৭ জুন স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতার উত্তরণের ভিত্তিপ্রস্তর প্রতিস্থাপন করে। তার ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয় চেতনার পরিপূর্ণ বিকাশ এবং বাম-ডান সব রাজনীতিকে পশ্চাতে ঠেলে ছাত্রলীগের দুর্দমনীয় ও মরণপণ প্রচেষ্টায় আমাদের মুজিব ভাইয়ের একক নেতৃত্বে বিস্তীর্ণ পথ তৈরি হয়। ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এটা সুস্পষ্ট ধারায় প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাকে কেবল তারা শোষণের চারণক্ষেত্র বানায়নি, বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও মননশীলতাকে শুধু অবলুপ্ত করতে চায়নি- কাশ্মিরের জন্য তারা যুদ্ধে লড়ে অথচ পূর্ব-পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত রেখেছিল।
১৯৬৫-এর যুদ্ধে ভারতের কাছে চরম মূল্য দিয়ে আইয়ুব খানকে তাসখন্দ চুক্তির ভিত্তিতে রক্ষা পেতে হয়। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে পিডিএম একটি সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। মুজিব ভাই (তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ওই বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার আঙ্গিকে ৬ দফা প্রস্তাবটি পেশ করেন। আহমদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস, শামসুর রহমান খান (জনসন ভাই) ও রেহমান সোবহান ৬ দফা কর্মসূচিটি প্রণয়ন করে মুজিব ভাইয়ের হাতে তুলে দেন। আইয়ুব খানের কথা এখানে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানকারী সব দলই এটিকে আন্দোলনের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে অক্ষমতা প্রকাশ তো করলোই, বরং তারস্বরে অপপ্রচার শুরু করলো- শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচি প্রদান করে সর্ব পাকিস্তানি আইয়ুব উৎখাতের আন্দোলনকে পিছিয়ে দিল। মুজিব ভাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে ৬ দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অনুমোদন লাভের জন্য দলের বর্ধিত সভায় পেশ করেন। দুঃখজনক হলেও বাস্তব, ওই বর্ধিত সভায়ও সেটা অনুমোদিত হয়নি। এ অবস্থায় ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাককে ডেকে তাদের হাতে ৬ দফার একটি খসড়া তুলে দিয়ে মুজিব ভাই বললেন, এটি মূলত জাতির মুক্তিসনদ। আমি ছাত্রলীগের হাতে এই মুক্তিসনদটি তুলে দিলাম। সেদিন অকুতোভয়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব গ্রহণ না করলে ৬ দফা আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করত, আলোর মুখ আর দেখত না। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এই কর্মসূচিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে থাকে। ৬ দফা প্রদানের পরপরই মুজিব ভাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ডাকেন। কাউন্সিলে ৬ দফা অনুমোদিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে মুজিব ভাই সভাপতি নির্বাচিত হন। তবুও ৬ দফাকে বাংলার মানুষের মননশীলতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়ার মূল শক্তি ও প্রতীতির জায়গা ছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু মুজিব ভাই বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমায় সফর করার সিদ্ধান্ত নেন; সেটিও সফল করার দায়িত্ব নেয় ছাত্রলীগ। কয়েকটি মহকুমা শহরে সভা করার পর জেলাভিত্তিক সভা করার পরই যশোরে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। জামিন পেলে আবার খুলনায় গ্রেপ্তার করা হলো, আবার মুক্তি পেলেন। এভাবে গ্রেপ্তার ও জামিনে আলো-আঁধারের খেলা চলতে চলতে সরকার সিদ্ধান্ত নিল, ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলসে তাকে কারারুদ্ধ করার, যেখানে জামিনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মুজিব ভাই ও তার সহকর্মীসহ রাজবন্দিদের মুক্তি এবং ৬ দফাকে জাতীয় কর্মসূচিতে রূপদানের আঙ্গিকে ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করা হয়। মূল নেতৃত্বের একটি অংশ ৬ দফাকে সমর্থন না করা এবং একটি অংশ কারাগারে থাকায় জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগম আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে কোনোরকমে টিকিয়ে রেখেছিলেন। ইতোমধ্যে মানিক ভাইও ৬ দফার প্রতি তার সমর্থন ও প্রতীতি ঘোষণা করেন (এই সমর্থন আদায়ে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও সৈয়দ মাযহারুল হক বাকীর অদম্য প্রচেষ্টার সঙ্গে আমিও সম্পৃক্ত ছিলাম)। একদিকে ইত্তেফাক, অন্যদিকে ছাত্রলীগ (তখনো আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতৃত্বের মধ্যে ৬ দফার পক্ষে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম হয়নি) ৭ জুনের হরতালের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতৃত্বের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খানসহ ছাত্রলীগের অসংখ্য প্রাক্তন নেতৃত্ব ৭ জুন সফল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এসে অবস্থান নেন। তখন আমাদের সামনে ঘন ঘোর অমানিশা। এনএসএফ থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নসহ ডান-বাম সব সংগঠনই ৬ দফাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের ঘোরতর বিরোধী। আমরা যখন বাঙালির মননশীলতার আঙ্গিকে ৬ দফার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর তখন ডানপন্থীরা তো বটেই, বামপন্থীরাও তারস্বরে চিৎকার করছেন, শেখ মুজিব দেশদ্রোহী, সিআইএর দালাল, ভারতের অনুচর। তার মৃত্যুদণ্ডই তাদের প্রচারণার মুখ্য বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
তখনো শ্রমিক লীগের জন্ম হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল এই যে, শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে ৭ জুন হরতাল পালন অসম্ভব ও অবাস্তব ছিল। খালেদ মোহাম্মদ আলী, কামরুজ্জামান টুকু, ফিরোজ নূন ও আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে তেজগাঁও এলাকাকে হরতালের পক্ষে সংগঠিত করার। তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি রহমত উল্লাহ আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমাদের সিনিয়র নেতারা স্থানীয় প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভূইয়ার (তার বাড়ি নোয়াখালী) সমর্থন কিছুটা আদায় করতে সক্ষম হন। উনি পরোক্ষ সমর্থন দিলেও প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সঙ্গে কোনো মিটিং বা মিছিলে কখনো আসেননি।
৩ জুনে তেজগাঁওয়ের একটি ময়দানে বিশাল(!) জনসমাবেশে কামরুজ্জামান টুকু সাহেব ও আমাকে পাঠানো হয় বক্তৃতা করার জন্য। যথাসময়ে পৌঁছে দেখলাম, সেখানে বিশাল তো দূরে থাক, জনাপাঁচেক লোকও উপস্থিত নেই। কোথায় মঞ্চ, কোথায় মাইক- পুরোটাই যেন একটি কৌতুক। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ একজন যুবক এসে পরিচয় দিল- আমার নাম শহীদুল্লাহ, আমি তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আমার পুরো শরীর তখন রাগে, ক্ষোভে কাঁপছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম ৪/৫ কেজি লজেন্স কিনতে হবে। পথশিশু-কিশোরদের যতটা সম্ভব জড়ো করে একটি খণ্ড মিছিল করে হলেও ৭ জুন হরতালের বিষয়টি জানান দিতে হবে। প্রথমে ১৫/২০ জন ছেলে সমবেত হলো। এর মধ্যে একটি চটপটে ছেলেকে দায়িত্ব দেয়া হলো। সে লজেন্স বিলি করবে এবং যতটা সম্ভব পথপার্শ্ব এবং মহল্লার ছেলেদের মিছিলে সম্পৃক্ত করবে। আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম তেজগাঁও স্টেশন এলাকায় যখন সভার জন্য দাঁড়ালাম ততক্ষণে প্রায় দুই-আড়াই হাজার লোক সেই মিছিলে যুক্ত হয়ে গেছে। একটা হ্যান্ড মাইকও কোথা থেকে যেন জোগাড় হয়ে গেল। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমি প্রবল উত্তেজনা নিয়ে বক্তৃতা করলাম। সেদিনের সেই সভায় আমি নিজে কেঁদেছিলাম, উপস্থিত জাগ্রত জনতাকেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। এই খবর নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছলে তারা শুধু আমার পিঠ চাপড়ালেন না, মূলত নিশ্চিত হলেন ৭ জুন তেজগাঁওয়ে হরতাল পালিত হবেই। পেট্রলবোমা, গাড়িতে আগুন দেয়া তখন আমাদের মননশীলতার চৌহদ্দির মধ্যে ছিল না। যাই হোক, ৬ জুন রাতে আমরা দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে তেজগাঁওয়ের শ্রমিকদের মেসগুলোতে গিয়ে অনুরোধ-উপরোধ করতে থাকলাম। ৩ তারিখ থেকে ৭ তারিখ সকাল পর্যন্ত প্রায় তিন-চারশ লোক প্রতিশ্রæতি দিলেন তারা সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তখন মনু মিয়াকে চিনতাম না। ৭ জুন ভোর থেকে শত চেষ্টা করেও একটা কার্যকর মিছিল বের করা সম্ভব হয়নি। যেটুকু হয়েছিল সেটাকে ঝটিকা মিছিল বলাই বাঞ্ছনীয়। প্রকাশ্যে মিছিল করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমরা ৭ জুন সকালে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী এক্সপ্রেস ট্রেনটির গতি রোধ করে দেব। তখন আমার নিজের মধ্যে একটা নেশা ধরেছিল, যে কোনো উপায়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। সংখ্যায় আমরা ২৫/৩০ জন হব। আমাদের তখন রেলের ফিস-প্লেট তুলে ফেলার অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে প্রচণ্ড আবেগে আমরা রেললাইনের ওপর শুয়ে পড়ে রেলের গতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই আঙ্গিকে আমি অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে অন্য দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে উত্তেজক বক্তৃতা করছিলাম। সে খবর কোনোভাবে পুলিশের কাছে পৌঁছেছিল বিধায় তারা স্বতন্ত্র একটি ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে ১০/১৫ জন পুলিশ পাইলটিং করে আগলে নিয়ে এগুচ্ছিল ওই এলাকাটি পার করে দেয়ার জন্য। আমাদের কাছাকাছি এসে পুলিশ ভর্তি ইঞ্জিনটি থেকে একজন গুলি ছুড়ে (সেদিন নারায়ণগঞ্জ ও সদরঘাটেও গুলি হয়েছিল)। যে দুজনের ঘাড়ে ভর দিয়ে আমি বক্তৃতা করছিলাম তাদের একজন মাটিতে পড়ে গেলেন; তিনিই মনু মিয়া। তাকে সঙ্গে সঙ্গে তেজগাঁয়ের একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। তখনো তিনি জীবিত এবং জ্ঞান রয়েছে। বিন্দুমাত্র চিকিৎসা তার শুরু হয়নি, আমার কোলে মাথা রেখে মনু মিয়া বিড়বিড় করে বললেন, মুজিব ভাইর সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি ৬ দফার জন্য জীবন দিয়ে গেলাম। মুজিব ভাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে এসে রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘মনু মিয়া আমার আলমের কাছে বলে গেছে, সে ৬ দফার জন্য রক্ত দিয়ে গেছে, বাংলার জন্য রক্ত দিয়ে গেছে। আমি এই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়ে গেলাম- তার রক্তের সঙ্গে শেখ মুজিব কখনো বেইমানি করবে না।’ উল্লেখ্য, আমি ডিপিআর আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গেলে সৌভাগ্যক্রমে মুজিব ভাইয়ের পাশের সেলেই আমাকে রাখা হয়। প্রথম সুযোগেই মৃত্যুপথযাত্রী মনু মিয়ার কথাগুলো মুজিব ভাইকে কী আবেগতাড়িত হৃদয়ে বর্ণনা করেছিলাম আজকের নতুন প্রজন্মকে আমি বুঝাতে পারব না। তারই বহিঃপ্রকাশ মুজিব ভাই করেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে।
আমরা মনু মিয়ার লাশ বাঁশের খাটুলিতে করে ঢাকার দিকে মিছিল সহকারে এগোতে লাগলাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য তখন বাঁধ-ভাঙা স্রোতের মতো শ্রমিকরা মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকল। কিছুক্ষণ পরপর আমি মিছিলে বহন করা চেয়ারে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে লাগলাম। সে এক অভূতপূর্ব, অভাবনীয় দৃশ্য! তেজগাঁও রেলগেটের কাছে পুলিশ আমাদের কাছ থেকে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। ধস্তাধস্তিতে আমার শার্ট ছিঁড়ে গেছে, মনু মিয়ার রক্তে আমার শরীর ভিজে গেছে। মনু মিয়ার রক্তাক্ত গেঞ্জিটি আমি হাতছাড়া হতে দেইনি। তেজগাঁও রেলগেটের কাছে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করল। জনা-পঞ্চাশেক পুলিশ- অন্যদিকে বাঁধ-ভাঙা জোয়ারের মতো মানুষ। তারা গুলিও ছুড়তে পারছে না, মিছিলের গতিও রোধ করতে পারছে না। শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে ওই মিছিলের জনতাকে লক্ষ্য করে আমি আবার যখন বক্তৃতা শুরু করেছি তখন দেখি, বহু দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ছবি তুলছেন। ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন অবস্থাটি অবলোকন করছেন, পাশে আফতাব আহমেদ ছবি তুলছেন। ইত্তেফাক অনেক বছর ৭ জুনে মিছিলের অগ্রভাগে গেঞ্জি পরা আমার সেই ছবিটি ছেপেছিল। তার কয়েকদিন পর আমি কারারুদ্ধ হয়ে গেলাম ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস-এ। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আমি সারা বাংলাদেশের প্রতিটি বিভিন্ন প্রান্তে বিশাল বিশাল জনসভায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে মনু মিয়ার আত্মত্যাগের কথা বর্ণনা করতাম। আমি আজো বলি, আমি বক্তৃতা করতাম না, আমার বাগ্মিতা ছিল না। আমি চারণ কবির মতো, বাউলের মতো- মনু মিয়ার আত্মত্যাগের পাঁচালী গাইতাম। ৭ জুনকে বর্ণনা করতাম স্বাধিকার হতে স্বাধীনতায় উত্তরণের সোপান হিসেবে। সন্তানহারা জননী মনু মিয়ার মায়ের ফরিয়াদ এ বাউলের কণ্ঠে যখন বাজতো, তখন আমি নিজেও চোখের জলে বুক ভাসাতাম। সব সভায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার রোল উঠত। আজ জীবন-সায়াহ্নে আত্মগøানিতে ভরা অনুভূতি নিয়ে বারবার মনে হয়, সেদিনের বক্তৃতার সবটুকুই আজ মিছে হয়ে গেছে। শোষণ ও বঞ্চনার গণতন্ত্র-বিবর্জিত রাষ্ট্র সব ত্যাগকে শুধু ম্রিয়মাণই করেনি, মনু মিয়াসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের সব ত্যাগী কি আজকের এই বাংলাদেশটি চেয়েছিল? এর উত্তর খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব আমি নতুন প্রজন্মের কাঁধে তুলে দিলাম।
নূরে আলম সিদ্দিকী : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা।