বেঁচে থাকলে এবার ৯৫ বছর পূর্ণ হতো এই মহান নেতার। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের এ দেশীয় কুলাঙ্গারদের সহযোগিতায় মাত্র ৫৫ বছর বয়সে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেষ মুজিবের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার, স্থপতি এবং মহানায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। বাঙালি জাতি ভাগ্যবান, তাঁরা শৌর্যে-বীর্যে চলনে বলনে কথনে সাহসে বলীয়ান অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মুজিবের মতো একজন নেতা পেয়েছিল। শেখ মুজিব মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে এমন সব অতিমানবিক গুণাবলি ছিল, যা পৃথিবীর আর কোনো রাজনীতিবিদের মধ্যে ছিল কিনা সন্দেহ। একবার একজন বিদেশি সাংবাদিক এই বাঙালি নেতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার গুণ কি?’ মুজিবের ত্বরিত জবাব ছিল, ‘ও ষড়াব সু ঢ়বড়ঢ়ষব.’ ওই সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার দোষ কি?’ ‘ও ষড়াব ঃযবস াবৎু সঁপয’- অতিশয় দ্রুততার সঙ্গে এই জবাব দিতেও দেরি হয়নি তাঁর। সত্যিই তিনি বাংলার মানুষকে বেশি ভালোবেসেছিলেন। এ জন্য চরম মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছে।
কৈশোরেই একজন প্রতিবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন মুজিব। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বাংলার বাঘ বলে খ্যাত শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একবার স্কুল পরিদর্শনে গেলে স্কুলের ছাদ নির্মাণের দাবিতে ছাত্রনেতা মুজিব মুখ্যমন্ত্রীর পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের দুই বছর পূর্তির পূর্বেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। কারাগারে থেকে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তরুণ শেখ মুজিব এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সংগঠক এবং দূরদর্শী হিসেবেও বঙ্গবন্ধুর কোনো তুলনা হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিব ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক অসহযোগের দিনগুলোতে একজন নির্বাচিত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল না, তাই তিনি ছাত্রলীগের দ্বারা করিয়েছেন। ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ আয়োজিত লাখো জনতার সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে জাতীয় সঙ্গীত এবং বঙ্গবন্ধুকে ঘোষণা করা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। ‘বাংলাদেশ’ নামটির নামকরণও করেন শেখ মুজিব। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণস্থ তিন নেতার মাজারের পাশে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় শেখ মুজিব বলেন, “এক সময় এ দেশের বুক হতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কিছুতে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।… বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত গণনায়ক শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলার প্রতিও অমার্জনীয় অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়েছে।… বাংলার এই কৃতী দুই সন্তান আজ অসহায়ের মতো আমাদের মুখের দিকে তাকিইয়া আছেন। এই দুই নেতার মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।” (দৈনিক ইত্তেফাক, ৬.১২.১৯৬৯)।
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তরুণ শেখ মুজিবের বুঝতে বাকি রইল না, পূর্ব পাকিস্তান আসলে স্বাধীন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্র এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্বাঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ ছাড়া আর কিছু মনে করছে না। অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মুজিব ৩৫ বছর বয়সেরও কম বয়সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচারে তরুণ শেখ মুজিব বিশেষ অবদান রাখেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরে যৌবনের এক যুগ তিনি জেলে কাটিয়েছেন। সামরিক আইন, সান্ধ্য আইন, জেল-জুলুম-অত্যাচার, নির্যাতনের মুখে জীবনে কোনোদিন তিনি আত্মগোপন করেননি। কারাগার ছিল মুজিবের দ্বিতীয় বাড়ি। জেলে যাওয়ার জন্য তাঁর একটি ছোট্ট বেডিং সব সময়ই প্রস্তুত থাকত। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গেলেও সমমনা যুবকদের নিয়ে মুজিব দলকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মোকাবেলায় শেখ মুজিব ষাটের দশকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিবর্তে সরাসরি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দূরদর্শী মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে বিরোধী দলীয় সমাবেশে যোগদানের পর সেখানে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। মুজিব জানতেন, পাকিস্তানের জান্তা কোনোদিন স্বায়ত্তশাসনের দাবি মানবে না। তিনি এও জানতেন, স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা দাবিই একদিন এক দফায় অর্থাৎ পূর্ব বাংলার স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হবে।
