১৯৭১-এর ১ মার্চ সিরাজগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সদর দপ্তরে গিয়েছি থানা উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আনার জন্য। সে সময় আমি রায়গঞ্জ থানার ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করছিলাম। এর বছরখানেক আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৪২টি থানায় পরীক্ষামূলকভাবে ম্যাজিস্ট্রেটদের পদায়ন করা হয়। সিরাজগঞ্জ মহকুমায় ১টি মাত্র থানা নির্বাচিত হয় সেটি হলো রায়গঞ্জ থানা। এসডিও অফিস থেকে চেক নিয়ে একজন সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে বসে গল্প করছিলাম। গল্প আর কি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা। হঠাৎ হইচই শুরু হয়ে গেল, অফিসের কর্মচারীরা নানারকম স্লোগান দিতে দিতে অফিস ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বাইরে এসে দেখি কোথাও কোনো রাজনৈতিক নেতা বা পিকেটার নেই। জানা গেল যে দুপুর ১টায় রেডিও পাকিস্তানে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার একটি ঘোষণা পড়ে শুনানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে ৩ মার্চ ’৭১-এ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৩ তারিখে সদস্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে কয়েকজন সদস্য ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়ার ঢাকায় আসার কথা। তার পরিবর্তে এই কাণ্ড। শিল্প-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রেই সবাই স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে রাস্তায় এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করেছেন। সবার মুখে একটি কথা, সব কথার শেষ কথা, বাংলার স্বাধীনতা। কৃষককুল ওভাবে বেরিয়ে আসেননি, তাদের অবশ্য সেই ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। কিন্তু প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আমি মোটরসাইকেলযোগে নিজ কর্মস্থলে ফিরে আসি। দূরত্ব ১৫/১৬ মাইল। সম্পূর্ণ কাঁচা রাস্তা। ধীরে আসতে হয়েছে। পথিমধ্যে মাঝে মাঝে জটলা। জনগণের ছোট ছোট সমাবেশ বলা চলে। আলোচনার বিষয় একটি, তাহলো অকস্মাৎ জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন অন্যায়ভাবে স্থগিত করা, তারা বুঝেছেন এবং বলছেন পশ্চিমা শাসকরা কোনোদিন বাঙালিকে ক্ষমতায় যেতে দেবে না। সে দিনই অর্থাৎ ১ মার্চ ১৯৭১-এ বাংলার জনগণ তাদের মন থেকে পাকিস্তান শব্দটি মুছে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তান তাদের কাছে এখন বাংলাদেশ। এমনিভাবে গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ চলছিল। রেডিওতে ইয়াহিয়ার ঘোষণার পর দর্শকরা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। খেলা বন্ধ হয়ে যায়।
১ মার্চ ’৭১-এর যে বিস্ফোরণ, এর ইঙ্গিত কিন্তু ’৭০-এর নির্বাচনেই পাওয়া গিয়েছিল। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠুভাবে ’৭০-এ প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শতকরা ৫৫ ভাগ ভোট পড়ে। এর ভেতর শতকরা ৭৫ ভাগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বাক্সে আসে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। অতএব ১ মার্চ যখন ইয়াহিয়া হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন সবাই বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন যে পরবর্তী কার্যক্রম কি হবে তা জানার জন্য। তবে তারা যে আর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রতি ন্যূনতম আগ্রহী নন, তা তাদের স্বতঃস্ফ‚র্ত প্রতিবাদের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী ৯ মাস পাকবাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন, কোনো কিছুই বাঙালির মনোভাবকে পরাভূত করতে পারেনি। তারা অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। জনগণ পরিপূর্ণরূপে সে আহ্বানে সাড়া দিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী সাহেব পরবর্তীতে এক ঘরোয়া বৈঠকে বলেছিলেন যে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন দুটোই দেখেছিলেন। তার ভাষায় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের তুলনায় খেলনা। কেননা এটি সম্ভব হয়েছিল গোটা বাঙালি জাতি তাকে তাদের এক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর সেই ঘরোয়া বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ এবং আহ্বান অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল গোটা জাতি। এর জন্য আর কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয়নি।
ইতোমধ্যে জানা গেল যে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। সেখানে আসবে আন্দোলনের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী সভা-সমিতি মিছিল চলছে। সর্বত্র লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হচ্ছে। কোনো আপস রফার কথা নয়। জয় বাংলা স্লোগানে মুখর। পাকিস্তান কথাটা কোনোভাবে কারো মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে না। পাকিস্তান কথাটা আসত যখন বলা হতো- জিন্নাহর পাকিস্তান বাঙালির গোরস্তান। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা একদিন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং অন্যদিন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। তবে এ পতাকা উত্তোলন বা ইশতেহার পাঠ আন্দোলনের অলংকার। তরুণ সমাজের চরম আগ্রহ ও উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ। আগেই উল্লেখ করেছি যে, স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু বিকল্প নেই এবং তা তো জনগণ ১ মার্চ জানিয়ে দিয়েছেন। তাদের এই প্রত্যয়ের দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ হলো বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি শতভাগ সমর্থন। ১ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তিগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছেন এতে মুক্তিযুদ্ধ যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে তেমনি তারা নিজেরাও ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছেন। নইলে তারা ইতিহাসের অতল গহŸরে তলিয়ে যেতেন। তবে সমস্যা হয় যখন যে পরিমাণ অবদান দেশের জন্য রেখেছেন, তার চাইতে বেশি জাহির করা অথবা ফায়দা লুটার চেষ্টা করা। গোটা জাতি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করেছে ৭ মার্চের জন্য। দিনটি যেন আর আসতে চায় না। ৭ তারিখ দুপুর থেকে ১টা ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে আমরা সবাই উন্নয়ন কেন্দ্রের সম্মেলন কক্ষে ভাষণ শোনার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমরা বলতে থানা পর্যায়ের সব কর্মকর্তা, স্থানীয় নেতারা এবং থানা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা। ভাষণ আর শোনা গেল না। কিছুক্ষণ পর রেডিও বাংলা স্তব্ধ হয়ে গেল। আর কোনো কিছু জানার উপায় নেই। থানাতে একটা পিসিও, সেখানে হাতল ঘুরিয়ে ফোন করে সিরাজগঞ্জের সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ করা যেত। যাহোক এ অবস্থায় চলতে চলতে রাত ১০টা নাগাদ রেডিও বাংলাদেশ মুখ খুলল। জানালো পরদিন সকাল ৮.৩০ মিনিটে রেকর্ড করা ভাষণ শুনানো হবে। বুঝতে কষ্ট হলো না যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারে সামরিক কর্তৃপক্ষ বাধা দিয়েছিল। এর প্রতিবাদে সব রেডিও কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ থেকে বিরত ছিলেন। পুনঃপ্রচারের আশ্বাসে তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। এটি মুক্তিকামী বাঙালির মুক্তি অর্জনের সংগ্রামের আর একটি দৃঢ় প্রত্যয়ের দৃষ্টান্ত।
আমরা সবাই আবার ৮ মার্চ সকাল একত্রে বসলাম ভাষণ শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন ‘ভায়েরা আমার’ সম্বোধন করে। দুটো অক্ষরের দ্বারা তিনি গোটা জাতির হৃদয়ে প্রবেশ করলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই ভাষণ শুনলাম। ভাষণ শেষ হলে কয়েকজন বলে উঠলেন যে, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না কেন। এখানেই বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। এ নিয়ে কিছু বলার আগে ৭ মার্চের ভাষণটি আন্তর্জাতিকভাবে কতটা মূল্যায়িত হয়েছে, তা উল্লেখ করা প্রয়োজন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। কতটা ঘটনাবহুল এ সময় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভাষণের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ৪১টি ভাষণ স্থান পেয়েছে এ সংকলনে। উপমহাদেশের একটি ভাষণই স্থান পেয়েছে। তাহলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙালি স্বাধীনতা চাচ্ছে, তাই তিনি বললেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। প্রথমবারের মতো ‘স্বাধীনতা’ কথাটি উচ্চারিত করা হলো। তা অর্জন করতে হলে কী করা প্রয়োজন তাও বলে দেয়া হলো। লাখো নিরস্ত্র জনতাকে অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলা যায়, হরতালের কথা বলা হয়। কিন্তু তাদের খালি হাতে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলা যায় না যদি কেউ উন্মাদ না হয়। সেদিন ঢাকা শহরে লাখো লাশ পড়লে বিশ্বে সহানুভূতির বার্তা আসত। কিন্তু সবার চোখে এটি বিবেচিত হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে। সেই সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। তিনি তার বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ট্যাংক কামান নিয়ে পাকবাহিনী প্রস্তুত ছিল যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। প্রয়োজনবোধে ঢাকা শহরকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হবে। তিনি সর্বক্ষণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছিলেন। পরিশেষে এও বলেছিলেন যে, মুজিবের ভাষণে আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে। তিনি এ কথাও বলেছেন যে ইয়াহিয়া সরকারের উচিত শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে আপস রফা করা। তা না করে তিনি সংঘাতের পথ বেছে নিলেন।
৭ মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে হয় বঙ্গবন্ধু তাঁর এ ভাষণে বলেছেন যে, গরিবের যেন কষ্ট না হয়, তার জন্য ট্রেন, লঞ্চ, বাস সব কিছু চলবে। তিনি জনগণের নেতা তাই তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভেবেছেন। তাদের শান্ত থাকতে বলেছেন, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করতে চাননি। এই ভাষণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের কথা মনে পড়ল। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন তখন তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তা ছাড়া জেনালের ইয়াহিয়া যখন ছদ্মবেশে ঢাকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি শনাক্ত করতে পেরে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন। তিনি পরে রাজনীতিতে আসেন। আওয়ামী লীগে যোগদান করে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হন। তিনি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বই লিখেন। তিনি সেখানে লিখেছেন যে, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’র সঙ্গে ‘জয় পাকিস্তান’ও বলেছিলেন। দীর্ঘ ৪৩ বছর পর তিনি সেটি আবিষ্কার করলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি আমি একা শুনিনি। সদলবলে শুনেছি। এ কথা উল্লেখ করছি বস্তুত ১ মার্চ ১৯৭১-এর পর পাকিস্তানের পক্ষে এতটুকু সাফাই গাওয়ার পরিস্থিতি বাংলাদেশের ছিল না। তাই ‘জয় পাকিস্তান’ বলার কথা কেউ ভাবতে পারেন না, আর বঙ্গবন্ধুর তো প্রশ্নই ওঠে না। এই উপলব্ধিটা যদি কারো না আসে, তা হলে করুণা করা ছাড়া আর কি করা যেতে পারে?
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস, কলামিস্ট।