বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সুপরিকল্পিতভাবেই স্বদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক সরকার বহাল থাকা সত্ত্বেও ১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিচালিত হয় বিরোধীদলীয় নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে। কারো কারো মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ওই দিন ২৮ তারিখের মধ্যে কর্মচারীদের বেতন দেয়ার নির্দেশ দেন শেখ মুজিব। তিনি বলেন, ‘খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো, কেউ দিবে না।’ প্রকৃতপক্ষে ২৬ মার্চের আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ৯ মাসের যুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাঙালি বিজয় অর্জন করে।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে এল ১৯৭০-এর নির্বাচন। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিলেন বঙ্গবন্ধু। এরই মধ্যে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটল। ঘূর্ণি-উপদ্রুত অঞ্চল সফর শেষে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, ‘মুক্তির জন্য প্রয়োজনে ৫ লাখ মানুষ জীবন দান করবে।’ এই সংবাদ সম্মেলনে একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, মুক্তি বলতে কি আপনি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার কথা বলতে চাইছেন? শেখ মুজিব অতিদ্রুত উত্তর দেন, ‘ঘড়ঃ ুবঃ’. এখানেই শেখ মুজিবের কৃতিত্ব। স্বাধীনতা তিনি চান না, এ কথা বলেননি। তিনি বললেন, এখনই নয়। মুজিব জানতেন, স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত করতে হবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামকরণও করেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু ও তার অনুসারীরা পূর্ব পাকিস্তানকে বলতেন পূর্ববাংলা। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ হতে এ অঞ্চলের নাম হবে বাংলাদেশ।’
’৭০-এর ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ববাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পায়। আর পূর্ববাংলায় অর্থাৎ প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮ আসন। ’৭০-এর নির্বাচনে মুজিব-ঝড়ে অন্য সব রাজনৈতিক দল ও নেতা কুপোকাত হলো। নির্বাচনে প্রমাণ হলো পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার একমাত্র অধিকার রয়েছে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের। নির্বাচনের পর ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ করান বঙ্গবন্ধু। শপথকালে বাংলার মানুষের কাছে ওয়াদা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলার দাবি-দাওয়ার সঙ্গে কোনো আপস করলে আপনারা আমাদের জ্যান্ত কবর দেবেন। নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে এসে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। নির্বাচনের পর পাকিস্তান সামরিক চক্র এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা ভুট্টো জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত শুরু করেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানিরাই শাসন করেছে। পূর্ববাংলার শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটা তারা মেনে নিতে পারলেন না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে গড়িমসি শুরু হলো। অবশেষে নির্বাচনের ৩ মাস পরে ৩ মার্চ ঢাকায় অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কয়েকজন সদস্য ঢাকায় অধিবেশনে যোগ দিতে আসলেন। এরই মধ্যে ’৭১-এর পয়লা মার্চ সোমবার ১টা ৫ মিনিটে এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ইয়াহিয়ার ঘোষণা মেনে নিল না বাংলাদেশ। গর্জে উঠল বাঙালি। পহেলা মার্চ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ বাংলাদেশের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ল। স্লোগান উঠল- ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা- মানি না, মানি না’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা’। এসব স্লোগানে রাজপথ মুখরিত হলো। সে সময় আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক চলছিল পূর্বাণী হোটেলে। হাজার হাজার মানুষ নেতার নির্দেশের জন্য মিছিল করে পূর্বাণী হোটেল চত্বরে জমায়েত হলো। অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় তীব্র প্রতিবাদ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম চলবে। বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে ছাত্রলীগ। সংসদীয় দলের নেতা বা জাতীয় নেতা হিসেবে অনেক কথা বঙ্গবন্ধু বলতে পারতেন না বা অনেক কর্মসূচি আওয়ামী লীগের পক্ষে পালন করা সম্ভব হতো না। ছাত্রলীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে সে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে।
২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্রলীগের সভায় প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখা গেল। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সমাবেশে হাজির হলেন বঙ্গবন্ধু। মঞ্চে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। সভায় বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ঘোষণা এবং কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে পল্টনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। সভায় আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যদি নাও থাকি তাহলেও সংগ্রাম চলবে।’
৩ মার্চ থেকে সারাদেশে ৬টা-২টা হরতাল শুরু হলো। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আর দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম।’। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের ভাষণ ছিল প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলো। পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ- এই ২৫ দিন পূর্ববাংলায় সামরিক সরকারের কোনো কতৃত্ব ছিল না। সে সময় শেখ মুজিবের কথাই ছিল আইন।
এখানে দুয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ৭ মার্চ ঢাকায় বেতারকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিল বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ তারা বেতার থেকে সরাসরি প্রচার করবেন। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ভাষণ প্রচারে বাধা দিল। ঢাকা বেতারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতার ভবন ত্যাগ করে বের হয়ে এলেন। ঢাকা বেতার বন্ধ হয়ে গেল। পরেরদিন ৮ মার্চ সকাল সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতে দেয়া হলো। বেতারকর্মীরা কাজে যোগ দিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের নয়া গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খান ৭ মার্চ ঢাকা এলেন। ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী গভর্নরকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকার করলেন। এভাবে পিয়ন থেকে প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনে চলতে লাগলেন। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করলেন। এই নির্দেশ মোতাবেক দেশ চলতে থাকে। ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হলো, ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসতে দেয়া হবে না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ব্যারিকেড তুলে নেয়া হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অতিথি হিসেবে ঘোষণা করলেন।
