৭ মার্চ ১৯৭১ সাল- বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ এক অবিস্মরণীয় দিন। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতির মুক্তির এক অবিনশ্বর স্মারক এই দিনটি। ৪৪ বছর পরও সেই দিনটির আবেদন কমেনি।
মুক্তির আকাক্সক্ষায় হাজার বছর ধরে অজস্র বীরের ত্যাগে জেগে ওঠে জন্ম নিতে যাওয়া একটি জাতির অৎপযরঃবপঃঁৎধষ গধঢ় যেন ভাষণটি। ভাষণটি লিখিত নয় তবে বাঙালি জাতির হাজার বছরের মুক্তির আকাক্সক্ষায় জন্ম নেয়া একজন শেখ মুজিবের পঞ্চাশ বছর জীবনের নির্যাস যেন ভাষণটি। বাঙালি জাতিকে পৃথিবীতে আত্মমর্যাদাশীল ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রæতি এ ভাষণটি। তাইতো কবিতা আবৃত্তির মতো এ ভাষণটি এত সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ, মহিমান্বিত- অতিক্রম করে গেছে তিন হাজার বছরের ইতিহাস।
৭ মার্চের ভাষণটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক অনন্য স্মারক। ’৪৭-এর দেশভাগে মনোক্ষুণœ শেখ মুজিবের মধ্যে তখনই জন্ম নেয় স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তার। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ গঠন, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠনে অগ্রণী ভূমিকা, ’৬২-তে ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলন সমর্থন, সিরাজুল আলম-রাজ্জাকের নিউক্লিয়ার্স সম্পর্কে অবহিত থাকাসহ শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে তাঁর একান্ত আলাপচারিতায় বিভিন্ন ইঙ্গিতে থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তির বিষয়টি কত গভীরে লালন করতেন এবং কত কৌশলী পথ চলতেন। ’৬৬-এর ছয়দফা, সামরিক শাসনের অধীনে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ তার সুদূরপ্রসারী এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।
আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহম্মেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, কে এম সাইফুদ্দিন আহম্মেদসহ আরো কয়েকজন ঘনিষ্ঠজনদের অনেক সাক্ষাৎকার এবং লেখায় দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধু তাদের বলতেন- ‘ছয়দফাকে আমি এক দফায় পরিণত করব’। ৭ মার্চ ভাষণে মুক্তির আকাক্সক্ষায় জেগে ওঠা বাঙালি জাতির সামনে ঠিকই ‘স্বাধীনতা’ সেই একটি দফা নিয়ে আসলেন। ’৭০-এর নির্বাচন সব দল যখন বর্জন করল- বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন এবং বললেন- ‘বাঙালি জাতির পক্ষে কে কথা বলবে এ নির্বাচন আমার জন্য তারই গণভোট।’ এক সময় তিনি একাই কথা বললেন। আর তাঁর প্রিয় হুজুর মাওলানা ভাষানীসহ দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাঠে চরম বিরোধিতা করা দলগুলোও তাঁকে সমর্থন দিয়ে জনগণের সঙ্গে মিশে বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়াল।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই দিনটি কেবল একদিনে তৈরি হয়নি। তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন-শ্রম-সাধনায় এসেছে এ দিনটি। তিনি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে স্বাধিকার-অধিকার আদায়ের আন্দোলনের বিভিন্ন কৌশল শেখাতেন। যে কথাগুলো কৌশলগত কারণে তিনি বলতে পারতেন না সে কথাগুলো তিনি অন্যদের দিয়ে বলাতেন। আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহম্মেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রবসহ অনেকেই সে কথাগুলো বারবার বলেছেন। তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম স্লোগান শিখিয়ে দিতেন। তিনি এমন একজন নেতা যিনি জনগণের কথায় চলতেন না। বরং তাঁর মনের বাসনাগুলোকে জনগণের আকাক্সক্ষায় পরিণত করতেন। তাইতো ৭ মার্চকে সামনে রেখে জনগণের মাঝে বিশেষ করে ছাত্র-যুবসমাজের কাছ থেকে ৭ মার্চেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকল। আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহম্মেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মযহারুল ইসলামসহ অনেক সূত্রে জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ৩/৪ দিন ধরে অনেক আলাপ করেছেন। ৭ মার্চের আগের দিন বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহম্মেদ ও সিরাজুল আলমের ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলতে ছিলেন। সিরাজুল আলম বললেন- কাল যদি আপনি স্বাধীনতার ঘোষণা না দেন জনগণ মেনে নেবে না। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন- ‘জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে আমি জানি কি বলতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু বলতেন- ‘আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হতে চাই না’। তাইতো বাঙালি জাতির বিচক্ষণ নেতা অত্যন্ত কৌশলী ভাষণ দিলেন। দাবার ঘুঁটির মতো এমন মাত করা চাল ছেড়ে দিলেন যে, পাক জান্তাদের আর কোনো পথই খোলা ছিল না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীণতার ঘোষণা দিলে জনসভায় তখনই বোম্বিং করার জন্য যে প্রস্তুতি তাদের ছিল সেটি যেমন করতে পারল না। আবার যে শর্তগুলো বঙ্গবন্ধু ছুড়ে দিলেন সেগুলো মানলে মূলত স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়। তাই পাক হানাদাররা শর্তগুলো না মেনে মরণ কামড় দিল। সে কামড় আন্দাজ করতে পেরেই বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতিকে প্রস্তুতিমূলক নির্দেশনা দিয়ে গেলেন সেই ভাষণে। খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করা থেকে শুরু করে আত্মকলহ তৈরি করার জন্য নিজেদের মাঝে যে শত্রুবাহিনী ঢুকবে তাও তিনি উল্লেখ করে জাতিকে সতর্ক করে গেলেন। ধর্মীয় এবং জাতিগত সম্প্রীতিগুলো বজায় রাখার নির্দেশনা দিয়ে সতর্ক করে গেলেন ‘আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ পরিষ্কার করে বলেন গেলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি বন্ধ করে দেবে।’ আবার বললেন- ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ ‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব- ইনশাহ্ আল্লাহ্।’ এতগুলো ইঙ্গিত দিয়ে যাওয়ার পর শেষে এসে অত্যন্ত কৌশলীভাবে পরিষ্কার করে বলে দিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক সাহেব ভাষণ দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসার পথে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু আজ আপনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন তো?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন- ‘আমি যা বলব, তোরা খুশি হবি।’ ভাষণ দিয়ে ফিরে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু রাজ্জাক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘কিরে খুশি হয়েছিস?’ রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন- ‘হ্যাঁ বঙ্গবন্ধু, যা বলছেন, আপনি যদি নাও থাকেন আমরা চালিয়ে নিতে পারব।’ সত্যিই তাই। ৭ মার্চের ভাষণের পর পুলিশ ইপিআর এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিসহ পুরো জাতি গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেল। তাইতো স্বাধীনতার অফিশিয়াল ঘোষণা ২৬ মার্চ হলেও ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনারা পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তেমনিভাবে ২৬ মার্চের আগেই অনেক জায়গা এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং এসবই ৭ মার্চের ঘোষণার কারণেই। পুরো যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধারা ৭ মার্চের ভাষণ শুনে শুনে উজ্জীবিত হয়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন। ‘জয়বাংলা’ বলে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করেছেন আর মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয়বাংলা’ বলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের শপথ নিয়েছেন। অর্থাৎ ২৬ মার্চ যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীণতার ঘোষণা দিতে না পারতেন, তাঁকে যদি হত্যা করা হতো তাহলে আমরা ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস পালন না করে ৭ মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস পালন করতাম। ২৬ মার্চ কেবল আক্রান্ত হওয়ার পর নিয়মমাফিক একটি ঘোষণা। আর সবকিছই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি। তাই আমার কাছে সব সময় মনে হয় কিছু নিয়মনীতি পালনের জন্য ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করি কিন্তু বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরম কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার প্রবেশদ্বারটি ৭ মার্চ ১৯৭১।
এম জিহাদ : লেখক