১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের ২৪ দিন পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। এরপর শুধু সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠন করা হয় বাংলাদেশ গণপরিষদ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ)। সংবিধান প্রবর্তন শেষে মাত্র দুটি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণপরিষদ বিলুপ্ত করা হয়। গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। ঢাকার তেজগাঁওয়ে তত্কালীন সংসদ ভবনে গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল সোমবার; সেইদিন সকাল ১০টায় গণপরিষদে ভাষণ দেন পরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সেই ভাষণটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
“স্পিকার সাহেবের অনুমতি নিয়ে আমি একটা শোক-প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাই। জনাব স্পিকার সাহেব, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাদের শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে যে সমস্ত মাননীয় পরিষদ সদস্য তাঁদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করেছেন, সেই সমস্ত স্মরণীয় ও বরণীয় বীর সহকর্মী সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এই পরিষদ শোক জ্ঞাপন করছে।
এই সমস্ত সংগ্রামী নেতার বিদেহী আত্মার সাথে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাই-বোনেরা, যাঁরা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মবলি দিয়েছেন ও ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তাঁদের জন্য এই পরিষদ তাঁদের আত্মদানের গৌরবময় স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণ রাখবে।
নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশু সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।
জনাব স্পিকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যত্ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তাঁরা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।
বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র শত কোটি বাঙালির উপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করত, তবে আমরা সেই যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম।
তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বলতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
আমি ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে।
আমার দেখতে পাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমাদের হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য কিছু করতে পারি নাই। আমাদের বাংলার গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এরকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তাঁরা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সেজন্য তাঁদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে।
আমাদের সামনে আজকে বিশেষ কর্তব্য হলো জাতিকে একটা সংবিধান দেওয়া এবং যত তাড়াতাড়ি হয়, সেই সংবিধান দিবার চেষ্টা করা হবে।
আজকে আমাদের জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার ঘর নেই; আমরা কিছু দিতে পারছি না; মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই, জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন—আপনার কাছে আবার বলছি যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হলো সংবিধান তৈরি করা।
শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়; দলমতনির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব। এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে। আমরা একটি গণমুখী সংবিধান তৈরি করতে চাই।
এই পরিষদ বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা; যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।
পাকিস্তানে যে ৪ লক্ষের অধিক বাঙালি আটকে পড়ে আছে, তাদের বিষয়ে আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। জাতিসংঘের দৃষ্টিও আকর্ষণ করা হয়েছে এবং চেষ্টা করা হচ্ছে কী করে তাদের ফিরিয়ে আনা যায়।
পাকিস্তান সরকারকেও বলা হয়েছে, আমাদের লোকদের ফিরিয়ে দাও, আর এদেশে যারা থাকতে না চায়, তাদের ফিরিয়ে নাও, আমি তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। তবে যারা যুদ্ধ-অপরাধী, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে। আমাদের বাঙালি, যারা পাকিস্তানে আটকে আছে, তারা সেখানে কাজ করতে গিয়েছিল, তারা কেউ যুদ্ধ-অপরাধী নয়। তাদের সঙ্গে আর কারো তুলনা করা যাবে না। সেইজন্য আমরা দাবি করেছি যে, আমাদের লোক, যারা পাকিস্তানে আছে, তাদের ফিরিয়ে দাও, আর অন্য দেশের যারা বাংলাদেশে থাকতে চায় না, তাদের ফিরিয়ে নাও।
তবে যারা জঘণ্য যুদ্ধ-অপরাধী, যারা এই দেশে পাশবিক অত্যাচার করেছে, লুট করেছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাদের বিচার যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে হবে।”
সূত্র :শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, ঢাকা :আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১২-২০।