মুজিরের ৬ দফা যে প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেবে এবং ৬ দফার আড়ালে মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে চাইছেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তার এটা বুঝতে বাকি রইল না। ৬ দফা দেয়ার পর সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে উল্লেখ করেন। মুজিব এবং দলের শীর্ষ নেতাসহ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের কয়েক হাজার নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে তিন মাসেরও কম সময়ে মুজিব চারণ কবির মতো বাংলার আনাচে-কানাচে সফর করে ৬ দফাকে পূর্ব বাংলার জনগণের দাবিতে পরিণত করেন। মুজিব ও নেতাকর্মীরা জেলে থাকা অবস্থায় পূর্ব বাংলার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বুঝে গেলেন, মুজিব বেঁচে থাকলে পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তাই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে হত্যার প্রস্তুতি নেয় জান্তা সরকার। রুখে দাঁড়াল বাংলার মানুষ। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মুজিবসহ অন্য নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জেনারেল আইয়ুব খান। আইয়ুবের পর নতুন বেশে পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেন জেনারেল ইয়াহিয়া।
আইয়ুবের ফাঁসির মঞ্চ থেকে বেঁচে আসা বাঙালি নেতা মুজিবের তখন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। জে. ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পূর্ব বাংলায় ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পায় মুজিবের দল। প্রাদেশিক পরিষদে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে ৩শ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেল ২৮৮টি। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ মুজিব বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে একজন অতিশয় জনপ্রিয় নেতা হিসেব আবির্ভূত হন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নিয়ে শুরু করল ষড়যন্ত্র। ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ১ মার্চ আকস্মিকভাবে স্থগিত করে দেয়া হয়। জান্তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না মুজিবের বাংলা। সারা বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু হলো হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন। একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে পাকিস্তানিদের কামান-বন্দুকের মুখে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। এই ভাষণে শেখ মুজিব সরাসরি স্বাধীনতা যেমন ঘোষণা করেননি, আবার স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো বাকিও রাখেননি। একটি ভাষণ, একটি দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে- এমন নজিরও ইতিহাসে নেই। শেখ মুজিব তাঁর ৫৫ বছরের জীবনে একের পর এক শুধু ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক, শ্রেষ্ঠতম বক্তা, অসামান্য জনপ্রিয়তার অধিকারী, অসীম সাহসে বলীয়ান একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা। বিশ্ব ইতিহাসে কোনো বিরোধী দলীয় নেতার নির্দেশে দেশ পরিচালিত হওয়ার নজির নেই। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক সরকার থাকা অবস্থায় পূর্ব বাংলা চলেছে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে। ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে। সে সময় লন্ডন, আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিকমানের পত্রপত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিদ্রোহী বাংলার শাসক বলে উল্লেখ করা হয়। মুজিবের ৩২ নম্বরের বাসভবন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাসভবনের মতো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীতার ঘোষণার ব্যাপারেও অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন মুজিব। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি শাসকচক্র বাঙালির ওপর হামলা চালালে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বিশ্ববাসীর কাছে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক সমর্থনও পেতেন না। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাধীনতা ঘোষণা করায় বিশ্ব সম্প্রদায় মেনে নিলো- এ ছাড়া মুজিবের আর কোনো উপায় ছিল না। বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি শত্রুর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি শুধু অসীম সাহসের পরিচয় দেননি, এটা ছিল রাজনৈতিকভাবে একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। মনীষী আবুল ফজল লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব ইয়াহিয়া-টিক্কার জিন্দানখানায় বন্দি থেকেও ৯ মাস সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মরণপণ সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছেন। যে প্রেরণা অজেয় শক্তি হয়ে আমাদের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে স্বাধীনতাকে। অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব সত্যিই অভিনব, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।’ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি উদ্ধৃতি দিয়েই আজকের লেখার ইতি টানতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালি জাতির ইতিহাসের নায়ক বঙ্গবন্ধু। এই ইতিহাসে তাঁর স্থান চির অমলিন, অমোঘ। তিনিই ছিলেন বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের ইতিহাসের রূপকার, বাঙালির দুঃসময়ের কাণ্ডারি এবং ইতিহাসের মহানায়ক। এই স্থানটি শুধু তাঁরই জন্য সংরক্ষিত।’ জন্মদিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের আত্মার আত্মীয় মহান মুজিবকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
মোহাম্মদ শাহজাহান : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক।