বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সুখের হলেও স্বস্তির ছিল না


১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। দিনটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে নানা আনুষ্ঠানিকতায় পলিত হয়ে আসছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনের মিশন নিয়ে মধ্য রাতের আগেই রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই মিশনের অংশ হিসেবে তারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেও আক্রমণ পরিচালনা করে। তবে বঙ্গবন্ধুর কৌশলী হওয়া এবং আল্লাহ সহায় থাকার কারণে পাকবাহিনী তাঁকে হত্যা না করে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। যদিও বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সহকর্মীরা পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর যুক্তি ছিল, তিনি যদি পালিয়ে যান তাহলে পাকবাহিনী তাঁকে পাওয়ার জন্য পুরো বাংলাদেশটাকেই বধ্যভূমিতে পরিণত করতে পারে। সুতরাং পালিয়ে না গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়াটাই উত্তম। হয়ত বঙ্গবন্ধুর যুক্তিই সঠিক ছিল।

পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে জল্লাদ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে নয় মাস কারাগারে আটক রেখে, মিথ্যা মামলায় বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলানোর চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ ও আল্লাহ সহায় থাকার কারণে সে চেষ্টা তাদের সফল হয়নি, দীর্ঘ নয় মাস কারাবাসের পর বাঙালি জাতির নয়নের মণি বঙ্গবন্ধু সুস্থ শরীরে স্বদেশে ফেরত আসতে পেরেছিলেন। তাই বাঙালি জাতি ও তাঁর পরিবারের কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত সুখের ছিল। সে দিন যারা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছেন বা টেলিভিশনের পর্দায় দৃশ্যটি দেখেছেন অথবা সংবাদপত্রে পাঠ করেছেন তারা তা উপলব্ধি করতে পারবেন। যে দেশটির স্বাধিকার-স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু দু’দুবার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন, প্রায় এক যুগ কারাগারে কাটিয়েছেন, সর্বোপরি যে দেশের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লাখ লোককে জীবন দিতে হয়েছে, দুলাখ মা-বোনকে সম্ভ্রম বিসর্জন দিতে হয়েছে, সে দেশে স্বাধীনতার স্থপতির ফিরে আসার চেয়ে সুখের কী হতে পারে? কিন্তু আমার দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সুখের হলেও স্বস্তির ছিল না। তারও বেশকিছু কারণ ছিল।

প্রথমেই যদি আমরা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নেই তাহলে কী দেখতে পাই? যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, রাস্তাঘাট, কলকারখানা ধ্বংস, ফরেন কারেন্সির অভাব, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা অর্থাৎ সবকিছু মিলিয়ে দেশে বিরাজ করছিল একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসা সুখের হলেও, দেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চয়ই তাঁর জন্য স্বস্তিকর ছিল না। কিন্তু এর কোনো বিকল্পও ছিল না। অনেকেই বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু নিজে সরকার প্রধান না হয়ে যদি মহাত্মা গান্ধীর মতো জাতির পিতা হয়ে থাকতেন তাহলেই ভালো হতো। যারা এ কথা বলেন, তারা হয়ত ভুলে যান ভারতের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনেক আগ থেকেই পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল, দেশের শাসনভার গ্রহণ করার জন্য। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর মতো একজন সর্বজন স্বীকৃত নেতা ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দ্রুত পুনর্গঠন সম্ভব ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধুকে বাধ্য হয়েই দেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। এর অন্যথা হলে দেশে আরেকটি গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যেতো না। এ ছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অল্প সময়ের মধ্যে গড়ে তোলার জন্য যে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন ছিল তা গঠন একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব ছিল। যদিও জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে তিনি পুরোপুরি সফল হতে পারেননি, এটাও একটি অস্বস্তির বিষয়।

বঙ্গবন্ধুর জন্য অস্বস্তির আরেকটি কারণ ছিল, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এত সহজে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। তাদের যুক্তি ছিল পৃথিবীর কোনো দেশেই তা সম্ভব হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এটাও একটা শিরঃপীড়ার কারণ ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সদিচ্ছার কারণে মাত্র তিন মাসের মাথায় শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশে ফেরত গিয়েছিল। যাওয়ার আগে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণে সহযোগিতা করে।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ ছিল, যত দ্রুত সম্ভব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি ও সাহায্য-সহযোগিতা আদায়। কারণ বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন থাকলেও, আমেরিকা, চীন ও সৌদি আরবসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার আগ পর্যন্ত চীন এবং সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয়নি। কিন্তু ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়নের এমন কোনো আর্থিক সঙ্গতি ছিল না যে তারা বাংলাদেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় শতভাগ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে। তাই যে কোনো উপায়েই হোক আমেরিকা ও আরব বিশ্বের সহযোগিতা আদায় জরুরি ছিল। তাই এ বিষয়টিও বঙ্গবন্ধুর জন্য মোটেই স্বস্তিকর ছিল না এবং বাস্তবতা হলো বন্ধুত্বের বিনিময়ে আমেরিকা যে সব শর্তারোপ করেছিল সেগুলো পূরণ না করার কারণে বরং বঙ্গবন্ধুকে চরম মূল্যই দিতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু যে দলটির প্রধান ছিলেন এবং যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কোনো বিপ্লবী দল ছিল না, এটি ছিল সব শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয়তাবাদী দল। সব শ্রেণির সমাবেশ এ দলে ঘটলেও প্রাধান্য ছিল মধ্যবিত্তের। এ ছাড়াও সুবিধাবঞ্চিত কিছু বাঙালি বণিক শ্রেণিও এতে যুক্ত হয়েছিল। পেছনে ছিল পদবঞ্চিত, বেসামরিক আমলা, সামরিক কর্তা-ব্যক্তিরা। সুতরাং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু নেতাকর্মীর পাশাপাশি ওই সব ব্যবসায়ী, আমলা, সামরিক কর্তাব্যক্তিরা দেশ ও জাতির কথা বিবেচনায় না নিয়ে নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, যা এখনো দেখা যায়। যা আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য স্বস্তিকর নয়, তেমনি বঙ্গবন্ধুর জন্যও স্বস্তিকর ছিল না।

এ ছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও দেশ গঠন প্রক্রিয়ার জন্য উপযোগী ছিল না। চার খলিফার দুই খলিফা আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ (যাদের বাম ধারার রাজনীতির ধারক-বাহক বলে চিহ্নিত করা হতো, যদিও তাদের অনেককেই পরবর্তীতে সুবিধাবাদী রাজনীতির পথ বেছে নিতে দেখা গেছে এবং কেউ কেউ তাদের ভুল বুঝতে পেরে মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন) তথাকথিত শ্রেণি সংগ্রামের নামে দেশে জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি, সিরাজ শিকদারদের গলা কাটার রাজনীতি সদ্য স্বাধীন দেশে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। যা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনঃনির্মাণেরও অন্তরায়। এ ছাড়া এদের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি অত্যস্ত সুকৌশলে আশ্রয় গ্রহণ করে ও বাংলাদেশ বিরোধী সব ধরনের ক্রিয়াকর্ম চালিয়ে যেতে থাকে। পরিণামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মধ্যে অনৈক্য এবং অতিবামদের ভুল রাজনীতির কারণে বছরের পর বছর বাঙালি জাতিকে কম মূল্য দিতে হয়নি। জীবন দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে। তাই এ কথা আজ নির্দ্বিধায় বলা যায় ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, স্বদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন সুখের হলেও স্বস্তির ছিল না।

যুক্তরাজ্য থেকে

সুজাত মনসুর : সাবেক ছাত্রনেতা ও কলাম লেখক।

SUMMARY

1799-3.jpg