বাঙালি জাতির ‘ম্যাগনা কার্টা’ ছয় দফা


ইংল্যান্ডের ‘ম্যাগনা কার্টা’ যেমন বিশ্বকে পরিবর্তিত করেছে, বাংলাদেশের ‘ম্যাগনা কার্টা’ ‘ছয়দফা’ তেমনি, অন্ততপক্ষে দক্ষিণ এশিয়াকে পরিবর্তিত করেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে উত্থাপিত বাঙালিদের দাবিনামা সংবলিত একটি কর্মসূচি ছয়দফাকে, ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ইংরেজ ব্যারনদের অধিকার সংবলিত দলিল ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামে অভিহিত করার বিষয়টি মূলত প্রতীকী। এর দ্বারা বুঝানো হচ্ছে ইংল্যান্ডে রাজার নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত করে নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য ‘ম্যাগনা কার্টা’ দ্বারা যা সাধিত হয়েছে, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচি দিয়ে পাকিস্তানি শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত করে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের’ মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালিদের ওপর শাসন-শোষণ সংক্রান্ত পাকিস্তানিদের ‘নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতা’ ছয়দফা দ্বারা বাধাগ্রস্ত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে ছয়দফার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ১৯৬৬ সালে ঘোষিত ছয়দফার প্রতি বাঙালিদের সমর্থন নিশ্চিত করা। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জন। তবে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যেই বিষয়টি সীমিত না থেকে তা ‘মুক্তির’ সংগ্রামের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। রাজনৈতিক কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ৭ মার্চে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের মানুষ ‘মুক্তি ও স্বাধীনতার’ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগ ও প্রায় চার লাখ বাঙালি মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছিল।

১৯৬৬ সালের ৭ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছয়দফা দাবিতে হরতাল পালন করেছিল। জিন্নাহর ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন ‘দুই অর্থনীতি’ ভিত্তিক ছয়দফা কর্মসূচি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তান আলাদাভাবে গড়ে ওঠার কারণে দুই অংশে দুটি আলাদা অর্থনীতি এবং দুটি আলাদা রাজনৈতিক সত্তা গড়ে উঠেছিল। ১৯৬০-এর দিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনীতির বৈষম্যমূলক সম্পর্কের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট বাঙালি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি চেতনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল। ধর্মের নামে বাঙালিদের ওপর শাসন ও শোষণের কারণে পাকিস্তানের ভেতরে, পূর্ব ও পশ্চিম অংশের আলাদা দুই অর্থনীতি ও আলাদা দুই রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ফলে পাকিস্তানি জাতীয়তার বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা ধর্মভিত্তিক ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ থেকে ভিন্ন ধরনের ছিল। বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ নস্যাৎ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে এক বছরে ৪৯৪৬টি রাজনৈতিক দাঙ্গা হয়েছিল, একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে এক বছরে হয়েছিল ১০৫৩টি দাঙ্গা।

এ ধরনের অভ্যন্তরীণ উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৬৫ সালে কাশ্মিরের বিবাদপূর্ণ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান, ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এ সময় সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের মুখে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য শুধু এক ডিভিশন পদাতিক এবং এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধ বিমান ডেপ্লয় করা হয়েছিল। সতের দিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান বায়ু ও সমুদ্র উভয় পথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। যদিও ভারত পূর্বাঞ্চলে একটি ফ্রন্ট খোলা থেকে বিরত ছিল, তবে সম্ভাব্য ভারতীয় হামলার ব্যাপারে বাঙালিরা শঙ্কিত ছিল। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছিল, যা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিল। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উক্তি জানা যায় অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের ‘ন্যাশনাল ইন্টিগরেশন এন্ড পলিটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট ইন পাকিস্তান’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধ থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘যুদ্ধের পরে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার সময় উপস্থিত হয়।’

এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছয়দফা কর্মসূচি তুলে ধরেন। ছয়দফা দাবির ইতিহাস হচ্ছে পাকিস্তানি ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমাপনী পর্বের সূচনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত বিরোধী দলের এক কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। তবে কনভেনশনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয়দফা নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে দেননি। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৬৫ সালের সেপ্টেবর মাসে ভারতে পশ্চিম ফ্রন্টে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলের এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যুদ্ধটি যদিও অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল তথাপি ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের ভূখণ্ডের বড় একটি মূল্যবান অংশ হারিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগ এবং পরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকের মধ্য দিয়ে এটি মীমাংসিত হয়। এখানে দুই বিবদমান প্রতিবেশী সম্মত হয় যে উভয় দেশ তাদের দখলিকৃত ভূখণ্ড থেকে সৈন্য অপসারণ করবে এবং ভবিষ্যতে সব প্রকার সমস্যাগুলো দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং ক‚টনৈতিক দেন-দরবারের মাধ্যমে সমাধান করা হবে।

বিরোধী দলগুলোর লাহোর কনভেনশনে উত্থাপিত হলেও সেখানে ছয়দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে না দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিমান বন্দরে সংবাদ সম্মেলন করে ছয়দফা সম্পর্কে বিস্তারিত জনসমক্ষে তুলে ধরেন। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়। ছয়দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কাউন্সিলে ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেন। ছয়দফা কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুসারী, বর্তমান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “ছয়দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর।”

ছয়দফা দাবি কালক্রমে ব্যাপক বিস্তৃত আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়েছিল। ছয়দফা কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ছয়দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা পরবর্তীকালে ছয়দফার চূড়ান্ত পরিণতি একদফা তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন করে।

