৪৫ বছর পর পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করাটা অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু একটা বিশেষ ঘটনার পরিপেক্ষিতে এটি নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি। সাপ্তাহিক একটি আলোচনা চক্রে অদ্ভুত বক্তব্য শুনলাম। একজন বক্তা জানালেন যে একটি রাজনৈতিক দল গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক কারচুপি এবং জাল ভোটের মাধ্যমে জয়ী হয়েছে। যে আলোচনা সভায় এই তথ্য পেশ করা হয়, সেখানে নাকি ২/১ জন ব্যক্তি বলেছিলেন যে তারা ১৯৭০-এর নির্বাচনে ব্যাপক জাল ভোট দিয়েছেন। সুষ্ঠু এবং জনমুখী এবং সত্যিকার গণপ্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য চিন্তাভাবনা বা গবেষণা করা যেতে পারে। কিন্তু ১৯৭০-এর নির্বাচনে কতভাগ জাল ভোট পড়েছিল, তা নিয়ে এখনতো ভাববার প্রয়োজন আছে কি? পাকিস্তানের সামরিক সরকারের অধীনে ১৯৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্র্বাচনের পর সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। পরবর্তীতে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, তখন সেই একই সরকার একটি শ্বেতপত্র বের করে বলে যে, নির্বাচনে কারচুপি এবং জাল ভোট পড়েছে। ৪৪ বছর পর সেই পাকি শাসকদের প্রেতাত্মা কি ভর করছে এখানকার কতিপয় কথিত রাজনীতিবিদদের ওপর যার কারণে তারা ১৯৭০-এর নির্বাচনকে জাল বলতে চাচ্ছে। সেই আলোচনা চক্রে সংশ্লিষ্ট বক্তা বলেছিলেন যে, কে একজন মার্শাল ছাত্র নেতা নাকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনের জয়ী হওয়ার জন্য দেশব্যাপী একটি জাল ভোটার তালিকা বানিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ এবং জামায়েত ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। দেশে সামরিক আইন ছিল। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে ছিল। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার তারাশ ও রায়গঞ্জে এই দুই থানা মিলে একটি নির্বাচনী এলাকা, তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। তখন আমি তরুণ। চষে বেড়িয়েছি এলাকাটা। এরকম উদ্ভট তালিকা প্রণয়নের ন্যূনতম ইঙ্গিত ও পাইনি। আসলে সব বাঙালি তখন একটি মানসিকতাই পোষণ করছিল, তা হলো নৌকার বিকল্প নেই। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে একদিন সন্ধ্যার পর বগুড়া ডাক বাংলোতে বসেছিলাম। চারদিকে নির্বাচনী প্রচারণার আওয়াজ। একটি সামরিক বাহিনীর রিক্রুটিং টিমও সেখানে অবস্থান করছিল। আমার পরিচয় জানার পর এক সামরিক অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন নির্বাচনের ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কে। তিনি বাঙালি। তা সত্ত্বেও আমি সতর্কতার সঙ্গে বললাম যে এ ব্যাপারে আগাম কিছু বলা কঠিন। ভদ্রলোক ফেটে পড়লেন। তার বক্তব্য যে আমরা সিভিল অফিসাররা বুঝব না যে, বাঙালি সামরিক বাহিনীর লোকজন কিভাবে নিগৃহীত হচ্ছে পাক শাসকদের হাতে। তিনি আরো বললেন যে, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা মুজিবের নৌকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। বাঙালিরা মানসিকভাবে এ প্রস্তুতি নিয়েছিল। ১৯৭০ সালে যে তারা নৌকা ছাড়া আর কোথাও সিল মারবেন না। অবশ্য ব্যাপারটা কোনো আকস্মিক সিদ্ধান্ত নয়। দীর্ঘ ২৩ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ১৯৪৬ সালে বাংলার মুসলমানের ভোটে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেশ বিভাগের ৬ মাস না যেতেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নেয়ার ঘোষণা দিলেন। বাঙালিদের মুখের প্রতিবাদে কাজ হয়নি। বুকের রক্ত দিতে হলো। এই সম্পর্কে এই বইতে পৃথক একটি অধ্যায় রয়েছে। এই ঘটনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মন কতটা বিষিয়ে উঠেছিল। তার প্রমাণই তো তারা ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে দিয়েছেন। ৩০০টি আসনের ভেতর শাসক মুসলিম লীগ মাত্র ৭/৮টা আসন পেয়েছিল। তখন তো কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করা হয়নি কোনো মার্শাল নেতাকে কেন্দ্র করে। সত্তরের নির্বাচনে শতকরা ৫৫ ভাগ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এর ভেতর আওয়ামী লীগ পেয়েছে শতকরা ৭৫ ভাগ ভোট। এই গণজোয়ারকে শ্রদ্ধা না করে উল্টাপাল্টা কথা বলা কি বাঞ্ছনীয়। পাকিস্তানি শাসকরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন থিওরি আবিষ্কার করছিল এই নির্বাচনকে ঘিরে। তারা এবং তাদের দোষররা এক পর্যায়ে বলতে লাগল যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটে আওয়ামী লীগ এত আসন পেয়েছে। অথচ ১৯৭০ সালে সংখ্যালঘুর সংখ্যা শতকরা ১৮ ভাগ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকরা তাদের প্রয়োজন মতো বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছে। আজ এতদিন পর ১৯৭০-এর নির্বাচনের অবমূল্যায়ন করার পেছনে কোন উদ্দেশ্য রয়েছে তা বোধগম্য নয়। তবে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে জামায়াতে ইসলাম গোলাম আযমের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। যেহেতু মুক্তি যুদ্ধের সময় গোলাম আযম গং বলতেন যে পাকিস্তান না থাকলে তাদের অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরের বেঁচে থাকার দরকার নেই। সেহেতু তাদের অপতৎপরতা বোধগম্য। কিন্তু এর বাইরে যারা এ ধরনের গবেষণা বা কাজকর্ম করেছে। তারা কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চাইছে তা বোধগম্য নয়।
এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। একটি গোষ্ঠী যারা এক সময় বঙ্গবন্ধুর কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং সে সমালোচনা সব শিষ্টাচার এবং ভব্যতা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারা এখন বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসে নিউক্লিয়াস গঠনের কথা বলেছেন। ১৯৬২ সালে নাকি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়। যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু। এ ছাড়া কাজী আরিফ, আব্দুর রাজ্জাক এবং সিরাজুল আলম খান। ১৯৬২ সালের জুন মাসে আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেঁচে রয়েছেন। তিনি কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন করবেন না। সামরিক আইন প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত আইয়ুব খান সব নেতাদের ধাওয়া করে বেড়িয়েছেন। ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক সাহেব সে সময় ছাত্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হননি। তিনি ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে ফজজুল হক হলের জিএস নির্বাচিত এবং মোটামুটি সমসাময়িক সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের জিএস হন। আমি হলে তার পাশের রুমে থাকতাম। তিনি যে সংসদের জিএস আমি তার সাহিত্য সম্পাদক। অবশ্য এসব বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজ্জাক ভাইকে খাটো করে দেখছি না সেটা হবে ধৃষ্টতা। তিনি কঠোর পরিশ্রমী এবং অত্যন্ত আন্তরিক এবং নিষ্ঠাবান রাজনীতিক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ফেরারি। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। ফজলুল হক হলের একটি কক্ষে এডভোকেট মুজিবুর রহমান এবং আমি থাকতাম। মুজিব এফ এইচ হলের ভিপি ছিলেন। অবশ্য ছাত্রলীগ থেকে। এক গভীর রাতে রাজ্জাক ভাই আমাদের রুমে এলেন। আমাদের উভয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করে একটা বালিশ এবং চাদর নিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়লেন। মুজিব এবং আমি ঠিক করলাম যে সকালে ক্যান্টিন থেকে নাস্তা আনব যেহেতু ওনার যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আমরা সকালে উঠে দেখি উনি নীরবে বেরিয়ে গেছেন। তিনি সংগঠনকে কিরকম ভালোবাসতেন তার একটা ছোট উদাহরণ দিতে চাই। আমার সঙ্গে এফ এইচ হল ছাত্রলীগ ইউনিটের সভাপতির মনোমালিন্য হয়েছিল। আমি ছাত্রলীগের খুবই সাধারণ কর্মী ছিলাম। আমি ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গেলাম কি থাকলাম, তাতে এই বৃহৎ সংগঠনের কিছু এসে যায় না। কিন্তু রাজ্জাক ভাই তার সংগঠনের তিল পরিমাণ ক্ষতি করতে দেবেন না। তাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে তাতে লিখেছিলেন যে, ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য হতে পারে। কিন্তু এক হয়ে সংসার রক্ষা করতে হয়।
এখন আসি নিউক্লিয়াসের কথায়। তখন হোক পরে হোক হয়ত গঠিত হয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই বুঝেছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা যাবে না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি মাহাবুব উদ্দিন সাহেব ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে আমার কক্ষে বসে এটা বলেছিলেন। ১৯৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এখানে উল্লেখ্য মাহাবুবউদ্দিন সাহেব তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। করাচিতে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিরা একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নয়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি এই অনুষ্ঠানে যেতে পারবেন না। সে সময় বঙ্গবন্ধু করাচিতে ছিলেন। তিনি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন এবং আন্তরিক পরিবেশে বলেছিলেন যে সময় এলে মুক্তির জন্য ডাক দেবেন এবং তারা এ জন্য সাড়া দেয়। অতএব নিউক্লিয়াস গঠিত হতে পারে অথবা অন্যরকম প্রচেষ্টা থাকতে পারে। যারা নিউক্লিয়াস গঠনে মূল ব্যক্তি, তাদের কয়েকজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আর এখন নিউক্লিয়াস নিয়ে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের অথরিটি প্রশ্নাতীত কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। বলা হচ্ছে কয়েক হাজার নিউক্লিয়াস নিয়ন্ত্রিত কর্মী গোটা দেশে ছড়িয়েছিল। তারা থাকলে তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ হওয়ার কথা। আমি গোটা দেশের কথা বলতে পারব না। কিন্তু যে এলাকাতে কাজ করছি সে সম্বন্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলতে পারি এ রকম কাউকে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় আমি তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার রায়গঞ্জের থানা ম্যাজিস্ট্রেট। এসডিও ছিলেন শহীদ এ কে শামসুদ্দিন। তার নেতৃত্বে আমরা ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে সংগ্রামে নেমে যাই। শামসুদ্দিন সাহেব সব সময় কমবেট ড্রেসে থাকতেন। দুটো জিপ নিয়ে মহকুমায় চষে বেড়িয়েছেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কেউ কোনো বাড়তি তথ্য দিতে পারেননি। সিরাজগঞ্জ মুক্ত ছিল সম্ভবত ২২ এপ্রিল ১৯৭১-এ। ২/১ দিন এদিক-ওদিক হতে পারে। উল্লাপাড়ার তৎকালীন ছাত্র নেতা আব্দুল লতিফ মির্জা মহকুমার অভ্যন্তরে ছিলেন। সম্ভবত চলনবিল এলাকায় কাটিয়েছেন। চলনবিল পাবনা রাজশাহী দুজেলাব্যাপী। লতিফ মির্জা পরবর্তীতে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। আমি রায়গঞ্জ থানায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে গভীর যোগযোগ রক্ষা করে কাজ করেছি। থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সরকার এবং আমি একত্রে কাজ করেছি। সে রকম কোনো এলিট সংগঠনের সদস্য থাকলে তার সঙ্গে তো যোগাযোগ থাকার কথা। কোনো নির্দেশ না পেয়ে রায়গঞ্জ থানার ছাত্রলীগের সহসভাপতি হযরত আলী এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেক মন্টুতো হতাশ হয়ে মিটিং-মিছিলে আসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা ভারত থেকে অস্ত্র আনার আগ্রহ দেখালেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। পাবনার মনসুর আলী সাহেবকে ভালোভাবে চিনতাম কেননা আমি জেলা সদরে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। মনসুর আলী সাহেব তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতেন। তাদের জন্য আমদের মতো জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেটের চেম্বারে আসতে তিনি ইতস্তত বোধ করতেন না। আর তখনকার বোকামির কথা মনে পড়লে হাসি পায়। আমি জনাব মনসুর আলীকে একটি টিঠি দিলাম এই অনুরোধ জানিয়ে যে, পত্র বাহকদ্বয়কে যেন কিছু অস্ত্র দেয়া হয়। ওরা ভারত রওনা হয়ে পথে বিপদে পড়ে। হযরত আলী ধরা পড়ে এবং মন্টু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। হযরত আলী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। এক পর্যায়ে ও মারা গেছে ভেবে পাক আর্মিরা বগুড়ার শেরপুরে ভাগারে ফেলে দেয়। দূর থেকে একজন লোক দেখে ওকে নিয়ে সারিয়ে তোলে। মন্টু ও হযরত আলীর সঙ্গে যুদ্ধের ভেতর যথাক্রমে বালুরঘাটের কুরমাইল ও মেঘালয়ের মারংটিলার যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্রে দেখা হয়। এ দুটি ক্যাম্পে আমি কিছুদিন কাজ করেছি। উভয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এখানে আরো একজনের কথা বলতে হয়। তিনি হলেন শেরপুর উপজেলার সীমাবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন সরকার মুকুল। তার ইউনিয়নটি রায়গঞ্জ থানা সংলগ্ন। মুকুল স্বাধীনতার আগে ওই এলাকার দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা। সে সময় দৈনিক ইত্তেফাক ছিল বাঙালিদের অত্যন্ত প্রিয় দৈনিক। সঙ্গত কারণে আমাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি মারংটিলা ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য দপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং বিজয় অর্জন পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। কোনো বিশেষ এলিট সংগঠনের কর্মী থাকলে তার জানার কথা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। আমি নিভৃত পল্লীতে ছিলাম সে সময় বিভিন্ন নেতাদের তৎপরতা ঢাকা শহরে। আমি যে নির্বাচনী এলাকার ছিলাম। সেখানে বঙ্গবন্ধু সভা করতে যেতে পারেননি। কিন্তু জনগনের সচেতনতা ঠিকই পরিলক্ষিত হয়েছে। ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর যখন সিরাজগঞ্জের এসডিও জানালেন ঢাকায় তাণ্ডবের কথা অল্পক্ষণের ভেতর শত শত লোক এসে উপস্থিত হলেন। তারা আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিছু করার জন্য। ঢাকা থেকে মানুষ চলছে মফস্বলে। উত্তরবঙ্গে মহাসড়কের পাশ স্বর্তঃস্ফূতভাবে স্থাপিত হয়েছিল সহায়তা কেন্দ্র। ক্লান্ত পথিকদের চিঁড়া, গুড়, পানি সরবরাহ করা হতো। বস্তুত ১৯৭১-এর ১ মার্চ বাংলার জনগণ পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করেছে। যেদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের জন্য অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করলেন। রাজনৈতিক কর্মীর প্রয়োজন হয়নি। স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অফিস, আদালত, স্কুল-কলেজ-কলকারখানা থেকে সর্বস্তরের মানুষ বেরিয়ে এসেছে।
১৯৭০-এর নির্বাচন পেছানোর জন্য নানা বাহানা করা হয়েছিল। এমনকি কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু অনড় ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার সঙ্গে রয়েছেন। নির্বাচনে যেটা প্রমাণ হয়েছে। বিশ্ব জানল যে তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এর সব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি একত্র হয়ে গণপরিষদ গঠন করে একটি সরকার গঠন করিয়ে দিল। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এ সেই সরকার শপথ নিল। শুরু হলো বাংলাদেশ নামক দেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি পদগোর্ণ বঙ্গবন্ধুর জীবননাশ না হয় সে জন্য পাকিস্তানের কাছে চিঠি লিখেছিলেন এই বলে বঙ্গবুন্ধ জনগণের নির্বাচিত নেতা। একটি রাষ্ট্রের বিমূর্ত রূপ তার সরকার। শুধু খুনোখুনি করে রাষ্ট্র কায়েম করা যায় না। তার প্রমানতো শ্রীলঙ্কার তামিল আন্দোলন। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা যথাযথ নেতৃত্ব দেন এবং বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদের অধিনায়কত্বে সফলভাবে পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ। জাতীয় চার নেতার দক্ষতা, সততা এবং দেশপ্রেমের ভয়ে তো ভীত হয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে এদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক। এ বিষয়টি অন্য অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হলো ৩০ লাখ শহীদ এবং ৩ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক সামরিক সাহায্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের কয়েক হাজার সৈন্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকার তার অবর্তমানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। অনেক তরুণ নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন ছিল তাদের, তাদেরও প্রয়োজন ছিল মুক্তিযুদ্ধের। ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান বৈরী পরিবেশে থেকেও মুক্তি যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি অমর।
