উত্তাল মার্চ। রক্তাক্ত মার্চ। বাঙালির জাতির ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় মাস। অগ্নিঝরা এই মাসের ৭ মার্চ দিনটি বাঙালি জাতির কাছে গর্বের ও গৌরবের। এই দিনটি প্রতি বছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে। দিনটি ফিরে এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাইকে আন্দোলিত করে। নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করে তোলে। জাগ্রত করে তোলে আমাদের নতুন চেতনায়। মার্চের এই দিনটি ফিরে এলেই আমার অনুভূতিকে বারবার তাড়া দেয়। মানসিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আর সেই তাড়না থেকেই আজকের এই লেখাটি।
১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। বলা যায় ১ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের সব অফিস-আদালত, কলকারখানা বঙ্গবন্ধুর একক নির্দেশে চলতে থাকে। এ কটি দিন দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়। ঢাকা, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল-মিটিংয়ে বর্বর পাকবাহিনীর গুলিতে অনেক বাঙালি শাহাদাৎ বরণ করে। বলা যায় অঘোষিত স্বাধীনতায় বাঙালিরা স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষ, প্রতিটি বাঙালি। ২৩ বছর মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা ঘটে এই দিনটিতেই। এই জনসভা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ঘিরে তখন সারা দেশে চলছিল ব্যাপক কল্পনা-জল্পনা। আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে আসলে কী বলবেন! স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? না অন্য কিছু? যা হোক সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু জনসভাস্থলে আসলেন। যদিও জনসভা হওয়ার কথা বেলা ২টায় কিন্তু নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরে তিনি সভাস্থলে উপস্থিত হন। আন্দোলন-সংগ্রাম জেল-জুলুম-নির্যাতন দিয়ে বঙ্গববন্ধুর জীবন শুরু হলেও এই দিনটি তার জন্য ছিল মারাত্মক সমস্যাপূর্ণ। বলা যায় ত্রিশঙ্কু অবস্থা। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্য ভুল হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আহ‚ত এই জনসভা থেকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করতে পারেন এরকম একটা সম্ভাবনা ছড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠী ভীত হয়ে পড়ে। এই ভীতির কারণেই ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান সাহেবজাদা ইয়াকুব খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তিনি যেন ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা না করেন, এই জন্য তিনি শেখ মুজিবকে অনুরোধও করেন। তিনি অরো বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা করা হলে রেসকোর্স ময়দানে কামান এবং বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হবে। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না। এই দিন সকাল থেকে তার ওপর নেমে আসে বিদেশি চাপ, স্থানীয় নেতাদের নানা ধরনের হুমকি। ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সাক্ষাৎ করেন। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের এই বৈঠকটি গোপনে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিষ্কার ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন। পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই মেনে নেবে না। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করলেন। প্রস্তাবিত বক্তৃতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন জনসভায় কী বলবেন। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণার বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি, অন্যদিকে স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্র-জনতার অব্যহত চাপ- এই সব বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু তখনো ছিলেন অস্থির। এভাবে কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর জনসভা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আ স ম আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খান ও শাহাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে কট্টর বাঙালি জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা চাই। বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির চাপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তন হলো যে পূর্ববাংলার বামপন্থী মহল কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বেলা ৩টা ২ থেকে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত মাত্র ১৮ মিনিটের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই বলেছেন। আজকে সেই ভাষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষক, ঐতিহাসিক নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। আমার এ লেখায় তা পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। আজকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির জোয়ারে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা নিয়ে কত কী হচ্ছে। ভাবতে বড় কষ্ট হয়। আবার লজ্জাও হয়। কিন্তু পরক্ষণেই আবার স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে আসি। কারণ বাঙালি তো আত্মবিস্মৃত জাতি। ৭ মার্চের সে ঐতিহাসিক ভাষণ একটু ব্যাখ্যা করলেই অনেক কিছু বের হয়ে আসে এর পক্ষে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই যে সংগ্রামের কথা বলছেন তার উদ্দেশ্য কী তা বিশ্লেষণ করার দরকার আছে! আমরা সাধারণত জেনে এসেছি সংগ্রাম বলতে অধিকার আদায়ের লড়াই, আন্দোলন, এমনকি হরতাল অসহযোগ আন্দোলনকে বুঝায়। আবার সংগ্রামের অভিধানিক অর্থ যুদ্ধ। সংগ্রাম বলতে এক সময় সন্ত্রাস বিপ্লব ও বিদ্রোহের কথাও বুঝাত। বঙ্গবন্ধু যে সংগ্রামের কথা বলেছেন- তা কি আন্দোলন বিদ্রোহ, বিপ্লব, স্বাধীনতা ঘোষণা? সম্প্রতি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারীদের উক্তির জবাবে আমার বলা, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। রেসকোর্স ময়দানের ১০ লাখ লোকের মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান। স্বাধীনতার এ ডাক দেয়ার মাঝে তার ভাষণের দুটি লাইন তাৎপর্যপূর্ণ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর।’ তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন করা যায় ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রয়োজন কেন? দ্বিতীয়ত, কেন সেই শত্রুর মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে? আজো যারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন দীর্ঘ ৪৪ বছর পরও কি যেন এক অজেয় শক্তি আমাদের মনকে দোলা দেয়, আন্দোলিত করে। ঐতিহাসিক এই ভাষণের দিকে আরো একটু নজর দিলেও বুঝা যায় প্রথমে তিনি অত্যন্ত ধীরগতিতে বক্তব্য শুরু করেন। এক পর্যায়ে চরমে পৌঁছেন ‘তবুও দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমে তিনি ২৪ বছরের (পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক ও দুঃখ-কষ্টের) ইতিহাসের কথা বলেছেন। তারপর যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা বলেছেন। তারপর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলেছেন। ১৮ মিনিটের এই ভাষণে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দিকনির্দেশনা ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি এঁকে দিয়েছিলেন- ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি’। তখন কী করতে হবে তারও স্পষ্ট সমাধান দিয়ে গেছেন। প্রকৃত অর্থে ১ মার্চ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের কলকারখানা, অফিস-আদালত চলতে থাকে শেখ মুজিবের নির্দেশে। বাংলার প্রতিটি ঘরে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা। ৬ দিন এভাবে চলার পর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সেই জনসভা থেকেই দেয়া হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। ৭ মার্চ রের্সকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন মূলত ১ মার্চ থেকে প্রতিটি বাঙালি যেভাবে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে আসছে, ঘরে ঘরে সবুজের লাল পতাকা উড়াচ্ছে তা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। তাই তো বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো’- এ রক্ত স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই। দেশকে মুক্ত করতে নয় বরং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই। ২৫ মার্চের রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তিনি ইপিআর-এর ওয়ারলেসে সেই একই ঘোষণা দিয়ে যান। ৭ মার্চের রেসর্কোসের উপস্থিত লাখ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে সন্তুষ্ট হলেন। প্রত্যেকে যার যার ঘরে ফিরে গেলেন। তাদের স্বাধীনতার ওপর হামলা মোকাবেলার জন্য তৈরি হলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মূল্যায়নে ব্যর্থ হলো। স্বাধীনতা বলতে কী বুঝায়? মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অর্থ কী? ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু যে মুকুট বিহীন স¤্রাটে পরিণত হন তার আরো একটি জ্বলন্ত প্রমাণন মেলে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আমাদের প্রিয় কবি জসীমউদ্দীনের একটি কবিতা আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে-
“মজিবর রহমান ঐ নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান
বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে
জ্বলায় জ্বলিয়ে মহাকালানল ঝঞ্ঝা অশনি বেয়ে।”
একজন মানুষ একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন। আবার ইতিহাসও তার নিজের প্রয়োজনে একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটাতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মনে হয় তেমনি একজন মানুষ। ইতিহাসের প্রয়োজনেই তার আবির্ভাব। আবার তিনি ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায় যোগ করে গেছে। ৭ মার্চ ’৭১-এর রেসকোর্স থেকে উচ্চারিত হয়েছিল বাঙালির নবজন্মের মন্ত্র। বহুকাল দিশেহারা, দেশহারা বাঙালি জনগণ সেদিন খুঁজে পেয়েছিল আপন জন্মভূমির ঠিকানা। উল্লেখ্য ‘বাংলাদেশ’ নামটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরই দেয়া। ১৯৬৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শেরে বাংলার মাজারের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে আমাদের মাতৃভূমির নাম হবে বাংলাদেশ।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অত্যুজ্জ্বল দিক-নির্দেশনা। এই ভাষণের প্রতিটি আহ্বান অধিকার বঞ্চিত দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তাই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ও বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাবাণীর সেই ৪৪তম বার্ষিকীতে আমরা আবারো নতুন করে শপথ নিই ‘এবারের সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম।’
ড. এম. শাহ নওয়াজ আলি : প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।