আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মানস জগতে বঙ্গবন্ধু ঠিক কতটা আধিপত্য বিস্তার করছে? কয়েকদিন আগে চ্যানেল নাইনের আগস্টের বিশেষ অনুষ্ঠান ‘জনকের মুখ’-এ সঞ্চালক মুনতাসীর মামুন এমন একটি প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করেন আমার সঙ্গে। আমি নিজেও হয়তো এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কিভাবে মিশে আছেন। অধ্যাপক মামুনের এই প্রশ্নে তরুণ প্রজন্মের ভাবনায়, মনোজগতে বঙ্গবন্ধুর আধিপত্য ইত্যাদি নানা বিক্ষিপ্ত বিষয় আমার চিন্তায় ভেসে উঠে।
আমাদের প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু একজন আরধ্য পুরুষ। আমার জন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় এক দশক পরে। বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখিনি। খুব বেশি জানার সুযোগও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার ছিল না। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে ঠিক যেভাবে পাওয়ার কথা ছিল, সেভাবে পাইনি। এক অখ্যাত মেজরের ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার অলীক গল্প শুনে আমার বেড়ে ওঠা। পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা খুবই সীমিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বঙ্গবন্ধুর নাম সেখানে শুধুই শেখ মুজিবর রহমান। যিনি সারা জীবন শুধু জেলেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের (তখনকার পাঠ্যপুস্তকে স্বাধীনতা যুদ্ধের) বর্ণনা দিতে গিয়ে অষ্টম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে (১৯৯৫ সালের) লেখা হচ্ছে- ‘ … ২৫ মার্চের কালরাতে পাক বাহিনী শুরু করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন। বাঙালি জাতি দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এই দিকভ্রান্ত জাতিকে দিকনিদের্শনা দিতে সেই সময় এগিয়ে আসেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।’ এই ধরনের একটি ভ্রান্ত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোাদিত ইতিহাস পড়ে আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। গণমাধ্যম থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাসিত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিল। বঙ্গবন্ধু এমন একজন ব্যক্তিত্ব, পাঠ্যপুস্তক কিংবা টিভির পর্দা থেকে সরিয়ে দিলেই, বাঙালির মানস জগত থেকে তাকে সরানো যাবে না।
সমসাময়িক অনেকের লেখায় সেই দুঃসময়ে আমরা বঙ্গবন্ধুকে চিনেছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়া আমার প্রথম বই ‘মুজিবরের বাড়ি’। সময়টা সম্ভবত ১৯৯৫। সেই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মুনতাসীর মামুন লিখেছিলেন, ‘শত চেষ্টা করেও বাঙালির মন থেকে দুজন বাঙালির নাম মুছে ফেলা যাবে না। এমনই শক্তি ও দুটি নামের। এদের একজন হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি বাংলা ভাষাকে পরিচিত করেছিলেন বিশ্ব দরবারে। যাঁর গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আরেকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যাঁর নেতৃত্বে বাঙালি প্রথম আলাদা একটি ভূখণ্ড নির্মাণ করতে পেরেছিল।’
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এই অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। বঙ্গবন্ধু সেই সময় হয়তো গণমাধ্যমে আস্তে আস্তে ফিরে এসেছে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের দিকে খুব বেশি নজর সেই সময়ের সরকার দেননি। এখনো যে খুব বেশি নজর সরকার দিচ্ছে তা নয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তারের চেয়ে, নিজেদের মধ্যে কে বড়? সচিব না মন্ত্রী সেই কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত।
যাই হোক ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে মনোজগত থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরানোর নানা চেষ্টা করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে নানা ধরনের উদ্যেগ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু নির্বাসনের পরিকল্পনা। কিন্তু একজন মহানায়ককে তো সরানোর জন্য প্রয়োজন আরেকজন পার্শ্ব নায়কের। বাঙালির ইতিহাসে সেই পার্শ¦ নায়ক তো আর নেই। যারা বঙ্গবন্ধুর বিকল্প হিসেবে দৃশ্যপটে একজন পার্শ¦ নায়কের উদয় ঘটিয়েছেন তিনি তো বাঙালির ইতিহাসে খলনায়ক, অবৈধ দখলদার। ভিলেনকে নায়ক বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে ১৯৭৫ থেকে পরবর্তী দুই দশক স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের
পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সেই জায়গায় জিয়াউর রহমানকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ইতিহাস থেকে কখনো বঙ্গবন্ধুকে সরানো সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসে আজন্ম উচ্চারিত হবে জর্জ ওয়াশিংটন, লেলিন, ফ্রিদেল কাস্ট্রো, নেতাজি, গান্ধী কিংবা মার্টিন লুথার কিং-এর নামের সাথে।
বর্তমান প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর অসীম সাহসিকতা, অসাধারণ নেতৃতের গুণাবলি, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতায় দীক্ষিত। গত কয়েক বছরে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি রোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিস্তার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় কার্যকর, যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা আর এগুলোর পেছনে তরুণ প্রজন্মের নীরব সমর্থন বাংলাদেশের ভাবমূর্তির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে বিশ্ব দরবারে। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে নতুন পরিচয়ে পরিচিত। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার পথে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি খাদ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। পোশাক ও জনসংখ্যা রপ্তানিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের কাছে মডেল। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও মানব উন্নয়ন সূচকের ক্রম অগ্রগতি, গড় আয়ু বৃদ্ধি বাংলাদেশকে নতুন রূপে পরিচিতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আজ আর শুধু সঙ্গীতে নয়, বাস্তব সত্য।
বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, এই এগিয়ে চলায় বাংলা ও বাঙালিকে উদ্দীপিত করছে তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আর নীরবে পাথেয় হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি যে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বারবার বলে গিয়েছিলেন, আজ আমরা সেই মুক্তি অর্জনের পথে।
বলতে দ্বিধা নেই, এখনো তরুণ সম্প্রদায়ের একটি অংশ ঠিকমতো অন্তরে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের আন্দোলিত করে না। এটা আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। রাষ্ট্র তার এই নাগরিকদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে, একাত্তরে পাকবাহিনী কিংবা তাদের এ দেশীয় সহযোগী গোলাম আযম, সাকা, নিজামী গংরা একাত্তরে কী করেছিল। আমি শুধু এই সব তরুণদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধে যদি আপনার প্রিয় বোনটি নির্যাতিত হতো কিংবা আপনার মাকে যদি আপনার সামনে ধর্ষণ করা হতো তাহলে কি করতেন? যদি আপনার বাবাকে কিংবা ভাইকে হারাতেন তাহলেই বুঝতেন শহীদ পরিবারের যন্ত্রণা। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের পাশাপাশি মর্মন্তুদ বিষয় তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। না হয় এসব বেজন্মাদের সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে।
আসুন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নতুন বাংলাদেশ গঠনে নিজেদের নিয়োজিত করি। তরুণ প্রজন্মের মনোজগতে বঙ্গবন্ধুর আধিপত্য যত বেশি হবে, তত বেশি উজ্জ্বল হবে অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দ্রারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া।
চৌধুরী শহীদ কাদের : ট্রাস্টি, ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট।