বেলাল আহমদ চৌধুরী
৭ মার্চ ১৯৭১। বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিন বাঙালি জাতির ভাগ্য নিয়ন্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের বক্তৃতা ছিল এক ঐশ^রিক শক্তির প্রভাব হতে বক্তৃতা। এমন যথাযথ, সংযত, শাণিত এবং প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা বিশে^র ইতিহাসে বিরল, এ ভাষণে রয়েছে বহুমাত্রিক বিশেষত্ব। মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। জাতির ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু যুক্তিপূর্ণ অথচ আবেগময়, সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিতপূর্ণ অথচ অর্থবহ বাক্য ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের মানুষকে তা আজও একাত্তরের মতো সমভাবে উদ্দীপ্ত করে তোলে। বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিশ^মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর মানবদরদী রাজনীতিবিদদের ভাষণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাচীন গ্রীসের ডিমোন্থেনেস (খ্রি. পূ. ৩৮৪-৩৯২) ছিলেন বিশে^র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তা। এডমন্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭)-এর ভাষণ বিশে^র রাজনীতির ইতিহাসে বিরল সম্পদ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে ১৯ নভেম্বর গেটিস বার্গ যুদ্ধে শহীদের সমাধি ভূমিতে দাঁড়িয়ে মাত্র ০৩ মিনিটের ভাষণ দেন। তার এই চুম্বক ভাষণ বিজলীর মত বিশে^র সেরা রাজনৈতিক ভাষণ হিসাবে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ও যধাব ধ ফৎবধস (আই হেভ এ ড্রিম) মার্টিন লুথার কিং-এর ঐতিহাসিক ভাষণের মাঝে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠের স্বরধ্বনির অপূর্ব মিল পাওয়া যায়। কিউবার নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদত্ত ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অপূর্ব মিল পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণে প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে মাত্র ১৯ মিনিটে কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ এতদিন শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এক অনন্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত ছিল। টঘঊঝঈঙ’র বিশ^ স্বীকৃতির মাধ্যমে তা এখন বিশে^র নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুর দেয়া এ ভাষণটি বিশে^র প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মুখে উচ্চারিত ক্ষুদ্রতম কালজয়ী মহাকাব্যের অনুপম দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বিশ^বরেণ্যজনের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। উল্লেখ্যÑ ৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিলÑ কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ট্রো। ৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল। বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে ততদিন ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশে^র মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিত- ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনরূপ বৈধতা নেই। পূর্বপাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ- জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা মার্শাল টিটো। সম্প্রতি জ্যাকব অফ ফিল্ড নামের একজন ইংরেজ লেখক ও ইতিহাসবিদ ‘ফাইট অন দ্য বিবেস : দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ার্স হিস্টি’ নামে বিশে^র সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। এই বইটিতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, জর্জ ওয়াশিংটন ও মাও সে-তুংয়ের মতো রাষ্ট্র নায়কদের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিও স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছেÑদ্য স্ট্রাগল দিস টাইম, ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইনডিপেন্ডেন্টস অর্থাৎ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড বা বিশ^ প্রমাণ্য ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে টঘঊঝঈঙ।
৩০ অক্টোবর ২০১৭ প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তর সংস্থাটি পরিচালক ইরিনা বোকাভা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণটি ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসাবে ঘোষণা করেন।
পরিশেষে বলবÑবাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তার লালিত স্বপ্নের সফল অভ্যুদয়। আমরা দেশবন্ধু পেয়েছি, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক পেয়েছি অথবা ইসমাইল সিরাজী পেয়েছি, ইসলামাবাদী পেয়েছি, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পেয়েছি, পেয়েছি আরো অনেক মনীষীÑকিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ী মহা মানবদের পুরোভাগে রয়েছেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ঐ একজনই। বঙ্গজননীর হাজার বছরের প্রতীক্ষার এ-এক ফলশ্রুতি। তিনি আমাদের জাতির পিতা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট