অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালি জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল। ১৯৭১ সালের এ মাসে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। এ মাসের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক অবাস্তব রাষ্ট্রটির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়, শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। মার্চের ২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতালায় উত্তোলন করা হয় লাল-সবুজের বুকে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রকৃতপক্ষে ওইদিনই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যদিও তাঁকে যৌক্তিক কারণেই কিছুটা কৌশলী ভূমিকা নিতে হয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী শুরু করে ঢাকার বুকে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।
মার্চ মাসটি আমাদের জাতীয় জীবনে আরেকটি কারণেও ঐতিহাসিক ও গুরুত্ববহ, কেননা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মও এ মাসের ১৭ তারিখে। তাই আনন্দ-বেদনায় ভরা অগ্নিঝরা এ মাসের ৭ মার্চ আজ আমার আলোচনার বিষয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও ৭ মার্চের ভাষণের মর্মবাণী আমাদের প্রেরণার উৎস।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীসহ কায়েমী স্বার্থবাদী মহল প্রমাদ গুনে এবং বাঙালিদের হাতে যাতে দেশের শাসন ক্ষমতা অর্পণ না করতে হয়, সে জন্য টালবাহানা শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে কুচক্রীদের শিখণ্ডি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। বঙ্গবন্ধু সারা পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রতিবাদে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করেন এবং ঘোষণা দেন তিনি ওইদিন পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবেন। এরপরই শুরু হয় প্রতীক্ষার পালা। সবার দৃষ্টি তখন ক্যালেন্ডারের পাতায়, মার্চের ৭ তারিখের দিকে। চারদিকে টান টান উত্তেজনা আর কানাঘুষা, কি বলবেন বঙ্গবন্ধু? তিনি ওইদিন কি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? নাকি অন্যকিছু?
ইয়াহিয়া কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মানুষ নিজস্ব উদ্যোগে সারা দেশে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। বিপরীতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীসহ সরকারের পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে মানুষ হত্যা চলতে থাকে নির্বিচারে। এদিকে প্রতিদিনই হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিল বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিতে এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ সব স্তরের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকেও ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো কিছুই খোলাসা করে বলেন না। শুধু সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন।
তারপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১। বিশাল রেসকোর্স ময়দান লোকে-লোকারণ্য। লাখো মানুষের পদভারে প্রকম্পিত। ‘জয় বাংলা’ আর ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার-আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যুমনা’, ‘তোমার নেতা, আমার নেতা-শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত। সবার মুখে ব্যাকুলতার চিহ্ন, বঙ্গবন্ধু কি আজ স্বাধীনতা ঘোষণা দেবেন? আমাদের পরবর্তী করণীয় কী হবে? কারো কাছেই সঠিক উত্তরটি জানা নেই। সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে তাঁর আগমনী পথের দিকে। এক সময় সে প্রতীক্ষারও অবসান হয়। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
বঙ্গবন্ধু ধীরলয়ে হেঁটে মঞ্চে উঠে এলেন। চারদিকে লাখ লাখ মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত আর গগনবিদারী স্লোগান, ‘জয় বাংলা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। জনতার দিকে তাকিয়ে তাদের বসার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করলেন। মাথার ওপর তখন উড়ছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বেশ কটি হেলিকপ্টার, তিনি তাও তাকিয়ে দেখলেন। তারপর ভায়েরা আমার বলে শুরু করলেন তাঁর ঐতিহাসিক সেই ভাষণ। সবার দৃষ্টি তখন বঙ্গবন্ধুর দিকে, কর্ণ সজাগ, তিনি কি বলেন তা শোনার জন্য। সবার একটা প্রত্যাশা আর নয়, এবার যেন চূড়ান্ত স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রায় চল্লিশ মিনিট তিনি একনাগাড়ে বলে গেলেন। তিনি সবাইকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন, পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা, তাঁর অবর্তমানে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করা, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন। এবং সবশেষে তিনি বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ল, স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে মানুষ নিজ নিজ এলাকায় ছুটে গিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামকে আরো বেগবান করে তুলল, যা পরবর্তীতে সর্বাত্মক স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমার তখন শৈশবকাল চলছে। কথা ছিল রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। আমরা তখন মফস্বলের একটি থানা সদর দিরাইতে থাকি, রেডিওই সম্বল। আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে রেডিও চালু করে অপেক্ষা করতে লাগলেন, ভাষণটি শোনার জন্য। যেভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তার সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। প্রতিবাদে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেডিও-টেলিভিশনে কাজ থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিলে, পাকিস্তান সরকারের টনক নড়ে এবং পরদিন ৮ মার্চ সম্ভবত সকাল সাড়ে ৮টায় রেকর্ডকৃত ভাষণটি সম্প্রচার করা হয় এবং পরিবারের সবার সঙ্গে আমারও সেদিন তা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি নিয়ে আজ স্বঘোষিত ইতিহাসবিদসহ অনেকেই অনেক কথা বলেন। তার মধ্যে যে কথাটি বেশি জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেন, তাহলো বঙ্গবন্ধু কেন সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। তাদের যুক্তি হলো তিনি আসলে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমিন্ত্রত্ব পাওয়ার জন্য। আর এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। গত প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে অনেকেই এসব অবান্তর কথাগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবুও এ সব ইতিহাস বিকৃতকারীরা দমে যায়নি। আর এদের দমানো চেষ্টা করা বৃথা জেনেও বলতে চাই, সেদিন বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল, তাঁর সারাজীবনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর মতোই। তিনি যেমন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি, তেমনি স্বাধীনতা ঘোষণার প্রশ্নেও ওইদিন তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তিনি যদি ওইদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে তিনিসহ রেসকোর্স ময়দানে জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষের আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা ছিল না। তিনি যদি ওইদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন তাহলে ইতিহাসে তিনি একজন বিচ্ছিন্নবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতেন, স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে নয়। আর এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য পাওয়াও কঠিন হয়ে যেত। এ ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্যও আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিল। সুতরাং ইতিহাস বিকৃতকারীরা যে যাই বলার চেষ্টা করুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে এরাই একদিন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
আজকে যখন দেশে আবারো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি আর বিপক্ষ শক্তির লড়াই চলছে, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা লাখো শহীদের রক্ত ও লাখো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন বিদ্যমান। আজ যারা পেট্রলবোমা-ককটেল ছুড়ে শিশু-মহিলাসহ নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, বাংলাদেশকে নব্য পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১-এর মতো পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে। অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধকে সমাপ্ত করে ছিনিয়ে আনতে হবে চূড়ান্ত বিজয়। মনে রাখতে হবে আমাদের বিজয়ের কোনো বিকল্প নেই।
যুক্তরাজ্য থেকে
সুজাত মনসুর : সাবেক ছাত্রনেতা ও কলাম লেখক।