৪ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী রাজনৈতিক যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনির জন্মদিন। এই দেশপ্রেমিক যুবনেতা ১৯৩৯ সালের এ দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন। আমরা জানি, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে। কিন্তু তিনি নিজের গুণেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও সস্ত্রীক খুনিদের হাতে শাহাদাতবরণ করেছেন। তার স্ত্রী আরজু মনি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। আজকের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস শেখ মনির ছেলে।
শেখ মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দুদুবার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনিও ছিলেন কারা নির্যাতিত নেতা। আইয়ুব খান-মোনায়েম খান তাকে ব্যক্তিগতভাবে বড় শত্রু হিসেবেই চিনতেন। ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি আন্দোলনে শেখ মনি ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার কুলাঙ্গার মোনায়েম খানের হাত থেকে সার্টিফিকেট না নেয়ার আন্দোলনে শেখ মনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যারা মোনায়েমের হাত থেকে উপাধিপত্র নেয়ার জন্য সভাস্থলে হাজির হয়েছিলেন, তারা উল্টো শেখ মনির নেতৃত্বে সভাস্থল বয়কট করেন, মোনায়েম খানকে প্রকাশ্যে বর্জন করেন। উপাধিপত্র না নিয়েই তারা ফিরে যান। এতে ক্রুদ্ধ মোনায়েম খান ক্ষমতার বলে শেখ ফজলুল হক মনির ডিগ্রি প্রত্যাহার করে নেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি ডিগ্রি ফিরে পান।
শেখ মনির রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ১৯৬৬ সালের ৭ জুনে ৬ দফার পক্ষে হরতাল সফল করে তোলা। তিনি তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। ওই হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেত। মোনায়েম খান শেখ মনিকে গ্রেপ্তার করেন; তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর।
শেখ মনি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী শেখ মনি, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বিমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি। (স্মরণীয়-বরণীয়, ব্যক্তিত্ব, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়-পৃ:৪৬১)।
শেখ মনি ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নিউক্লিয়াস বাহিনীর পরিকল্পক ছিলেন, তেমনি ১৯৭১ সালের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিব বাহিনী গঠনের অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। এই ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। আজ বুঝতে পারি, কেন মনি ভাই মুজিব বাহিনী গঠন করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গোলাম আযমও যখন ভাষা সৈনিক, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যখন মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি ‘বীর উত্তম’ তখন মুজিব বাহিনী গঠনের প্রয়োজন ছিল বৈকি?
দৈনিক ‘বাংলার বাণীর’ প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পত্রিকায় লিখে ক্ষুদ্র লেখক হতে পেরেছি। মনি ভাই ‘বাংলার বাণীতে’ ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ নামে কলাম লিখতেন। কলাম লেখক, রাজনীতিবিদ ফকির আবদুর রাজ্জাককে অনেক ধন্যবাদ তিনি মনি ভাইয়ের কলামগুলোর একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ করেছে ‘আগামী’ প্রকাশনা। এর ছোট্ট মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, নজরুল বিশেষজ্ঞ ড. রফিকুল ইসলাম। ভূমিকায় তিনি বলেন, শেখ ফজলুল হক মনি ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সেই সুবাদে তাকে আমার জানার সুযোগ হয়েছে। শেখ মনি বাংলা বিভাগ থেকে বিএ অনার্স এবং এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছাত্র ও যুব রাজনীতিতে বিশেষত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসী ভূমিকা ছিল।
কবি আসাদ চৌধুরী শেখ মনি সম্পর্কে যা বলেছেন তাও স্মরণ করতে চাই। বলেছেন, সেই একটা সময় ছিল ত্যাগ-ব্রতের রাজনীতি তাদের ঘিরে যারা জড়ো হতেন তাদের মধ্যে গভীর দেশপ্রেম ছিল। রাজনীতি চর্চার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ ছিল, চরিত্রে সংহতি ছিল। তারা দেশের মানুষের ভোটার বা রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়িই শুধু ভাবতেন না, বড় করে দেখতেন। আমাদের মনি ভাই এই দলের মানুষ। মতান্তরে গিয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। মনি ভাইকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম। (মনি ভাইয়ের কথা- চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে- পৃ:২৭)।
১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর শেখ মনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এ সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। দৈনিক বাংলার বাণী ও আওয়ামী যুবলীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন ছিল, শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন। বাকশালের অন্যতম প্রণেতাও ছিলেন। আজ ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা নেই কিন্তু আওয়ামী যুবলীগ রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
তিনি সাংবাদিক ছিলেন, কলাম লেখক ছিলেন, ছোট গল্পকার ছিলেন, তাত্তি¡ক ছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতির উপাসক ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত সুস্থ বিনোদন ধর্মী সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা বাঙালি সংস্কৃতির পরিশীলিত বুনিয়াদ নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিল। তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থির যুবসমাজকে সৃজনশীল খাতে প্রবাহিত করতে।
বিশ্ব রাজনীতির ওপর তার প্রগাঢ় জ্ঞান ছিল। আমার কথা বিশ্বাস না হলে পড়ে দেখুন, তার লেখা প্রবন্ধ ‘বিপ্লবের পরে প্রতিবিপ্লব’ আসবে। প্রবন্ধটি পাওয়া যাবে সাংবাদিক মিনার মনসুর সম্পাদিত ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ বইতে। অসামান্য প্রবন্ধ এটি। রুশ নেতা ক্রেনেস্কি জারের রাজাকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। তার কাছ থেকেই ক্ষমতা কেড়ে নিলেন লেনিন। অথচ রাশিয়ায় লেনিনের চেয়ে ক্রেনেস্কির জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। তবুও যে সে সফল হলো তার প্রধান কারণ জারের শাসনের পর রাশিয়ার প্রশাসনযন্ত্রে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল ক্রেনেস্কি নিজের লোক দিয়ে সেটা পূরণ করার ফুরসত পাননি বা সুযোগ নেননি। পক্ষান্তরে লেনিন সেই শূন্যতার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন নিজের সপক্ষে কমিউনিস্ট বিপ্লবের অনুক‚লে। জার সরে গেল। সমাজবাদী (!) ক্রেনেস্কি বিতাড়িত হলো কিন্তু লেনিন বেঁচে রইল নতুন রাশিয়ার জন্মের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের পাতায়, বিশ্বের সমাজবাদী আন্দোলনের ধারা বিবরণীর ছত্রে ছত্রে তার নাম মুদ্রিত হলো, ‘মহান লেনিন’ হিসেবে।
এই তথ্য দিয়িছেন মনি ভাই। আরো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কেন ইন্দোনেশিয়ার নেতা ড. সুকর্ণের পতন হলো। এই পতন বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও হতে পারে বলে সন্দেহ করেছিলেন তিনি। তার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই একটি রাষ্ট্র। মানুষ এখানে দরিদ্র। মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ এখানে অপরিমিত, স্বাধীনতার শত্রুরা এখানে তৎপর, পুরনো আমলারা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রে পুনর্বাসিত। সুতরাং সময় থাকতে রোগ ধরা না গেলে দাওয়াইটিও কেউ খুঁজবে না এবং একজন সংবাদপত্র সেবী হিসেবে সে দায়িত্ব আমাদেরই।
এই উদ্ধৃতির আক্ষরিক বাস্তবতা আমরা ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে দেখেছি। ফকির আবদুর রাজ্জাক সম্পাদিত ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ কলাম সঙ্কলনটি পড়ে উপলব্ধি করেছি শেখ মনির কলামে ছিল যথার্থ লেখকের ক্ষমতা। গদ্য শৈলীর প্রশ্নে বঙ্কিম চন্দ্রের মতো অনুপেক্ষণীয় গদ্যের বড়গুণ সরলতা এবং স্পষ্টতা। শেখ মনির কলামগুলোতে তার নিজস্ব মত সরল-সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার কথার সপক্ষে তথ্যের সন্নিবেশে কোনো ঘাটতি নেই। তিনি তাত্তি¡কও ছিলেন। তত্ত্ব এসেছে অভিজ্ঞতা ও অধীত বিদ্যার উৎসমূল থেকে। অত্যন্ত শক্তিমান কলাম লেখক ছিলেন তিনি। পড়ে দেখতে পারেন ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ বইটি।
বারবারই তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন সংশয়ের ব্যাপারটি ভাবছিলেন। তাই বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের জনতার আশা-আকাক্সক্ষা, ভাবনা-চিন্তা আমাদের সাধের বাংলাদেশটিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন আমাদের মতো একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সমস্যা সঙ্কুল দেশের মানুষের জন্য অশেষ মূল্যবান। চীন, রাশিয়া, আমেরিকার জনগণের দৃষ্টিতে সেখানকার নেতাদের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মাওসেতুং না থাকলে, নিক্সন না থাকলে বা ব্রেজনেভ, কোসিগিন না থাকলে সেখানে আজ আর সমস্যা হবে না। কারণ সেখানকার সমাজ আজ একটা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সড়ক নির্মাণ হয়ে গেছে। আমরা কেবল শুরু করেছি। আবর্জনা সাফ করে আমাদের যাত্রা পথ তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই পথপ্রদর্শক-কাণ্ডারি। খোদা না করেন, তাকে যদি আমরা হারাই, তাহলে বাংলার এই সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কি আছে! সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই তার জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তারচেয়ে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল।’ (দূরবীনে দূরদর্শী- পৃ:১২৩)।
কোনো নিরাপত্তা দিয়েই আমরা বঙ্গবন্ধু ও মনি ভাইকে ধরে রাখতে পারিনি। তার চিন্তার দূরদর্শিতা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলেই তাকে স্মরণ করা সার্থক হবে।
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।