বাঙালি জাতির জীবনে ১৫ আগস্ট একটি শোকাবহ দিন। এখন সেটি যে শুধু ১৫ আগস্টে একদিনেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয় বরং এটি এখন সারা আগস্ট মাস জুড়েই জাতির জীবনে এক শোকাবহ অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে। সেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙালি রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, হিমালয় পর্বততুল্য, নির্যাতিত ও গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ১১ বছর বয়সের শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল খুনি-ঘাতকচক্র। স্বামীর উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে থাকার কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন আজকের বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষকরতœ, দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তার অত্যন্ত আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা। সে দিন মহান আল্লাহতালার অশেষ রহমতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এ দুবোন, তাদের বাবা-মা, ভাই, ভাই-বউয়েরা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর খবরে কি যে অনুভূতি হয়েছিল তা সারা দেশবাসীর সঙ্গে আমি নিজেও আরেকবার ভালোভাবে বুঝতে পারলাম গত ৯ আগস্ট ২০১৫।
আমি সাম্প্রতিক বিষয়াবলি নিয়ে পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যে যৎকিঞ্চিৎ কলাম লিখে থাকি। সে জন্য শোকাবহ আগস্ট মাস চলমান বিধায় এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ৯ আগস্ট রোজ রোববার সকাল থেকে। ঠিক সে সময় বেলা ১টা ২৮ মিনিটে আমার বাড়ি থেকে আমার মোবাইল ফোনে একটি টেলিফোন এল এই খবর দিয়ে যে, আমার পঁচাত্তর বছর বয়সী বাবা জোহরের নামাজ পড়ার আগে গোসল করতে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকের কারণে বাথরুমে পড়ে গেছেন। তারপর তার জ্ঞান হারানো, তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িতে থাকা ছোটভাই কর্তৃক উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, সেখানে না রেখে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বেসরকারি জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা, ঘটনা-পরবর্তী বিবরণ মতে সেখানে নেয়ার আগেই রাস্তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে কিন্তু হাসপাতাল থেকে শুধু মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে মাত্র। আমি সারাক্ষণই টেলিফোনে পুরো পরিস্থিতির সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে সংযুক্ত ছিলাম। সর্বশেষ বিকেল ৫টা ৯ মিনিটে আমার কাছে বাবার মৃত্যুর নিশ্চিত খবরটি আসে। আমার বাবা স্থানীয় কিংবা জাতীয়ভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিংবা পরিচিত কেউ নন। জনাব হেকমত আলী নামের এ ব্যক্তিটি চাকরি জীবনে বিটিএমসির অধীনে কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলে সিবিএ সংগঠন করার কারণে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মহোদয়ের কাছে প্রায়ই রাজনৈতিক পরামর্শ নিতে যেতেন এবং প্রতিবারই তিনি সুপরামর্শ নিয়ে ফিরেছেন- যা বিভিন্ন সময়ে আলাপে আলাপে আমাদের কাছে বলতেন। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরের যোদ্ধা না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে গোপনে সহায়তা করেছেন তাও বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। কিন্তু এ জন্য তিনি কোন মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট অর্জন করেননি বটে, তবে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। আর সে জন্যই এত কাছের আপনজন হারানোতে আমার যে তাৎক্ষণিক মানসিক অনুভূতি হয়েছিল তা আমি এ মুহ‚র্তেও বলে কিংবা ভাষায় বোঝাতে পারব না। তাহলে সপরিবারে মৃত্যু সংবাদ শোনার পর কী অনুভূতি হয়েছিল সেদিন বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার, কী-ই বা অনুভূতি হয়েছিল জাতি হিসেবে বাঙালির, কারণ তিনি যে ছিলেন বাঙালি জাতির পিতা। কাজেই আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্তির পর আমারও মনে হয়েছে শোকাবহ আগস্টের জন্য আগের অনুভূতির সেই লেখাটি আর এবার হয়তো লেখা সম্ভব হলো না। কিন্তু যে কোনো কারণেই মৃত্যু হোক না কেন একান্ত আপনজন বিশেষত বাবা-মা হারানোর যে কি ব্যথা তা এবার আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি।
বাঙালি জাতির জন্য প্রতি বছরই আগস্ট মাস সত্যিই কিছু না কিছু শোকের বার্তা নিয়ে ফিরে আসে। আগস্ট মাস আসলেই মনে পড়ে ১৫ আগস্টের ইতিহাসের জঘন্যতম সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কথা। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে ৬ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জাপানে হিরোশিমায় পৃথিবীর সর্বপ্রথম ‘লিটলবয়’ নামক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে বোমা মেরে দুদিনে প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। অপরদিকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের দলীয় এক জনসভায় আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক শক্তিশালী গ্রেনেড হামলায় তিনি পরম করুণাময়ের অশেষ দয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেও সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে ২৪ জন লোক প্রাণ হারান। পরবর্তী সময়ে গ্রেনেডের স্পিøন্টারের আঘাতে তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী (সদ্য প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী) বেগম আইভি রহমানসহ আরো অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। দীর্ঘদিন শরীরে গ্রেনেডের অসংখ্য স্পিøন্টার নিয়ে এর জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফও মারা গিয়েছিলেন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি নামক একটি জঙ্গি সংগঠন তাদের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলায় সুপরিকল্পিতভাবে বোমা হামলা ঘটিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলা, রমনা বটমূলে উদীচীর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা মারাসহ সারাদেশে বোমাতঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল, বস্তুত এর সবগুলোই একইসূত্রে গাঁথা।
১৫ আগস্টের সেই প্রিয় মানুষগুলোেেক হারানোর জন্য তাদের আপনজনরা যেমনিভাবে সব সময় শোকাহত হয়ে থাকেন, আমিও একজন স্বদেশপ্রেমিক এবং সুবিবেচনাপ্রসূত ব্যক্তি হিসেবে সে জন্যই শোকাহত হই। জাতির জনকের সঙ্গে আমার বাবার মৃত্যুশোক মিলিয়ে ফেলার কোনো ধৃষ্টতা আমার নেই, আর সেটি করার জন্যও আমি এ লেখা লিখছি না। আমি শুধু এটা বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, আমার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যুতেও আমার মনের ভেতর যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে তার থেকেও বেশি মর্মন্তুদ মানসিক কষ্ট হয়েছে সে সব নির্মম হত্যার শিকারে স্বজন হারানো শোকার্তদের। আমার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যুতে আমার অনুভূতি যেমন আর যাদের স্বজন অন্যায়ভাবে নির্মম হত্যার স্বীকার হয়েছে তাদেরইবা কেমন লাগে। আমার বাবাকে হারিয়ে আমি কাঁদছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার বাবাকে হারিয়ে আজ যে শুধু তারাই কাঁদছেন তা নয়, কাঁদছে সারাদেশ, কারণ বঙ্গবন্ধু যে বাঙালির জাতির পিতা। এ বছর থেকে ৯ আগস্ট আমার ব্যক্তিগত ডাইয়রিতে আরেকটি শোকের দিন যুক্ত হলো।
মো. হুমায়ুন কবীর : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।