে দিলেন ‘আমি বাঙালি। আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে, বার বার নয়। মুত্যৃর পর আমার দেহটি আমার দেশের মানুষের কাছে তোমরা পাঠিয়ে দিয়’। ১৯৭১ সালের ১১ই আগষ্ট রুদ্ধদ্বার বিচারের সম্মুখিন করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু কোন শক্তি বঙ্গবন্ধুর আদর্শেকে ম্লান করতে পারিনি। বিচারের মাধ্যমে প্রমান করতে পারিনি, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনিত কোন অভিযোগ। বঙ্গবন্ধু তার সমসাময়িক সময়ের রাজনৈতিকে কলুষিত করেননি। ‘সাম্প্রাদায়িকতা’ ‘ধর্মকে’ নিয়ে রাজনীতি করা, উগ্র জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন সব সময় সোচ্চার। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ক্ষতালোভীরা শারিরীকভাবে হত্যা করল। পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করল নির্মমভাবে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তার সততা সর্বোপরি, অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার চেতনাকে হত্যা করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, নীতিহীন আদর্শহীন রাজনৈতিবীদরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চমক দেখালেও, ইতিহাসের পাতায় আলোর প্রদীপ হিসাবে প্রজ্জলিত হয় ‘নীতিবান’ ‘আদর্শবাদ’ রাজনীতিবিদেরই। আলোর প্রদীপের নিচে থাকা  অন্ধকারের গহীনে ডুবে থাকে ষড়যন্ত্রকারীদের ‘ষড়যন্ত্রের ইতিকথা’।  ক্ষমতালোভীদের নাম মানুষ ঘৃর্না ভরে স্মরণ করে। আমরা তার প্রমাণ পাই, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মোস্তাক-জিয়া ও তাদের অসৎ কর্মের,  অনুসারিদের কথা এভাবেই ঘৃর্না ভরে স্মরণ করে মানুষ।
‘বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এ যেন একই সুতাঁয় গাঁথা সুগন্ধি ফুলের মালা। যার সৌরভ বাতাসে দোলায়।  ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ স্বর্ণাক্ষরে লেখা এ দুটি নাম; যার কোন ক্ষয় নেই। প্রর্দীপের আলোক শিখা থেকে আজ সূর্যের আলোতে পরিণত হয়েছে। যে আলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে শুধুই আলোকিতই করছেনা, করছে চেতনায় শাণিত।  
গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় স্মরণ করি, / জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
লেখক : সংসদ সদস্য।

SUMMARY

1817-1.png