বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ এপ্রিল একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের অগে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার ২২ দিন পর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয়। শত্রুর হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে এই সরকার গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ রাতে ভারতের শিলিগুড়ির অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারিত হয়। ওই ভাষণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং কী পরিস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এর বিস্তারিত বর্ণনাদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদের নিত্যসঙ্গী, বন্ধু ও উপদেষ্টা ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী তাজউদ্দীন আহমদের ঐকান্তিক চেষ্টায়ই এত দ্রুততার সঙ্গে প্রবাসী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। ওই সময় আমেরিকা এবং মোশতাক গং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু ধৈর্যের প্রতীক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্বে বালাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ইতিহাস একদিন লিখবে, একাত্তরে তাজউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বে ছিলেন বলেই, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাঙালি জাতি সেদিন বিজয় অর্জন করেছিল।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক চক্র নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে থাকে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মধ্যরাতে পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই বাঙালি জাতির নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা রাতারাতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তি সংগ্রামের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার বরণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করেন। ২৫ মার্চ রাতে অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকে তিনি অন্য সবাইকে নিরাপদে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন আহমদ লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং ঘাড়ে একটি রাইফেল নিয়ে নিজের বাসা থেকে বের হন। আরহাম সিদ্দিকীর মাধ্যমে আগেই তিনি এই রাইফেল সংগ্রহ করেন। এরই মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ রাইফেল প্রশিক্ষণও গ্রহণ করে রেখেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও আমীর-উল-ইসলাম ২৫ মার্চ রাতে এক বাড়িতে একত্র হওয়ার কথা ছিল। এই তিনজন ১৯৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে সব কর্মসূচি প্রণয়ন করতেন। ড. কামাল হোসেন শেষ পর্যন্ত ওই রাতে নির্ধারিত বাড়িতে একত্রিত হননি। পরে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকেন। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি একই বিমানে স্বদেশে ফিরে আসেন। ২৫ মার্চ রাতে ড. কামাল হোসেন কি কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে একত্রিত হননি- এই বিষয়টি আজো পরিষ্কার হয়নি। ড. কামাল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে স্বেচ্ছায় কারাবন্দিত্ব গ্রহণ করেছিলেন কি না, গত চার দশকে একবারো তিনি এই বিষয়ে মুখ খোলেননি। দুরাত একদিন গোলাগুলির মধ্যে আটক থেকে ২৭ মার্চ তাজউদ্দীন ও আমীর-উল-ইসলাম ঢাকা ছাড়েন। এ দুজন নানা জনপদ ঘুরে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। ৩০ মার্চ বিকেলে তারা মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমদকে নিয়ে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন।
ভারতীয় বিএসএফের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গোলক মজুমদারের সহায়তায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর সীমান্ত অতিক্রম করে ওই রাতে কলকাতা পৌঁছেন। রাতেই একটি সামরিক বিমানে তারা দিল্লি চলে যান। প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দৃশ্যত বাংলাদেশের এটাই ছিল প্রথম যোগাযোগ। তবে ভারত সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের একটা পূর্ব যোগাযোগ ছিল। তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের অন্যতম মঈদুল হাসান তার ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে এই তথ্য উল্লেখ করেছেন। ওই গ্রন্থে রয়েছে, শেখ মুজিবের নির্দেশে ১৯৭১-এর ৬ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার তৎকালীন ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কেসি সেনগুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। দুর্যোগে পড়লে ভারত বাংলাদেশকে কিভাবে কতটুকু সাহায্য-সহায়তা করবে, ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তা নিয়েই আলোচনা হয়। এই বৈঠকের পর কেসি সেনগুপ্ত বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য দিল্লি যান। ঢাকা ফিরে কেসি সেনগুপ্ত ১৭ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদকে আশ্বস্ত করেন যে, পাকিস্তান সামরিক জান্তা আঘাত হানলে ভারত যথাসম্ভব সাহায্য-সহায়তা করবে। ভারতীয় সাহায্যের রূপরেখা কি হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ২৪ মার্চ মিলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই বৈঠকটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এই বৈঠকটি না হওয়ার কারণে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ ও ভারতের মাটিতে মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ বেস (ইধংব) গঠনের বিষয়টি আর স্থির হতে পারেনি।
৩০ মার্চ ১৯৭১ রাতে দিল্লি পৌঁছার পর তাজউদ্দীন আহমদ ৪ এপ্রিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভারতরতœ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে কোনো সহযোগী ছিল না। সাক্ষাৎ শেষে সহকর্মী আমীর-উল-ইসলামকে জানান, মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারী করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের গাড়ি পৌঁছার পর তাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্টাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস গান্ধী প্রশ্ন করেন- ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অলরাইট?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। ২৫ মার্চের পরে তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়নি।’ তাজউদ্দীন আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আগত শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার আমাদের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাবে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা কোনোভাবেই সফল হতে দেয়া যাবে না।’ তিনি জানান, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম, মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। সব গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহযোগিতা আমরা চাই।’ মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
২৫ মার্চে পাকিস্তানি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তানি আঘাতের পর আওয়ামী লীগের নেতারা একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। কে জীবিত আছেন, কে নেই, তাও তারা জানেন না। বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি কি অবস্থায় রয়েছেন? তাও কারো জানা ছিল না। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন নাকি পাকিস্তানি দস্যুরা তাঁকে হত্যা করেছে, এ কথাও কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো, মুক্তি সংগ্রামের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন শত্রুর হেফাজতে বন্দি। তাজউদ্দীন উপলব্ধি করেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জরুরিভাবে একটি সরকার গঠন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি বেতার স্টেশনের।’ কিন্তু ২৫ মার্চের আঘাতের ১১/১২ দিন পরও কোনো নেতার হদিস মিলছিল না। একমাত্র লোক আমীর-উল-ইসলাম, যার সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতে পারেন। তবে যে কোনো কারণেই হোক, বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের পর- পরবর্তী সরকারের গঠন প্রণালী নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুও দিয়ে যাননি।
অন্য সব প্রধান নেতাদের অনুপস্থিতিতে কে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, উপরের সারির নেতারা কে কোথায় রয়েছেন, কেউ গ্রেপ্তার বা নিহত হয়েছেন কিনা, এ সব কোনো কিছুই তাজউদ্দীন আহমদের তখনো জানা ছিল না। প্রথম সাক্ষাতের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে মতবিনিময় করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপ্রধান করে তাজউদ্দীন নিজেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। শত্রুর হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তখনো দেখা মিলেনি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি করাটাও কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল না। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের কথা বেতারের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জেনে যায়। ১০ এপ্রিল প্রচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণও রেকর্ড করা হয়। ইতোমধ্যে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে যুব ও ছাত্র নেতারাসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতা পৌঁছে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়াসহ সরকার গঠনের ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পূর্বাপর পরিস্থিতি বর্ণনা করে এক গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল হিসেবেই বিবেচিত হয়। ১০ এপ্রিলের পর প্রথমে এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান, তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান এবং আরো পরে খন্দকার মোশতাকসহ অন্য নেতারা কলকাতা পৌঁছেন। মোশতাক ও যুবনেতাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ আরো অনেকের সমর্থন ও সহযোগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষিত সরকার বহাল থেকে যায়।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মাটিতে মেহেরপুরের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি অমূল্য দলিল হয়ে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিকভাবে প্রবাসী সরকারের রাজধানীর নামকরণ করেন মুজিবনগর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক, কয়েকজন যুব ও ছাত্রনেতাসহ বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতার অসহযোগিতা এবং বিরোধিতার মুখেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মোশতাক গং আমেরিকার চক্রান্তে একবার ধুয়া তোলেন, ‘স্বাধীনতা পেলে শেখ মুজিবকে জীবিত পাওয়া যাবে না, আর শেখ মুজিবকে পেলে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না।’ ওই কঠিন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএদের এক যৌথ সভায় তাজউদ্দীন আহমদ তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়ে বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু দুটিই চাই। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে চাই না।’ প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এতোটাই প্রাণস্পর্শী ও যুক্তিযুক্ত ছিল যে, কয়েকজন চক্রান্তকারী ছাড়া সভায় উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে তাজউদ্দীনের সমর্থনে স্লোগান দিতে থাকেন।
তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সুযোগ্য, দূরদর্শী ও সফল নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মোশতাক ও উচ্চাভিলাষী চক্রান্তকারীরা অবশেষে সফল হলো। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭৪-এর ২৬ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা নিশ্চয়ই একদিন একমত হবেন, ভারতের গান্ধী-নেহরু, চীনের মাও-চৌএন লাইয়ের মতো আরেক সফল জুটি ছিলেন বাংলাদেশের মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি। ওই দুই জুটির মতো মুজিব-তাজউদ্দীন সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণœ থাকলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেমন এত তাড়াতাড়ি সংঘটিত হতো না, একই সঙ্গে বাংলাদেশের চেহারাও আজকের মতো এমন বিবর্ণ হতো না। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির গত সাড়ে চার দশকে স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরাই বারবার বিজয়ী হয়েছে আর চক্রান্তের শিকার হয়েছেন জাতীয় নেতারা, কয়েকজন সেক্টর কমান্ডারসহ মুক্তিযোদ্ধারা।
তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, গত ৪৪ বছরের সব সরকার এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও মুজিবনগর সরকার এবং ওই সরকারের নেতাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আরো পরিতাপ ও বেদনার বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে একটিবারের জন্যও মুজিবনগর যাননি। তবে কেউ স্মরণ করুন আর না করুন, স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে গেলে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু মুজিবের পরে অবধারিতভাবেই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রী মনসুর-কামরুজ্জামানের নাম আসবে। মুজিবনগর দিবসে স্বাধীনতার মহানয়ক ও নায়কদের পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
মোহাম্মদ শাহজাহান : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক।