৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস হিসেবে ১৯৭৫-পরবর্তী সময় থেকে পালিত হয়ে আসছে। তবে তা ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত কোনো সরকার পালন করেনি, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল সময়ের সরকার করেনি। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক বাণী দেয়া, সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ধর্মীয়ভাবে অনুষ্ঠানাদি পালন, রাজনৈতিকভাবে কিছু কর্মসূচি পালন- এটিই একটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা নিয়ে সরকার ও রাষ্ট্রের বৈরী আচরণের সময়ও দেশের পত্র-পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন, লেখালেখির ধারা ক্রমেই জোরদার হয়েছে। এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠার ফলে ১৯৭৫-এর সকল নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা ধরনের প্রামাণ্যচিত্র, আলোচনা-পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে। ফলে আগস্ট-নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি নিয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি তথ্য জানার সুযোগ হচ্ছে, পঁচাত্তরের রাষ্ট্র-রাজনীতির পটপরিবর্তনের অনেক তথ্যই জানা হচ্ছে।
জেলহত্যা দিবসটি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের থেকে আলাদা কিছু ছিল না। এটি ছিল সেই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধু এবং তার বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এর আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়া, পরিবর্তন করে দেয়াই মূল পরিকল্পনা ছিল। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এবং নভেম্বরের জেলহত্যা দিবসের পালন এ পর্যন্ত মূলতই গতানুগতিক থেকেছে, এর গভীরে প্রবেশের চেষ্টা যৎসামান্যই ঘটছে। ফলে দিবস পালিত হচ্ছে, অনুষ্ঠানে অনেক সময় চারদিকে ভরে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুই যেন ভাসাভাসা, অনুষ্ঠান সর্বস্ব। এর ভেতরে প্রবেশ করার আকাক্সক্ষা সেভাবে বিস্তৃত বা প্রসারিত হচ্ছে না। আমি অতিসম্প্রতি কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষায় কয়েকজন তরুণকে যখন ৩ নভেম্বর সম্পর্কে প্রশ্ন করে উত্তর পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কারণ ও ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে হতাশ হয়েছি। ঘটনাটি আমাকে খুবই বিস্মিত করেছে। বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা পড়া, জানা, শেখা, বোঝা ও উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে এসব অনুষ্ঠানিকতার কোনো গুরুত্ব নেই, দিবস পালনেরও কোনো প্রভাব পড়ে বলে মনে হয় না। এখনো অনেক তরুণই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে উপরোল্লিখিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে চিন্তাই করতে পারছে না। খোন্দকার মোশতাক যেহেতু ওই হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন তাই বিষয়টিকে কেউ কেউ আওয়ামী লীগের একাংশের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের বিষয় হিসেবেই দেখে। আসলে এই দেখাটির অন্যতম কারণ হচ্ছে মিডিয়ায় কোনো কোনো আলোচকের কথাবার্তায় তারা প্রভাবিত হয়, নিজেরা এর ভেতরের বিষয়গুলো ততোটা পড়ে দেখেনি। এখনো শোনার পর্যায়েই অবস্থান করছে।
এর জন্য আমি তরুণদের এককভাবে দায়ী করছি না। তবে ১৯৭৫-এর ষড়যন্ত্রের পেছনে যারা মূল নেতৃত্ব দিয়েছিল, যারা সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনাসমূহ করেছিল তারা কতোটা সফল হয়েছে- এ থেকে অনুমান করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫-পরবর্তী দীর্ঘ সময় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ, ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল-বেদখল সম্পর্কে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণা চলেছে, রাজনীতিতে যেভাবে কথা বলা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকসহ বই-পুস্তক ও মিডিয়ায় যেভাবে বিকৃত ইতিহাস ও তথ্য দেয়া হয়েছে- তাতে একটি প্রজন্ম ছোটকাল থেকেই বিভ্রান্ত হয়েছে, তাদের মনোজগতে যা স্থান করে নিয়েছে- তাতে প্রকৃত ইতিহাস, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নেই। চারদিকে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, যারা এ নিয়ে সিরিয়াস লেখালেখি করতে পারতেন- তারা সুযোগের অভাবের কারণে তা পারছেন না। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শুধুই সরকার পরিচালনা করবে, নাকি জাতির ইতিহাসের এসব কলঙ্কজনক অধ্যায় সম্পর্কে যে বিভ্রান্তির পাহাড় জমা হয়ে আছে তা অপসারণের উদ্যোগ নেবে। দলের অভ্যন্তরে নেতা আছে, পদ-পদবি আছে- কিন্তু এ ধরনের ইতিহাসবিরোধী প্রজন্মকে সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে রচিত বই-পুস্তক, ইতিহাস পাঠের সুযোগ করে দেয়ার কোনো উদ্যোগ তারাও নিচ্ছে না। ফলে বিরাট একটি ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে ১৯৭৫-এর মূল পরিকল্পনাকারীরা, তারাই লাভবান হচ্ছে। এটি জাতির জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্য, দুঃখজনক ঘটনা।
এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে তাহলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের উদ্যোগ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই কেবল নেয়া সম্ভব হয়েছিল। সেই বিচার সম্পন্ন করাও খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। বিচারটিকে ভণ্ডুল করতে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত চেষ্টার ত্রুটি করেনি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড সংঘটিতকারী মহল, এর সুবিধা লেহনকারী গোষ্ঠী, বিএনপি-জামাত জোট। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আবার ফিরে আসার পরই রায় বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়েছে সরকার, জনগণ এবং রাষ্ট্র তিন দশক পর এমন একটি কলঙ্ক থেকে মুক্তির কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তারপরও উক্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না- যেহেতু মূল আসামি এবং দণ্ডপ্রাপ্তদের কয়েকজন দেশের বাইরে পালিয়ে আছে। নানা আইনি জটিলতার কারণে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে জেলহত্যা মামলার বিষয়টিও নানা জটিলতা অতিক্রম করেছে। সেখানেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা বিদেশে পলাতক রয়েছে। তারপরও এটুকু সান্ত¡না এই যে, শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে দুটি মামলার বিষয়েই ১৯৭৫ সালের এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারিক দিক, একই সঙ্গে এর রাজনৈতিক গুরুত্বও নিশ্চয়ই অপরিসীম। সেটি আলাদা বিষয়। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিচার মূল ষড়যন্ত্রের একেবারেই সুনির্দিষ্ট অংশের অপরাধের বিচার মাত্র। মামলা দুটোর গুরুত্বকে সেভাবেই ভবিষ্যতে দেখা হবে। তবে হত্যাকাণ্ডের বাইরেও পঁচাত্তরের গোটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়টি অনেক বেশি বিস্তৃত, জটিল, গভীর এবং সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যাভিমুখী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা- যা শুধুমাত্র মামলা বা বিচারিক রায়ে প্রতিভাত হওয়ার সুযোগ নেই। এটিকে সামগ্রিক চিত্রে ও চরিত্রে তুলে আনার বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। সেই কাজটি করতে হয় ব্যাপকভাবে তদন্ত সংঘটিত করার মাধ্যমে। এর নেপথ্য নায়ক, সহায়ক শক্তি কারা কারা ছিল, তাদের কর্মকাণ্ড খুঁজে বের করা, তাদের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য, লক্ষ্যসহ যাবতীয় দিক উন্মোচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি করা না গেলে হত্যা মামলার রায় থেকেই ১৯৭৫-এর এসব হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরোপুরিভাবে জানা সম্ভব হবে না। এ জন্য প্রয়োজন ১৯৭৫-এর সকল হত্যাকাণ্ডের পেছনের ঘটনাবলী, কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত সকল ঘাতক, রাজনৈতিক, আমলা, সামরিক, বেসামরিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতাকে উন্মোচন করা। হত্যাকাণ্ডের আগে পরে কী ঘটেছিল, কেন রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যর্থ হলো এসব হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র সময়মতো বুঝতে ও ধরতে, দুর্বলতা কোথায় ছিল, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর কিভাবে, কারা জেল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, এতো বড় জেল হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পেছনে তৎকালীন সরকার, প্রশাসন, জেল কর্তৃপক্ষ, দেশী-বিদেশী কোন কোন শক্তি কিভাবে জড়িত ছিল- এসব তদন্ত করেই উদঘাটন করা সম্ভব। এতো বছর বিষয়টি করা হয়নি নানা প্রতিক‚লতার কারণে তা হয়তো মেনে নেয়া যায়। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে সরকার উদ্যোগ নিলে এতো দিনে তদন্ত কাজটি অনেক আগেই হয়তো সম্পন্ন করা সম্ভব হতো। তাতে যে বিরাট কর্মযজ্ঞ সাধন করা সম্ভব হতো তার ফলে দেশ এবং জাতি ১৯৭৫-এর দুঃখজনক সকল ঘটনার একটি তদন্ত ও লিখিত বিবরণ পেতো, এটি অবশ্যই ১৯৭৫-এর যাবতীয় ঘটনার একটি মূল্যবান রাষ্ট্রীয় দলিলপত্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতো। তেমন দলিলপত্রে অনেক সত্য তথ্যই হয়তো বের হতো যা এখনো আমরা জানি না। এখন ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা অনেক কথা বলছি ও লিখছি। এতো বছর তো এভাবেই চলে এসেছে। ১৯৭৫-এর ঘটনাকে হালকাভাবে দেখা উচিত নয় কিছুতেই। বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সেভাবে নিতে হলে অবশ্যই একটি জাতীয় তদন্ত কমিটি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক তথ্য ও ঘটনাবলী জানার সুযোগ পাবে। রাষ্ট্রের আর্কাইভে এ রকম একটি দলিল থাকলে লেখালেখি, গবেষণা, জ্ঞানার্জন, পঠনপাঠন, রাজনৈতিক বিতর্ক ইত্যাদিতে নির্ভর করার মতো ভিত্তি থাকতো। সেটি অবশ্যই করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে এখনই উদ্যোগ নেয়া, ১৯৭৫-এর যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, ঘটনাবলী, সংশ্লিষ্ট সকল মহল, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তথ্যপ্রমাণসহ উন্মোচিত করে দেয়া। তাহলে দেশ ও জাতি এমন বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তির বিষয়টি অনেক বেশি দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। জনসচেতনতাই সেই প্রতিরোধের মূল শক্তি। জনসচেতনতা তখনই তৈরি হয় যখন সঠিক ইতিহাসটা জানা হয়। আমাদের দেশে ১৯৭৫-এর এসব হত্যাকাণ্ডের সঠিক ইতিহাসটাই অনেকে জানি না। না জানার কারণেই আমাদের বিভ্রান্তি ও দিকভ্রান্তি বেড়ে চলছে। এ কারণেই ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি সরকারের উচিত উচ্চ দক্ষতা ও ক্ষমতা সম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা এবং সেটিকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা। এরপর জাতির সম্মুখে ১৯৭৫-এর সব হত্যাকাণ্ড ও রাষ্ট্র রাজনীতির পটপরিবর্তনের প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরা। আমাদের দেশ ও জাতি এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো দলিলই পায়নি। দলিলপত্রই বলে দেবে কি ঘটেছিল?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক।