১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খাঁ, ঘসেটি বেগম, মীর মদন, রায় বল্লভ, জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ আর ব্রিটিশ বেনিয়া লর্ড ক্লাইভ ও তার সহযোগীদের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেই বাংলার রাজনীতির ভাগ্যাকাশে একটি নতুন সূর্যের আবির্ভাব হয়েছিল ৬৬ বছর আগে। হ্যাঁ, ৬৭ বছরে পদার্পন করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বয়সে অভিজ্ঞ হলেও কাজে-কর্মের ক্ষিপ্রতায় এখনো একেবারেই তরুণ ও সজীব এই দল ও দলের নেতাকর্মীরা।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন এর সভাপতি ছিলেন মাওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। শেখ মুজিব হন যুগ্ম সম্পাদক। যদিও তিনি দলটি প্রতিষ্ঠার সময় জেলে ছিলেন। আর নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনসহ ৪২ দফার আন্দোলন শুরু করে। প্রতিষ্ঠার ৮ বছরের মাথায় ভাঙন ধরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে। ১৯৫৭ সালের টাঙ্গাইলে দলের সম্মেলনে ভাসানী প্রকাশ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি ও বাগদাদ চুক্তির বিরোধিতা করেন। ১৮ মার্চ ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ন্যাপ গঠন করেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এদিকে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের রাজধানীর বৈরুতের এক হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা গেলে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয় দলটি। শেখ মুজিব প্রিয় নেতাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন।
১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে শেখ মুজিব ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ দফার মূল দাবি ছিল পাকিস্তান হবে ফেডারেল রাষ্ট্র এবং প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। এদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ৬ দফা ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কঠোর হুমকি দেন। ১৯৬৬ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ৬ দফাকে দলের ইশতেহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কাউন্সিলে শেখ মুজিবকে সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সফর শুরু করেন। সরকারও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ৭ জুন দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে আওয়ামী লীগ।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। প্রতিবাদে সর্বস্তরের জনতা দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এদিকে, স্বৈরাচার আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অন্যান্য দলের মতো জোরালো ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আওয়ামী লীগের ৬ দফা অন্তর্ভূক্ত করে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ১১ দফা দাবি পেশ করে। বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা ও অফিস আদালত। ব্যাহত হয় উৎপাদন। ২২ ফেব্রুয়ারি রেডিওতে ঘোষণা করা হয় কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অর্থাৎ বাংলার জনগণের বন্ধু উপাধি দেন। আন্দোলনের তীব্রতায় বাধ্য হয়ে ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন আইয়ুব খান। পকিস্তানের দায়িত্ব নেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
১৯৭০ এর নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি পায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে মুক্তিকামী বাঙালির প্রতি আহ্বান জানান। এরপর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা পাই সবুজের বুকে টকটকে লাল সূর্যখচিত পতাকার দেশ, বাংলাদেশ। পাকিস্তােেনর কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ২৯২টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যান বঙ্গবন্ধু।
১৫ আগস্ট ইতিহাসের নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন জাতির জনক ও তাঁর পরিবার। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে বাবার হাতে প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেন। এরপর স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ৮ দল ও ১৫ দলের নেত্রী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ পায় ৭৬টি আসন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হলেও ’৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। জননেত্রী শেখ হাসিনা হন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে, সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি আইন জারি করা হয়। সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় দলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন সংস্কারপন্থীরা। বিএনপির নেত্রীর মতো শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বাদ দিতে উদ্যোগী হন এই সংস্কারপন্থীরা। দলের অনেক সিনিয়র নেতা ভেতরে ভেতরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও কিংস পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে হাত মেলান। তবে তারা চূড়ান্ত বিচারে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে দেশে-বিদেশে প্রচণ্ড চাপের মুখে শেখ হাসিনাকে জামিন দিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়ে কয়েক মাস থাকেন তিনি।
এদিকে, ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে দেশ চরম অস্থির হয়ে ওঠে। ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবল খেলা চলাকালীন ছাত্রদের সঙ্গে সেনা সদস্যরা অশালীন আচরণ করেন এবং তাদের মারধর করেন। এ ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরে সেনা সদস্যদের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ বাঁধে। এতে কমপক্ষে ৫০ শিক্ষার্থী, এক সেনা সদস্য, পাঁচজন পুলিশ সদস্য এবং বেশ ক’জন সাংবদিক আহত হন। ঐ ঘটনায় সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়; অনেক শিক্ষক এবং ছাত্র ঐ ঘটনায় আটক হন যৌথবাহিনীর হাতে। দেশব্যাপী ঐ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শে লালিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দেয়। পরে, সারাদেশে বিক্ষোভের মুখে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে এবং সেনাবাহিনী একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের শাস্তি দেয়ার অঙ্গীকার করে। এছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনা ক্যাম্পও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিএনপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে জনমানুষের দল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসা¤প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কাজ করছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর এ লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ এবং দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথভাবে সহযোগিতা করছেন তাঁর তথ্য প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। আওয়ামী লীগের টার্গেট এখন দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করা। আর দেশি ও বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা; শেষও করবেন তিনি।
সবার সঙ্গে বন্ধুত্বে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার। এইতো কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে ২২টি চুক্তি সম্পাদন করেছেন। ঐ সফরকালেই ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছর ধরে চলা অমানবিক জীবন-যাপনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা স্থাপনে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক সমস্যা, আলোচনা-সমালোচনার পরও দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী। ভবিষ্যতে রক্ত ও জীবন দিয়ে দেশের মঙ্গলে কাজ করে যাবেন- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই হোক প্রার্থনা! জয় বাংলা।
মোহাম্মদ আলী আশরাফ : ছাত্রনেতা, লেখক।