এ কথা এ জন্য বলতে হচ্ছে যে, এতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সরকাররা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে এসেছে। বিভিন্নভাবে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করেও একদল আবার মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনকে হেয় করার চেষ্টা। তারপর অদৃশ্য আবির্ভাব ঘটিয়ে নিজেদের হিরো বানানোর চেষ্টা। আমি পূর্বে বলেছি যে, সবার তৎপরতা রাজধানীতে সীমিত। এর বাইরে কতটুকু খোঁজ-খবর তারা রাখতেন। চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে ২০ হাজার ৩০৩ রাইফেল সংরক্ষিত ছিল আনসার ও মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কয়েকদিন চট্টগ্রাম শহর স্বাধীনতা কার্মীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কেউ কোনো খোঁজখবর রাখেননি। ওই বিশাল অস্ত্র হস্তগত করতে পারলে কত সুবিধা হতো, তা বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সব নেতার দায়িত্ব ছিল জনাব তাজউদ্দিন আহমেদেকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়া। কেউ কেউ তা করেননি। আবার বঙ্গবন্ধুকে ফিরে আসার পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে কিছু কিছু নেতা যারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, তারা সে পথ ছেড়ে বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেবেন। সংবিধান গৃহীত হলো সমাজতন্ত্র, তাতে তাদের আশা ভরল না। তারা চাইলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এখন তাদের অনেকে ঐতিহাসিক পুজিবাদের পূজারী। তাদের অবস্থা দেখে আমার মনে পড়ল ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিক পিলু মোদির মন্তব্য। তিনি বলেছেন যে, ২০ বছর বয়স যার, সে যদি সমাজতন্ত্রী না হয় তাহলে বুঝতে হবে তার হৃদয় নেই আবার ৪০ বছর বয়সেও সে যদি সমাজতন্ত্রী থাকে তাহলে ধরে নেয়া যায় তার মস্তিষ্ক নেই। এরা কি পিলু মোদির ভাবশিষ্য। এরা বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন তো দিলেনই না বরঞ্চ নানাভাবে সমস্যা তৈরি করেছিলেন। সংবিধান গৃহীত হলো, নির্বাচন হলো, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন, অথচ আবিষ্কার করলেন যে, বাংলাদেশ এখনো সার্বভৌম হয়নি, ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্র, তাই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এ বিজয় দিবস উদযাপনে তারা প্রচণ্ডভাবে বাধা দিলেন। অনেক বোমাবাজি করলেন আবার ১৯৭৫ সালে জিয়া-সায়েম ক্ষমতায় আসার পর তারা বিজয় দিবস উদযাপন করলেন। পরিশেষে আর একটি বিষয় উল্লেখ করব। কিছুদিন আগে আমাকে একজন বোঝাতে চেষ্টা করছেন যে, বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রণয়ন এবং পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভীষণভাবে হিন্দু নেতৃত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমি তখন বলেছিলাম যে, সে সময় কিছু বামপন্থী এক সময় বলতেন যে ছয় দফার খসড়া সিআইএ করে দিয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে মাত্র ১ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৮ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে যখন ছয় দফা আন্দোলন শুরু হয় তখন বঙ্গবন্ধুকে সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহম্মেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩৯ সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো সদস্য ছিল না। আসলে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগ অসাম্প্রাদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তার নেতৃত্বে অনেকটা নিরাপদ বোধ করেন। তারপরও তারা সব সময় নিরাপত্তা পাননি। যেমন মহাজোট সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধ বিচারকে কেন্দ্র করে হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে নিগৃহীত হয়েছে।
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস ও কলাম লেখক।