আরেকটা ঘটনা ড. কামাল হোসেনের মুখে শোনা। অসহযোগের দিনগুলোতে তাজউদ্দীন আহমেদ, ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম- এই তিনজন বঙ্গবন্ধুর প্রতিদিনের কর্মসূচি প্রণয়ন করতেন। ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা আসার পর প্রেসিডেন্ট ভবনে বাঙালি কর্মচারীরা রান্নাবান্না বন্ধ করে দিলেন। প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাবুর্চিরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে রান্না করে খাওয়াতে সম্মত হন।
সে সময় শেখ মুজিব হয়ে গেলেন পূর্ববাংলার একমাত্র অধিপতি। জনগণনন্দিত নেতা। ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া টেলিফোনে শেখ মুজিবকে অনুনয়-বিনয় করে বলেন, তিনি যেন ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে স্বাধীনতা ঘোষণা না করেন। ৭ মার্চ সকালে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতা ঘোষণা না করার অনুরোধ জানান। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এটা বলতেও ভুল করেননি, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করবে না।
পূর্ববাংলায় সামরিক শাসনের পরিবর্তে মুজিবের শাসন প্রবর্তিত হলো। ঢাকায় সে সময় কর্মরত পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ তার শাসনকে সংহত করার জন্য একের পর এক নির্দেশ জারি করে চলল। এসব নির্দেশ সমাজের সর্বস্তরে তথা সরকারি অফিস-আদালত, কল-কারখানা, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রেই মেনে চলা হলো। এমনকি সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিও এবং টেলিভিশন মুজিবের আদেশ মেনে চলল। সারা প্রদেশকে গ্রাস করল মুজিবের শাসন। কিন্তু গ্রাস করতে পারল না প্রদেশের ৭টি সেনানিবাসকে।’
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান আসগর খান ’৭১-এর মার্চে ঢাকায় এসেছিলেন। আসগর খান বলেছেন, ‘২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে পূর্ব পাকিস্তনে সেনানিবাসগুলো ছাড়া সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা গেছে।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ববাংলার অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য দেখে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা ওয়ালী খান বলেছিলেন, ‘মুজিবের অসহযোগ আন্দোলন, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চেয়ে বেশি সফল।’
একটি দেশে সরকার থাকা অবস্থায় বিরোধী দলের কথায় সে দেশ চলার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে নেই। কিন্তু একাত্তরের মার্চের ২৫ দিন সামরিক সরকারের কোনো নির্দেশ পূর্ববাংলার মানুষ শোনেনি বা মানেনি। শেখ মুজিব ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে যে নির্দেশ দিয়েছেন- বাংলার মানুষ বিনাবাক্যে তা মেনে নিয়েছেন। ’৭১-এর ১২ মার্চ লন্ডনের ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। ইতোমধ্যে তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বাড়িকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানের অনুকরণে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং অন্য মহলের লোকজন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্টে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কতৃত্ব রয়েছে।’ সে সময় একটি কথা প্রচলিত ছিল- “অষষ ৎড়ধফং ষবধফ ঃড় ৩২ ঘড়.”
১৫ মার্চ ১৯৭১, লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয় : ‘সশস্ত্র পাহারায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌঁছানোর কথা। পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুরের শাসন চলছে, তাঁর নির্দেশে সবকিছু হচ্ছে।’
নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক পেগি ডারডিন মার্চের সেই উন্মাতাল দিনগুলোর বর্ণনায় লিখেছেন, ‘একজন রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশাবলী জনগণ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে মেনে নিয়েছে। এই নির্দেশাবলী প্রয়োগের জন্য এই নেতার কোনো বাহিনী বা প্রশাসন ছিল না। এই স্বতঃস্ফ‚র্ত নির্দেশ মানার পেছনে ছিল পারস্পরিক বিশ্বাস এবং বাঙালি জাতির ও নেতার মধ্যে একটি অলিখিত অথচ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠার অঙ্গীকার।’ (সূত্র : সোহরাব হাসানের ‘মুজিব-ভুট্টো-মুক্তিযুদ্ধ’, পৃষ্ঠা ১৭৫)
৮ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছে : ‘মনে হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’ ১৫ মার্চ বিখ্যাত ‘টাইম’ সাময়িকী লিখে, ‘আসন্ন বিভক্তির অর্থাৎ পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণত করার পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন, তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিব। গত সপ্তাহে ঢাকায় ‘টাইম’-এর সংবাদদাতা ডন কগিনকে মুজিব বলেন, ‘পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোনো আশা নেই’।’
’৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের আলোচনা টিমের অন্যতম সদস্য অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান যথার্থই বলেছেন, ‘আমার ধারণায় ১৯৭১ সালের পয়লা থেকে ২৫ মার্চ এই পঁচিশ দিনই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল। যার ফলে, কখন স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল বা কে তা ঘোষণা করেছিলেন এই প্রশ্নটি অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক এবং ঐতিহাসিক বাস্তবতা অগ্রাহ্য করার যে মূঢ়তা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে গ্রাস করেছে এটা তারই আরেকটি দৃষ্টান্ত। গোটা মার্চ মাসজুড়ে বঙ্গবন্ধু যা এবং যতটা সাধন করেছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনো ইতিহাসে অন্য কোনো নেতাই সেরকমটি করতে পারেননি। ইডেন বিল্ডিং পরিণত হয়েছে এক অপহৃত অসাড় সমাধিতে- সেখানে শেখ মুজিবের বাসভবন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে প্রশাসনে জেগে উঠেছে এক প্রাণচাঞ্চল্যে।’
মোহাম্মদ শাহজাহান : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা।