রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা কয়েকটি দিবস পালন করে থাকি, যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এ ছাড়া আরো কিছু দিবস রয়েছে যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য কম নয়। যেমন ৭ মার্চ। ৭ মার্চ ১৯৭১-এ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু প্রথম স্বাধীনতার কথাটি উল্লেখ করলেন। সভায় উপস্থিত লাখো জনতাসহ গোটা দেশ সেই কথাটিকে গ্রহণ করলেন যার ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ। ১৭ সেপ্টেম্বর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস। বাংলার তরুণরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হওয়ার ঠিক ১০ বছর পর ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার বুকে আবার রক্ত দিতে হয়েছিল শিক্ষার জন্য। তখনকার স্বৈরশাসক আইয়ুব খান শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করতে চেয়েছিলেন। অবশ্য আজো আমাদের সংবিধানের প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। ১৪ ডিসেম্বর আর একটি দিবস যেটি বেদনাবিধুর। ’৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী সংগঠন আলবদর-আলশামস। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বৃদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তবে এটি প্রতীকী দিবস। আসলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ ’৭১-এর প্রথম প্রহর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বঘোষিত বিশ্বের অন্যতম সেরা পাক বাহিনীর ৯০ হাজার অধিক সদস্য যখন বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে। পাকি বাহিনীর এই পরাজয়ের ফলে তাদের ভেতর প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দায়িত্ব বুঝে দেয়ার সময় জেনারেল ইয়াহিয়া একটি বন্ধ খাম দিয়ে বলেন, এতে শেখ মুজিবের মৃত্যু দণ্ডাদেশের কথা রয়েছে। তিনি যখন খুশি এটি কার্যকর করতে পারেন। সিন্ধু প্রদেশের লারকানার নন্দন ভুট্টো সব কিছু নাটকীয় ভঙ্গিতে করতে পছন্দ করতেন। তিনি একটি জনসভায় এরকম একটি নাটকীয় ভঙ্গিতে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেন যে শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়া হোক। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক দর কষাকষির চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হলো না। বঙ্গবন্ধুর একই কথা তিনি দেশে গিয়ে তার দলের সঙ্গে দেশের মানুষের সঙ্গে কথা না বলে কিছুই বলতে পারবেন না। ভুট্টোর একটি দাবি ন্যূনতম শর্তে হলেও এক থাকা যায় কিনা। কিন্তু তিনি তো সে সুযোগ হারিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে যখন আহ্বান জানানো হয়েছিল ছয়দফা মেনে নেয়ার জন্য। যা হোক ভুট্টো খেল তামাশা করতে বেশ সময় লেগে যায়। এদিকে গোটা বাঙালি জাতি অস্থির। তারা স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ স্বাদ গ্রহণ করতে পারছেন না বঙ্গবন্ধু বিহনে। অবশেষে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান ত্যাগ করতে দেন বা দিতে বাধ্য হন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। সেদিন বাঙালির সার্বিক বিজয় অর্জিত হয়। অতএব ১০ জানুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে সম্পূর্ণ এক বিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক কোটি মানুষকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্বাসিত করতে হয়। তাদের বাড়ি ভিটেতে কিছু ছিল না। পাক হানাদার বাহিনী সব পুড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। অবহিত ছিলেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে। বস্তুত তার সারা জীবনের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কার্যক্রম সাধারণ মানুষকে নিয়ে। তিনি সব সময় তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ করে এসেছেন। এর ফলে নিরীহ গ্রামের কৃষককুলের ওপর কি ধরনের অত্যাচার-অবিচার হতো তাও তিনি জানতেন। অতএব ক্ষমতায় এসেই তিনি নির্বাচন প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন। হাটের ইজারাদাররা নিরীহ মানুষের ওপর টোল নিয়ে জুলুম করত। তিনি হাটের ইজারা প্রথা বাতিল করে সরাসরি সরকারিভাবে টোল তোলার নির্দেশ দেন। এতে কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয় কমেনি। যেরকম একটি আশঙ্কা অনেকে করেছেন। এরকম কথা ওঠার পর আমি একটি জেলার টোল ওঠানোর তথ্য তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছিলাম। বলাবাহুল্য, আমি সেই জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) দায়িত্ব পালন করেছিলাম। অতএব পূর্ণ কৃতিত্ব নিয়ে কাজটি করতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পরবর্তী সরকার আবার ইজারা প্রথায় ফিরে যায়। আমাদের দেশের কৃষক অনেক সময় খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে ভূমি বন্ধক রাখতেন। সেই জমি যেন সহজভাবে খোলা যায় তার জন্য তিনি নতুনভাবে অধ্যাদেশ জারি করেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের এ কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দেশব্যাপী ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করেছিলেন। আজ যে সমুদ্র বিজয় হলো বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই কাজের প্রক্রিয়ার গোড়াপত্তনও তার সময়ে হয়েছিল। দেশের তথা সাধারণ মানুষের কিভাবে কল্যাণ হবে- সেটাই তার সব সময়ের চিন্তা। যে কোনো বিষয় যা মঙ্গলের হবে এ কথা শোনার পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিতেন এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। যেমন তিনি শুনেছিলেন যে বাংলাদেশের পাদদেশে বঙ্গোপসাগরে এক বিশাল ভূখণ্ড জেগে উঠেছে বা ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি উপক‚লীয় জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের বললেন জরিপ করার জন্য। তারা রাশিয়ান হেলিকপ্টর নিয়ে দুদিন ধরে উপক‚লীয় অঞ্চলে জরিপ চালান। উল্লেখ্য, জরিপ টিমে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধু কখনো শুধু রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেননি। অর্থাৎ নির্বাচন তথা ক্ষমতা আরোহণের মধ্যে তার বক্তব্য সীমিত ছিল না। তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলতেন। তিনি সোনার বাংলা গড়ার কথা বলতেন।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়ে বলেছিলেন ‘আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি। গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। পাঁচ বছরের প্লানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকদের জমি থাকবে। বেকার অথচ কর্মক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তিকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। পয়সা যাবে তাদের হাতে। ওয়ার্কস প্রোগ্রাম হবে তাদের আওতাধীনে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে টাউটদের বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে এই দেশকে বাঁচানো যাবে না। আপনার জমির বর্ধিত ফসল আপনি আগের তুলনায় বেশি ফসল পাবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভদের হাতে। অংশ যাবে গভর্নমেন্টদের হাতে। থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। আর মহকুমা থাকবে না। প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করা হবে। নতুন জেলায় একটি করে প্রশাসনিক কাউন্সিল থাকবে। এর মধ্যে পিপলস রিপ্রেজেনটেশন থাকবে’।
১৯৭৩-১৯৭৮ সালের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করা হয়। সেখানে দারিদ্র্য বিমোচন এবং পরিকল্পিত পরিবার গঠনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। ’৭৫-এর পরবর্তী সময়ে যে দুজন জেনারেল ক্ষমতা দখল করেন, তারা বঙ্গবন্ধুর এসব পরিকল্পনাকে অবলম্বনে কিন্তু নামের পরিবর্তন করে কার্যক্রর করার চেষ্টা করেন। তবে তাদের লক্ষ্য ছিল প্রচার ও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা। তাই বিকৃতভাবে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উল্টো বিপর্যয় ডেকে আনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাতির জনক। তবে তিনি যেহেতু প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাই কিছু কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা হতে পারে। যেমন মুসলিম উম্মাহকে উপেক্ষা করার প্রশ্ন ওঠে না। তাই তিনি ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে লাহোর গিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। কিন্তু ভুট্টোকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোটা ঠিক করেননি। কেননা ভুট্টো বাংলাদেশে পাকিরা যে গণহত্যা সংঘটিত করে তার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সংসদ কর্তৃক আইন পাস হয়ে গেছে। তাই ভুট্টোকে বেড়াতে আসার আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ ছিল না। ভুট্টো একজন উগ্র মেজাজের ব্যক্তি। অত্যন্ত অহংকারী। বঙ্গবন্ধুর উদারতার কোনো মূল্য তিনি দেননি। তাই তার বাংলাদেশ সফরকালে তিনি সাভার স্মৃতিসৌধে গেলে জনাব তোফায়েল আহম্মেদ যখন তার সামনে মন্তব্য বইটি এগিয়ে ধরেছিলেন, তখন ভুট্টো সেটাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে বলেছিলেন ঞযবৎব যধং নববহ বহড়ঁময ড়ভ হড়হংবহংব।
বর্তমান অর্থমন্ত্রী ৬টি বাজেট সংসদে উত্থাপন করেছেন। এর মধ্যে তিনি দুবার কৃচ্ছ্রতা সাধন ও বেল্ট টাইটের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এতটুকু সাড়া পাননি কোথাও থেকে। এই আহ্বানটি আসতো ’৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। একমাত্র তার আহ্বানেই বিপুল সাড়া পাওয়া যেত। দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধু প্রচুর সাহায্য পেতে পারতেন তার সহকর্মী বাংলাদেশের টমাস জেফারসন অর্থাৎ তাজউদ্দীন আহমেদের কাছ থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তৎকালীন কয়েকজন প্রভাবশালী তরুণ নেতা দুজনের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে দেন। তাজউদ্দীন আহমেদ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালোবাসা ও আনুগত্য কত গভীর ছিল।
প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যাই হোক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। তিনি জাতির জনক। মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্বের ইতিহাসে তিনি যথাযথ স্থান পেয়েছেন। অতএব অর্বাচীন সমালোচনা আমলে নেয়ার কোনো কারণ নেই।
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস ও কলাম লেখক।