টুঙ্গিপাড়া ছিল তখনকার ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত গোপালগঞ্জ মহকুমার একটি গ্রাম। সেই গ্রামের শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে কৃষি ও বন মন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালে তিনি বিখ্যাত ছয় দফা দাবি পেশ করেন। একাত্তরের ৭ মার্চে যার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। যা দেশ ও জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করে। জাতির পিতা রাজনৈতিক জীবনে প্রথম দিন থেকে তারুণ্যময় কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তাই তরুণদের কাছে বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম। বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন ও মহান অর্জন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৩ বছর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার শক্তি আর বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে স্বাধীনতার চার দশক পর এখনো আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। স্বদেশবিরোধী কুচক্রী মহলের কর্মকাণ্ড আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ও সোনার বাংলা গড়ায় বড় ধরনের বাধা।
১৯৪০ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট দীর্ঘ ৩৫ বছরের কিছু বেশি সময়ের বাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং চিন্তা-চেতনার পরিধি মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর এ দুটি পর্বে বিশ্লেষণ করা যায়। একইভাবে কী কী কারণে তরুণদের কাছে তিনি এখনো পর্যন্ত কিংবদন্তির ব্যক্তিত্ব, সেসব ব্যাখ্যার জন্য এ দুই পর্বে তাঁর কর্মময় জীবন ও নীতি-আদর্শ তুলে ধরা দরকার। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়িতে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেন, তিনি পরবর্তী সময় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত হন বিশ্বব্যাপী। তিনি তরুণ বয়সে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অপ্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত একটানা জেলে বন্দি ছিলেন জনপ্রিয় এই তরুণ নেতা। তবে জেল-জুলুমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং ভাষা আন্দোলনে ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম অবিস্মরণীয় অবদান রেখে তিনি পরিণত হন জাতির জনক ও বিশ্ব নেতৃত্বে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পান। একই সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন ‘জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি …আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্থানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাস ও শেখ মুজিব দুটো অবিচ্ছিন্ন সত্তা হয়ে ওঠে। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। তাঁর জীবন একটি অখণ্ড সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং একটি স্বাধীন- সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে ১৯৭২ সালের জানুয়ারির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। এ কারণে মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্বে দলের বিশ্বাস ও নিজের জীবনদর্শনকে একীভূত করে নিয়েছেন তিনি।
ইতিহাস লুকিয়ে রাখা যায় কিংবা বিকৃত করা যায়। কিন্তু চিরন্তন সত্য হলো ইতিহাস কোনো না কোনোভাবেই প্রকাশিত হয় তার আপন নিয়মে। এ সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম তাদের মনের অজান্তে লুকিয়ে থাকা দেশপ্রেমের তাগিদে ২১ ফেব্রুয়ারিতে, ৭ মার্চে, ১৬ ডিসেম্বরে। দেশকে ভালোবেসে এ দিনগুলোতে তারা লাল সবুজের পতাকাকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবে মুখরিত হয় স্বাধীনতার গৌরবে গৌরাবান্বিত হয়ে।
তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে তারা তাদের জাতির পিতার মহানুভবতার কথা জানে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দেশপ্রেম। একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার অতীত ইতিহাস, বর্তমান কর্মকাণ্ড আর আগামী প্রজন্মের ভাবনার ওপর। অথচ এ দেশের জনগণ এখন উপলব্ধি করতে পারে দীর্ঘকাল ধরে কিভাবে আমাদের ইতিহাস ও ইতিহাসের সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য অংশ অবহেলিত হয়ে আসছে নানাভাবে। তরুণ সমাজ বুঝতে পেরেছে কিভাবে তারা তাদের পরিবার শিক্ষক ও নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য পেয়ে আসছিল। সবাই তাদের নিজস্ব মতামতের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তরুণ সমাজ নিজস্ব ধ্যাণ-ধারণার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তাদের শিক্ষক বা বাবা-মা আর তাদের প্রভাবিত করতে পারে না। একটি সাবলীল উপস্থাপন এবং মনোমুগ্ধকর টিভি অনুষ্ঠান তাদের সহজেই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। এখানেই তথ্য প্রচার মাধ্যমের প্রকৃত সার্থকতা। বাংলাদেশের একবিংশ শতাব্দীর তরুণ প্রজন্ম আগামী শতকের কাণ্ডারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রার কাজ করবে। তাই এই তরুণ প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তাহলে বাংলার মাটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর যে রক্ত মিশে আছে সেখান থেকে জন্ম হবে হাজারো বঙ্গবন্ধুর। যারা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দেবে অর্থনৈতিক মুক্তি এবং এনে দেবে মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃত স্বাধীনতা আর দূর করবে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও হানাহানি। লেখাটি শেষ করছি একজন খ্যাতিমান লেখকের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে। কখনো তিনি আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন না। তিনি ১৯৯৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান শিরোনামে চট্টগ্রাম বিজয়মেলার স্মারক গ্রন্থে লিখেছেন, আজ থেকে অনেক দিন পরে হয়ত কোনো পিতা তাঁর পুত্রকে বলবেন, জানো খোকা আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। হ
লেখক : আইনজীবী, রাজনীতিক।