ক্রীড়াঙ্গনে শেখ কামাল


বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে শেখ কামাল একজন স্বপ্নদ্রষ্টার নাম। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আধুনিকায়নের। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ। বৈরী রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতির চেয়ে খেলাধুলাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল তার কাছে। নিজে ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ। ক্রীড়া সংগঠক। ক্রিকেট খেলেছেন মোটামুটি ভালো পর্যায়ে। খেলেছেন বাস্কেট বল। আর অপরিসীম ভালোবাসা ছিল ফুটবলে। খেলাধুলার প্রতি তার এই ভালোবাসা এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে লেগেছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। সেতার বাদক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব। যা বলা যায় পরিপূর্ণ একজন ক্রীড়া পাগল মানুষ। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য! তার এবং এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের, আধুনিক এই মানুষটাকে খুব বেশিদিন বেঁচে থাকতে দেয়া হলো না। তিনি চলে গেলেন, রেখে গেলেন আবাহনী ক্লাবসহ অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান যা এ দেশে মানুষের যুগ যুগ ধরে খেলোয়াড় বানাবে না সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের খেলাধুলার প্রতি প্রেরণা জোগাবে এবং দেশের মানুষের আনন্দ জোগাবে।

আমি নিজে শেখ কামাল ভাইয়ের প্রজন্মের একজন লোক। ধানমণ্ডির বাসিন্দা হওয়ায় কাছ থেকে হলেও শেখ কামাল ভাইকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। দেখেছি একজন খেলোয়াড় হিসেবে। দেখেছি একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। দেখেছি একজন প্রাণোচ্ছল তরুণ হিসেবে। শেখ কামাল ভাইয়ের মৃত্যুর এত বছর পর তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে খানিকটা ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা চলে আসছে। আমার বাবা ছিলেন পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা। বদলির চাকরির সুবাদে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করি ১৯৭২-৭৩ সালে এবং ধানমণ্ডিতে স্থায়ী বসবাস শুরু করি। ওই সময় আবাহনী মাঠে একদল ক্রিকেটার প্র্যাকটিস করেছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন শেখ কামাল ভাইও। সেই নেটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শেখ কামালকে দেখে বলেছিলাম, ‘কামাল ভাই আমি খেলতে চাই’ সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খেলার সুযোগ দিলেন। আমার কাছে এখনো অবাক লাগে আমি অনেকটা কৌত‚হলের বশে এই ধরনের আবদার করেছিলাম, মনে মনে ধরেছিলাম হয়তোবা রাগ করবেন। কিন্তু তা নয়, তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে কোনো খেলাধুলার প্রতি তার আগ্রহের কথা। পরবর্তীতে ধানমণ্ডির ওমর ভাইয়ের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন আবাহনী ক্লাব মাঠে পুরনো ১৯নং-এ যেতাম মাঝে মাঝে আমাদের পাশের বাসার সাজ্জাদ ভাইয়ের বাসায় কামাল ভাই আসতেন। অনেক কাছে থেকে তাকে দেখেছি কিন্তু কখনো মনে হয়নি প্রধানমন্ত্রী বা বাষ্ট্রপতির ছেলে। সব সময় মনে হয়েছে এ দেশের আর দশজন মানুষের মতো সাধারণ নাগরিক। সে সময় ধানমণ্ডির প্রায় প্রতিটি উঠতি বয়সের ছেলেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধু বা ছোট ভাইয়ের মতো। এই প্রসঙ্গে আরো একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, প্রায় প্রতিদিন আবাহনী মাঠে অনেক বাইরের লোক খেলাধুলা করত। তিনি সব সময় পাড়ার ছেলেদের খেলাধুলার মধ্যে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। সেটা ক্রিকেট হোক, ফুটবল হোক, বাস্কেটবল হোক, ব্যাডমিন্টন হোক, সবাই কিছু একটা খেলুক সেটা শেখ কামাল ভাই চেয়েছেন সব সময়। তবে তার চাওয়াটা শুধুমাত্র ধানমণ্ডি এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য ছিল তাও নয়। আর সে কারণেই তিনি আবাহনী ক্রীড়াচক্র নামে একটা ক্লাব দাঁড় করিয়ে ফেললেন। শেখ কামাল ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত সেই আবাহনী আজ সারা দেশে অসংখ্য তরুণের প্রিয় ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান। শেখ কামাল ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত আবাহনী।

সারা দেশে ছড়িয়ে আছে আবাহনীর শাখা। শুধু দেশে বলছি কেন, মাঝেমধ্যে আমেরিকায় যেতে হয়, সেখানেও দেখেছি আবাহনীর শাখা আছে। নিউইয়র্কে ক্রিকেট লিগ হয়, সেখানেও আবাহনীর অংশগ্রহণ আছে। আবাহনী নামটা দেশে-বিদেশে এত মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তার একটা কারণ তো আছে। জোর দিয়েই বলছি সেটা কোনো রাজনৈতিক কারণ নয়। শেখ কামাল ভাই রাজনৈতিকভাবে যে মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, সেই মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় তেমন অসংখ্য লোকের কাছে আবাহনী তাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। কারণ আবাহনী এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে বসে থাকেনি। এ দেশের খেলাধুলায় তাদের সাফল্যও অনেক।

তবে এই আবাহনীও অনেক রাজনৈতিক হয়রানি আর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার একটাই কারণ- এই ক্লাবটার প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার উদ্দেশ্যে কলঙ্কিত করার চেষ্টা হয়েছে তার ছেলেকে। কিন্তু সময়ের বিচারে সেটা সম্ভব হয়েছে? হয়নি। কারণ একটা প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে করা যায় না। সে কারণেই শেখ কামাল যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শেখ কামালের স্বপ্ন ছিল- খেলাধুলার মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বে উড়বে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। উড়তে শুরু করেছে। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিশ্বকাপ খেলে, টেস্ট ক্রিকেট খেলছে। বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্ট হারাচ্ছে। ওয়ানডেতে হারাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকাকে। সত্যি কথা হচ্ছে, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা সেই অগ্রযাত্রার পথনির্দেশিকা। খেলাধুলার মধ্য দিয়ে এভাবে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নটা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দেখেছিলেন শেখ কামাল ভাই।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বলছি কেন, বলা উচিত বাংলাদেশ জন্মের আগেই শেখ কামাল ভাই এই স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি খেলাধুলার অঙ্গনের লোক ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ক্যাম্পে ছুটে গেছেন তিনি। সে সময় তার বন্ধুবান্ধবদের বারবার বলেছেন, দেশ স্বাধীন হোক, আমরা নতুন ফুটবল দল গড়ব। নতুন ক্রিকেট দল গড়ব। নতুন করে সাজাব ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনকে। দেশ স্বাধীনের পর সে কাজটা শুরু করেছিলেন তিনি। জাতির জনকের পুত্র, দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হয়েও শেখ কামাল ভাই মেতে থাকলেন তার আবাহনী আর এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে। দেশের ইতিহাসে প্রথম বিদেশি ফুটবল কোচ নিয়োগ দিলেন তিনি আবাহনীর জন্য। দেশের ফুটবলে লাগল আধুনিকতার ছোঁয়া এবং সেটা শেখ কামাল ভাইয়ের হাত ধরে। এরপর যখন শুরু হলো ক্রিকেটকে নির্বাসিত করার চেষ্টা, তখন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে নয়, একজন ক্রিকেটার হিসেবে, একজন ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্রীড়া প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বুঝাতে পেরেছিলেন, ক্রিকেট রাজার খেলা নয়, খেলার রাজা। সুতরাং ওটা বুর্জোয়াদের খেলা এই লেবেল এঁটে দিয়ে ক্রিকেটকে নির্বাসিত করা ঠিক হবে না এবং শেখ কামাল ভাইয়ের চিন্তা-ভাবনাটা যে একশভাগ সঠিক ছিল, তা আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের দিকে তাকালেও বোঝা যায়। এই দলে কজন বড়লোকের সন্তান আছেন। সাধারণ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরাই বাংলাদেশ দলে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ক্রিকেট রাজার খেলা নয়, খেলার রাজা হয়েই থাকছে। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তার স্বীকৃতি সময়ই দিয়ে দিয়েছে শেখ কামালকে।

মাঠের মানুষ শেখ কামাল ভাই মাঠের একজনকেই বেছে নিয়েছিলেন জীবন সঙ্গিনী হিসেবে। বিয়ে করেছিলেন এ দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা মহিলা অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে। ভালোবাসা থেকে বিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের দাম্পত্য ইনিংসটা প্রায় শুরুতেই শেষ করে দিয়েছিল ঘাতকের বুলেট। কিন্তু কোনো বুলেট, ট্যাঙ্ক কিছুই শেষ করতে পারেনি তার স্বপ্নের আবাহনীকে। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আবাহনী অনেক বড় মহীরুহে পরিণত হচ্ছে। শেখ কামাল ভাইদের মেরে ফেলা যায়, কিন্তু তাদের স্বপ্নকে শেষ করা যায় না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে স্বপ্নকে বয়ে বেড়ায়। এখনো মনে হয় কামাল ভাই নীল রঙের টয়োটা গাড়ি নিজেই চালিয়ে ধানমণ্ডির মোড়ে মোড়ে ঘুরছে, নেই কোনো প্রটোকল, নেই কোনো পুলিশ, নেই কোনো পাহারা। এখন কি এ কথা বিশ্বাস করবে কেউ? একজন রাষ্ট্রপতির ছেলে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করে গেছেন। তাই যখনই বাংলাদেশ ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্য আসে তখনই মনে হয় কামাল ভাইয়ের কথা। যে বীজ বুনে গিয়েছিলেন চল্লিশ বছর আগে তারই ফল ক্রমশই আমরা পাচ্ছি।

লিয়াকত আলী ভুঁইয়া : ভাইস প্রেসিডেন্ট (রিহ্যাব), জি বি সদস্য (এফবিসিসিআই)।

SUMMARY

1771-1.jpg