ছয়দফা পরিকল্পনাটি বঙ্গবন্ধুকে এবং আওয়ামী লীগের বেশ কিছু সংখ্যক বাঙালি নেতাকর্মীকে নবাবজাদা নসরুল্লা খানের নেতৃত্বাধীন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি মুখোমুখি সংঘাতমূলক পথে নিয়ে যায়। এটি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রচণ্ড ক্রোধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তানের এই লৌহশাসক আইয়ুব খান প্রকাশ্যে ছয়দফার প্রবক্তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আইয়ুব শাহী এবং তার সহযোগীরা মনে করতেন যে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তানকে ভেঙে এর পূর্ব অংশকে দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের যে ছয়দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিল তা ছিল নিম্নরূপ :

এক নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা; সংসদীয় পদ্ধতির সরকার; সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন। দুই নম্বর দফায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে দুটি বিষয় ন্যস্ত থাকার কথা বলা হয়েছিল, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র; অন্যসব বিষয়গুলো ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে। তিন নম্বর দফায় মুদ্রানীতির কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন, অথবা একক মুদ্রা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে সাংবিধানিক বিধান রাখতে হবে। পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে। চার নম্বর দফায় যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিটগুলোর হাতে করারোপ ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রের হাতে এরকম কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় বা চাহিদা মেটানোর জন্য প্রদেশগুলোর করের একটা অংশ পাবে। পাঁচ নম্বর দফায় দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব রাখা; এ দেশের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা এ দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে; কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন দুই অঞ্চল কর্তৃক সমান হারে অথবা নির্ধারণযোগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চল কর্তৃক মেটানো হবে; দেশজ পণ্য দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে অবাধে চলাচল করবে; সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিটের সরকারগুলো বিদেশে বাণিজ্য মিশন খোলা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করবে। ছয় নম্বর দফায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের কথা বলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত ছয়দফা অতি দ্রুত বাঙালিদের মুক্তি সনদ হিসেবে (পূর্ব) বাঙালি জনগণের প্রাণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

১৯৬৬ সালের মার্চ এবং মে মাসে বঙ্গবন্ধু এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং আরো অনেকে ছয়দফার পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষ্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী সফর করেছেন। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ছয়দফার পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখে আইয়ুবের তোষামোদে এক অনুগত গভর্নর আব্দুল মোনোয়েম খান আওয়ামী লীগ নেতাদের কারান্তরীণ করার হুমকি প্রদান করেন। ওই বছরের ৮ মে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ সহযোগীদেরও কারান্তরীণ করা হয়েছিল। এ সময় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন তখন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ (ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্তানের) সদস্য। সংগ্রামার্থে সজ্জিত আওয়ামী লীগ ছয়দফার পক্ষে সমর্থন সংগঠিত করা এবং বন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করে। মিজানুর রহমান চৌধুরী এ সময় খুব দৃশ্যমান এবং প্রসিদ্ধ ভূমিকা পালন করেন, মনোবল ভেঙে পড়া একটি দলকে উজ্জীবিত করে তিনি হরতালের জন্য প্রস্তুত করান। একই সঙ্গে তিনি এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলীসহ আওয়ামী লীগের এমএনএ-বৃন্দ আওয়ামী লীগের ওপর সরকারি নিপীড়নের কথা আইন সভায় উত্থাপন করেন। আর এভাবে ছয়দফা দাবিকে সমগ্র (পূর্ব) বাঙালিদের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। অপরদিকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারী সরকার পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপর হরতালের খবর না ছাপানোর আদেশ দেন। গণমাধ্যমের ওপর সেন্সারশিপ সত্ত্বেও, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী হরতাল পালিত হয়। হরতাল পালনকারীদের ওপর পুলিশ এবং ইপিআরের গুলি বর্ষণের ফলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী এবং দেশের অন্যান্য স্থানে আন্দোলনরত দশজন শহীদ হন। পরের দিন ৮ জুন সংবাদ পত্রগুলোতে আগের দিনের ঘটনা সম্বন্ধে সরকারি ভাষ্যই কেবল প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে ছিল রাজপথে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সহিংসতার কথা।

এভাবে ইতিহাস পুনঃসংজ্ঞায়িত করার কাজ শুরু হয়। (পূর্ব) বাঙালি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সংবলিত বাংলাদেশের ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলনের ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ‘জাতীয় চেতনা’ সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের যৌথ মানসিকতায় নিশ্চিত এবং দ্রুততার সঙ্গে জাতীয়তাবাদের চেতনায় বাঙালিরা নিজেদের পুনরায় আবিষ্কার করে। ছয়দফা আন্দোলনের পথ ধরে এরপরে আসে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর নির্বাচন। ১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের প্রতি এ দেশের জনগণ তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। পাকিস্তানি ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয় পরিচিতি উদ্ভব এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছয়দফা অন্যতম একটি মাইলফলক। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পরে আসে ‘জাতীয় পরিচিতি’ ও ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মদান, প্রায় তিন লাখ বাঙালি মা-বোনের ইজ্জত এবং প্রায় কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্যের আত্মাহুতি এবং সমগ্র বাংলাদেশকে একটি ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়েই খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করে। ফলে বাংলাদেশের অগ্রগতি থমকে যায়। এরপর দীর্ঘ ছয় বছর পরে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্র্যাইব্যুনাল গঠন, চল্লিশ বছর পর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পাচ্ছে। তবে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির জন্য তথা ‘ভিশন ২০২১’ এবং ‘ভিশন ২০৪১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আরো অনেক দূর যেতে হবে। ২৯ মে, ২০১৫ তারিখে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে দেয়া গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে দেশরতœ শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য আরো অনেক পথ চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। তার বক্তব্যে স্পষ্টতই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৬৬ সালে সর্ব প্রথম ঘোষিত বাঙালির ‘ম্যাগনা কার্টা’ ছয়দফা কর্মসূচির জন্য তথা বাঙালির মুক্তির জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করার দৃঢ় প্রত্যয় লক্ষ করা যায়।

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1782-1.png