এ কে খন্দকারের লেখা আলোচিত, সমালোচিত বই ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ প্রকাশের পর অনেককেই বলতে শুনেছি তিনি তো আওয়ামী লীগেরই নেতা, এমপি, মন্ত্রী ছিলেন। হ্যাঁ, কথা সত্য। তবে এটাও সত্য যে খন্দকার মোশতাকও তো আওয়ামী লীগ করতেন, এমপি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন। তাই নয় কি? তাই বলে কি ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের কৃতকর্ম ইতিহাস থেকে মুছে যাবে? নিশ্চয়ই মুছে যাবে না। যে যেই দলমত করি না কেন প্রত্যেকের একটি ব্যক্তিগত জগত রয়েছে এবং সেই ব্যক্তিগত জগতে কে কতোটা হিংস্র কিংবা ভালো মানুষ তার প্রমাণ কিন্তু পাওয়া যাবে তার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই। হালের আলোচনায় একটি কথা খুব আলোচিত হচ্ছে আর তাহলো হাইব্রিড নেতায় ভরে গেছে আওয়ামী লীগ। হাইব্রিডদের দাপটে অনেকটা কোণঠাসা প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতারা। এ নিয়ে বেশ লেখালেখিও ইদানীং পত্রপত্রিকায় হচ্ছে। কারা এই হাইব্রিড তা হয়তো সুনির্দিষ্ট করে বলা ঠিক হবে না কিন্তু এটা তো সত্যি যে আওয়ামী লীগ এমন কিছু লোককে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েছে যারা আওয়ামী লীগের টিকেটে এমপি হয়েছেন হয়তো আওয়ামী লীগের এই পরিচয় না পেলে ইউপি মেম্বারও হতে পারতেন কিনা সন্দেহ কিন্তু এখন তারাই দেশের বুদ্ধিজীবী সেজে টকশোতে, পত্রিকায় কলাম লিখে আওয়ামী লীগের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধারে লেগেছেন। একই পথ ধরে এবার আরেকজন বিশিষ্ট সুপ্ত লেখক প্রতিভা এ কে খন্দকার যিনি কিনা এইতো সেদিনও আওয়ামী লীগের পরিচয়ে এমপি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন! সেই খন্দকার সাহেব ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ নামে অতিসম্প্রতি একটি বই লিখেছেন যেখানে তিনি কিছু ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছেন, যা জাতিকে বিস্মিত করেছে, হতবাক করেছে। এ কে খন্দকার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে কোনো সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি তবে বীরউত্তম খেতাব লাভ করেছেন। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত আমলে এমপি ছিলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন, আরো হয়তো অনেক পরিচয় খন্দকার সাহেবের আছে কিন্তু রাজনীতি সচেতন কোনো মানুষ তাকে একজন আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে মানবে বলে আমার মনে হয় না। অথচ আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দল এমন একজন সুযোগ সন্ধানী চতুর মানুষকে আওয়ামী লীগের টিকেটে এমপি বানিয়েছেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন! যেই এ কে খন্দকার চাকরি জীবনে ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করেছেন বলে উল্লেখ আছে। শুধু তাই নয়, এই সময়ে ঘটে যাওয়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়। অথচ সেই খন্দকার সাহেবই স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এসে বই লিখলেন, “বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তার বক্তৃতা শেষ করেছিলেন।” কি হাস্যকর। উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের কেউ যা শুনলো না, এমনকি স্বাধীনতার ঘোর বিরোধীরাও আজকে পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনোদিন বলেনি বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শেষে জয় পাকিস্তান বলেছিলেন। অথচ আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে, মন্ত্রী হয়ে, মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি হয়ে তার লেখনিতে এমন আজগুবি তথ্য উপস্থাপন করলেন। এ কে খন্দাকারের বই পড়ে এখন আওয়ামী লীগ নেতারা জাতীয় সংসদ থেকে সর্বক্ষেত্রে রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। কিন্তু এ কে খন্দকারদের আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে আওয়ামী লীগ কি নিজেদের দায় এড়াতে পারবে? যেই এ কে খন্দকার পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে প্রায় সব সরকারের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন অথচ পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে সেই খন্দকারকেই আওয়ামী লীগ পরিকল্পনামন্ত্রী বানিয়েছেন। সাপ পুষলে সেই সাপ একদিন ছোবল দিবেই। প্রশ্ন জাগে আওয়ামী লীগ কি অতীত ভুলে গেছে? তাদের কি মনে নেই আরেক বিশ্বাস ঘাতক নিমক হারাম খন্দকার মোশতাকের কথা। যে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে মুসলিম লীগ থেকে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। আরো বিস্ময়কর হলো এই খন্দকার মোশতাকই কিনা ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে যখন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন তখনো খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী ছিলেন। দুধকলা দিয়ে পোষা বিষধর সাপ খন্দকার মোশতাকই কিনা মরণ ছোবল দিয়ে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গকে। জাতির কপালে লেপ্টে দিয়েছিল কলঙ্ক তিলক ১৫ আগস্ট। পুরো দেশ যখন শোকে আচ্ছন্ন, খন্দকার মোশতাক তখন ক্ষমতার মসনদে সমাসীন। দখল করেছিলেন রাষ্ট্রপতির আসন। প্রত্যক্ষ খুনিদের মোশতাক বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন। অবাক হবার কিছুই নেই এই খন্দকার মোশতাকও আওয়ামী লীগ করতেন। বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক ছিলেন বলে অনেকে বলে থাকেন। এ জন্যই বলি এবার এ কে খন্দকার বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে নিয়ে যে অসত্য তথ্য তার বইয়ে লিখেছেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে। আওয়ামী লীগকে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে অতীতে যে মূল্য পুরো জাতি তথা আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে ভবিষ্যতে যেন এমন কোনো চড়া মূল্য না দিতে হয় সে কারণে আগে থেকেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে এ ধরনের খন্দকার মার্কা বিষধর সাপগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং হাইব্রিড বাদ দিয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধু প্রেমিক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে। আর তা না হলে খন্দকার মোশতাকের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা কিছুদিন পরপর এভাবে নতুন নতুন অপকৌশল নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করবে এবং হয়তোবা আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্রকারী মহলের ইশারা-ইঙ্গিতে নতুন কোনো খেলায় মেতে উঠবে যার চরম মূল্য জাতিকে আবার দিতে হবে। কাজেই এখনই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে।
২. কে জানতো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আওয়ামী লীগে আসা খন্দকার মোশতাক একদিন জাতির বাতিঘর খ্যাত, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করিয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করে নেবে। আবার বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর চার দশক পরে এসে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য, উপস্থিত সারা দুনিয়ার বড় বড় সাংবাদিক, উপস্থিত লক্ষাধিক মানুষের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণজমায়েতে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যেখানে ‘জয়বাংলা’ বলে তার ভাষণ শেষ করেছিলেন আর কেউ না শুনলেও খন্দকার মোশতাকের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা ঠিকই সেদিন শুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু বক্তব্যের শেষে বলেছিলেন ‘জয় পাকিস্তান’। জনাব এ কে খন্দকার তার লেখা বইয়ে এমন আজগুবি তথ্যই উপস্থাপন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত আমলে পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে তিনি নিশ্চয়ই সুপরিকল্পনা করে রেখেছিলেন যদি আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে এবং কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না পান তাহলে পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের যে নিমক তিনি খেয়েছেন তার প্রতিদান অক্ষরে অক্ষরে দেবেন। তারই প্রতিদান হয়তো এই বই! তা নাহলে এখন কেন এই লিখলেন এতাদিন কেন নয়? এমন প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়। এ কে খন্দকার স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে লিখা তার বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন, আমি এই লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়েছি মূলত তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়, অথচ সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছে। সত্য ও মিথ্যাকে তারা আলাদা করতে পারছে না। আমার এই বই তাদের জন্য (পৃষ্ঠা ১১)। অথচ বইয়ে যে তথ্য তিনি সত্য বলে উপস্থাপন করেছেন তা কোনো নিছক মিথ্যা নয় বরং সুপরিকল্পিত মিথ্যা। তার এই বই নিয়ে ইতোমধ্যেই সমালোচনার ঝড় বইছে, অনেকে ঘৃণা, নিন্দা জানিয়েছেন এমনকি বই বাজেয়াপ্ত করাসহ তার বিরোদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ এটি একটি বই আকারে প্রকাশিত দলিল। যা ভবিষ্যতে এমনকি ইতোমধ্যেই এটিকে সমর্থন জানিয়ে কিংবা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে সুযোগ সন্ধানীরা বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। এই ধরনের বিকৃত ইতিহাস লেখার মধ্য দিয়ে জনাব খন্দকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে কেবল ছোট করতে চাননি বরং আওয়ামী লীগের তখনকার ভূমিকা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ করার মতো তেমন কোনো পূর্ব প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের ছিল না। অথচ বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণেই বলেছিলেন প্রতিটি পাড়া মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করো। এ কে খন্দকারের এই যে হঠাৎ করে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে বই লেখা এবং বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যাচার করা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলে সরকার তথা আওয়ামী লীগ আবারো ভুল করবে। আওয়ামী লীগ, বর্তমান সরকার সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ অতীতে খন্দকাররাই জাতির বাতিঘর বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পথ চলাকে থমকে দিয়েছিল, বদলে দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের পথচলা।
গাজী মহিবুর রহমান : কলাম লেখক।