ঐতিহাসিক ফারাক্কা ও বঙ্গবন্ধু


 ইনাম চৌধুরী 

বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার কানসাট সীমান্ত সংলগ্ন একটি এলাকা। এটি ভারতের একেবারে সীমান্ত ছোঁয়া জনপদ। এই এলাকাটির উজানে ঠিক তের মাইলের মাথায় রয়েছে ঐতিহাসিক ফারাক্কা বাঁধ। এই বাঁধটি ফারাক্কা নামক এলাকায় অবস্থিত বলেই নামটিও ধারণ করেছে। বাঁধটির সেই পাকিস্তানী আমলে নির্মাণ কাজ শুরু হয় আর কার্যকরী এবং ব্যবহারোপযোগী হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর পরই। মনে রাখতে হবে এটি পানি ধরে রাখার উঅগ নয় বরং পানি আটকে রাখার ইঅজজঅএঊ। এই বাঁধটি গঙ্গা নদীর উপর আড়াআড়িভাবে নির্মিত। এটির দৈর্ঘ্য সাত হাজার পাঁচশত ফুট। উচ্চতা পচাত্তর ফুট আর চওড়া চৌত্রিশ ফুট। এটির মধ্যে রয়েছে সর্বমোট একশত নয়টি পানি নির্গমন পথ। 
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের লাগোয়া রাজ্যটি হচ্ছে বিহার। প্রায় উষর মরুভূত্বকের আদলে এলাকাটি। সামান্য বৃষ্টি ছাড়া পানি পাওয়ার বিকল্প নেই। সেখানকার জনগোষ্ঠীর নাওয়া খাওয়া শিকেয় উঠলেও কৃষিকাজ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে সময়ে সময়ে। তাই আবদ্ধ ফারাক্কা বাঁধের পানি ওদিকে সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে এতোবড় একটি বাঁধ নির্মাণে ভারত সরকার আগ্রহী হয়ে উঠে এবং বানিয়েও ফেলে। বিহার রাজ্যটি ছাড়িয়ে আরও পানি স্বল্পতা দোষে দুষ্ট উত্তর ভারতেও পানি সরবরাহ বা প্রবাহিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ভারত সরকার। সংযুক্ত খাল ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হাজার হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা নেয় ভারত এবং বাস্তবায়নে অগ্রণী হয়। ভাটির দেশসমূহের পানির চাহিদা, পানি নির্ভরশীলতা, পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা, প্রাণীকূল আর জীববৈচিত্র্যের সহায়তা সহ সকল বিষয়ই রয়ে যায় একেবারে দৃষ্টির আড়ালে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সতর্কতা, পরবর্তিতে বাংলাদেশ সরকারের আবেদন-নিবেদন কোনো কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে আনার প্রয়োজনবোধ করেনি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ অর্থাৎ সরকারি সংস্থাসমূহ। এই ফারাক্কা বাঁধের উপর দিয়ে রেললাইন সুবিধাসহ সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন সংযোজিত হয় তখন সেটি একটি বিরাট অর্থনৈতিক নিয়ামক হিসাবে ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রতিভাত হয়। তাই ভারত সরকার চোখ কান বুজে ফারাক্কাকে কাজে লাগাতে জোরদার কার্যক্রম গ্রহণ করে। ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশ পড়ে মহা ফাপড়ে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় চৌদ্দটি জেলার আনুমানিক পাঁচ কোটি লোকের জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে কারণ গঙ্গা নদীর পানি না আসাতে ক্ষেত খামার, পশুপাখির জীবন সহ সবকিছু অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়ে। প্রয়োজন এবং সময়ানুযায়ী পানি সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় একটি মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় আবার নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠার প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সংকট উত্তরণে বলিষ্ঠ আর রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলাপ আলোচনা করে চৌত্রিশ হাজার পাঁচশত কিউসিক পানি শুষ্কমৌসুমে যাতে বাংলাদেশ পায় সেটা নিশ্চিত করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হেতু আজ সেই পানিটুকুও যেন একেবারে ঘটির জল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাথে সাথে তিস্তাসহ আরও অনেকগুলি নদী বিষয়ক পানি সংক্রান্ত জটিলতা রয়েই গেছে। 
হাল আমলে ফারাক্কা বাঁধটি নিয়ে স্বয়ং ভারতই পড়েছে মহা গ্যাড়াকলে। ওখানে ধরে রাখা জল বিহার রাজ্যে প্রাণদায়িনী শক্তির বদলে মারণাঘাত করার উপক্রম করেছে। ভারতীয় পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন গঙ্গা নদীটির তলদেশে জমাট পলি মাটি তীরবর্তী জনপদ সমূহের আনুভূমিক পরিমাপের কাছাকাছি চলে এসেছে, অর্থাৎ গঙ্গা নদীটির তলদেশ উচ্চতায় অনেক উপরে উঠে যাওয়ায় দু’কূল ছাপিয়ে আশেপাশের এলাকাসহ বিহার রাজ্যটিতে সৃষ্ট বন্যায় বিরাট মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বিহার রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার তো চটেমটে বলেই ফেলেছেন যে ফারাক্কা বাঁধটি তারা চাচ্ছেন না এটিকে বরং উঠিয়ে দেয়া হোক।  একটু বিশ্লেষণে গেলে বুঝা যায় প্রবাহিত পানি বা জলরাশি যখন ফারাক্কা বাঁধে এসে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে উল্টোপথে সংযোগ খাল দিয়ে বিহার, উত্তর প্রদেশ জাতীয় উষর ভূমিকে সিঞ্চিত করতে ধাবিত হয় তখন কিন্তু জলবাহিত পলিমাটিটুকু ফারাক্কা সংলগ্ন বা এতদঞ্চলে গঙ্গার তলদেশে জমা হতে শুরু করে। প্রথমে বুঝা যায় নাই কারণ প্রবাহিত পানির সুফল লাভে বিহার সহ অন্য রাজ্যগুলি খুশিতে আটখানা হয়ে উদ্বাহূ নৃত্য করছিলো। বেশক’টি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে উলোট পূরান অবস্থা দর্শন করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়। খুলে দেয়া হয় বাংলাদেশমুখী একশত নয়টি নির্গমন পথের একশতটি। হু হু করে পানি আসছে বাংলাদেশে এই ভরা বর্ষা ঋতুতে। এখন বাংলাদেশের হয়েছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। 
বিহার এর মুখ্যমন্ত্রী জনাব নীতিশ কুমারের দাবি অনুযায়ী তো আর ফারাক্কা বাঁধটি হঠানো যায় না তাই ভাটির দিকেই জল ঠেলে দেওয়া। এককালে এই ভাটির দেশটি কেঁদে কেটে যে জলটুকু পায়নি আজ যেন সেটি মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এসে উপনীত হয়েছে ভাটি দেশটির জনগণের দুয়ারে। ভাগ্য বিপর্যয় ছাড়া এটিকে আর কি বলা যাবে। 
আমার লেখার শুরুতে ঐতিহাসিক শব্দটি ব্যবহার করেছি শুধুমাত্র একটি কারণে মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মরহুমই সক্ষম হয়েছিলেন প্রতিপক্ষ জাদরেল ভারতীয় কর্তাদের কাছ থেকে তৎকালীন সময়ের প্রয়োজন মেটানোর মতো পানিটুকু আনতে ফারাক্কা চুক্তির মাধ্যমে। 
লেখক ঃ অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

SUMMARY

1811-1.jpg