পনেরই আগস্ট প্রতিবারই আসে আমাদের সামনে দুঃখ, বেদনা, ক্ষোভ, যন্ত্রণা নিয়ে। এ দিনই বাংলাদেশের সামগ্রিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। সে দিনের কথা মনে হলে শোকে আপ্লুত হই আর ভাবি যা আমাদের সামনে এগোবার প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দিয়েছিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র, সাংবাদিকতাতে পড়ি। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বেশ সক্রিয়। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা নগরের সভাপতি। তাই স্বাভাবিক কারণেই সে সময় অনেক কিছু সম্মুখেই দেখবার বা জানবার সুযোগ হয়েছিল। প্রতিবারই ভাবি আমার অনুভূতির কথাগুলো লিখব। গত বছর ঢাকাতে সেলিম ভাই (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম) বলছিলেন, তুমি মাহবুব জামানকে সঙ্গে নিয়ে একবার অফিসে এসো এবং আমরা সবাই মিলে সে সময়ের ঘটনাগুলো স্মরণ করি, তার ধারাবাহিকতা সম্পর্কে একটু এসেস করার চেষ্টা করি। পরে হয়তো এ তথ্যগুলো হেল্প করবে আমাদের বা অন্যদের পথ চলার দিকনির্দেশক হিসেবে। আমরা খুব শিগগিরই ইতিহাস ভুলে যাই। তাই প্রয়োজন এটাকে সংরক্ষণ করা। একটা ডিজিটাল রেকর্ডার কিনে ফেলেছিলাম তার জন্য। কিন্তু মাহবুব ভাইয়ের ব্যস্ততার জন্য তা সময় করে বসতে পারিনি।
পনেরই আগস্ট ছিল আমাদের জাতির জন্যই সত্যি একটি বিয়োগান্তক ঘটনা। নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের স্বাধীনতার বিজয়কে মূলে আঘাত করা হয়েছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি এবং আমার সহকর্মীরা সেদিনের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। নিজে একজন ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়ে আমরা সেদিন সবাই মিলে বেশ সাহসিকতার সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছি। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে আমাদের সম্মেলনে বলেছিলেন যে, আমি মরব তবুও আমি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করব না। প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেই তিনি সাহস করে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার জন্যই। আম জনতার জন্যই তাঁর এই দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর এই হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমাদের সাহস জুগিয়েছে এবং আমরা দাঁড়িয়েছিলামও।
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আসবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে একটি নীতিনির্ধারক ভাষণ দিতে। ডাকসুতে তখন আমাদের সেলিম ভাই আর মাহবুব ভিপি ও জিএস। স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা বেশি দায়িত্ব পড়েছিল আমাদের ওপর সমগ্র অনুষ্ঠান যাতে নির্বিঘ্নে করা যায়। ১৪ তারিখ রাতে আমাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। হঠাৎ খবর পেলাম সায়েন্স এনেক্স বিল্ডিংয়ে একটি বোমা ফুটেছে। খবর পেয়ে আমরা দৌড়ে সবাই গেলাম। দেখলাম এর ফলে কিছু ফার্নিচার ড্যামেজ হয়েছে আর ছাত্ররা একটু আতঙ্কিত। আমরা বুঝিয়ে নিলাম এটা আমাদের বিরোধীদের কাণ্ড। তারা আমাদের এই নবযাত্রাকে শুরুতেই বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আমরা বেশ সতর্ক হয়ে গেলাম এবং খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চললাম অন্য নেতাদের সঙ্গে। সারাদিন চলে গেল কলাভবন সায়েন্স এনেক্স করে। কাজ করছি আর ভাবছি একটা কিছু চলছে ভেতরে ভেতরে যা আমরা কিছু জানি না। একটা কিছু আঁচ করা যাচ্ছিল যে, বিরোধীরা একটা ষড়যন্ত্র আঁটছে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান, শেখ শহীদ, নূহ উল আলম লেনিন, ইসমত কাদির গামাসহ অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং কাজকর্ম তদারকি করছেন। সঙ্গে সব সময় আছেন শেখ কামাল। তাকে আমরা বিদায় দিলাম রাত ১২টার দিকে অনেকটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। তাকে বলা হলো রাতে রেস্ট করে খুব সকালে যাতে চলে আসে। আমরা তাকে নানা কাজে সবসময় সঙ্গে পেয়েছি। ’৬০-এর দশকে অনেক মিছিল করেছি একসঙ্গে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে, এগারো দফা আর রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে, তারুণ্যে খাড়া একজন সক্রিয় ছাত্র-কর্মী। সে যাই হোক আমরা কজন থেকে গেলাম ইউনিভার্সিটিতে অনেক রাত অবধি। সেটা হবে প্রায় রাত ১টা। লেনিন ভাইয়ের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে বটতলার রেলিং ধরে কথা বলছিলাম আর আঁচ করছিলাম কী হতে পারে আর কী করে বের করা যায় কারা এর সঙ্গে জড়িত। আমার মনে ভয় হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর একটা ক্ষতি করার চেষ্টা চলছে। লেনিন ভাইকে বললামও। এ কথাও বললাম- মুশতাকের মতো রি-একশনারিদের নিয়ে বাকশাল নির্বিঘ্নে করা যাবে? ওদের নিশ্চয়ই একটা ইল মোটিভ আছে। এসব নিয়ে আরো অনেক কথা হলো। যাই হোক আমরা কজন রাত দুটার পরে চলে গেলাম হলগুলোতে। আমি ছিলাম সূর্যসেন হলে, সঙ্গে মোটরসাইকেল যা ছিল আমার সব কাজের সঙ্গী। হলের নেতাদের বলা ছিল কোন রুমে আমি থাকব। যাতে খুব সকালে উঠিয়ে দিতে পারে। সকালেই বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠান। হঠাৎ রুমের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা ‘কামরুল ভাই উঠুন, সর্বনাশ হয়ে গেছে!’ দরজা খুলে দেখি সূর্যসেন হলের খোকন দাঁড়িয়ে। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলছে, ‘এমাত্র রেডিওতে এনাউন্স করল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।’ শুনে তো স্তম্ভিত। আমি বললাম তোমরা ওয়াচফুল থাকো এবং খোঁজখবর নাও। আমিও যাই নির্ভরযোগ্য খবর নিতে। আমাদের কর্মীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আমি চলে গেলাম পাশে পিলখানা বিডিআর হেড কোয়ার্টারে, ভাবলাম ওখানে সঠিক খবর পাওয়া যাবে। ওখানে আমার চাচা জেনারেল এনাম কাজ করেন জেনারেল খলিলুর রহমানের সঙ্গে। বিডিআর চিফ- উনিও আমাদের এলাকার লোক হিসেবে খুবই পরিচিত। গিয়ে দেখি চাচা বাসায় নেই। খবর পেয়ে খুব সকালে গেছেন মিটিং করতে। আমার আসার খবর পেয়ে চাচিকে দিয়ে জানালেন অপেক্ষা করতে।
প্রায় দুঘণ্টা পর উনি এসে বললেন আমরা বিডিআর এখনো ওদের সঙ্গে জয়েন করিনি। আমরা কিছু একটা করার চেষ্টা করছি এই অপকর্মের বিরুদ্ধে। তুমি থাকো। আমার কাছ থেকে কিছু খবরও উনি নিলেন ইউনিভার্সিটির অবস্থা সম্পর্কে। আমি রেডিও শুনছি আর কটা জায়গায় ফোন করে খবর নিচ্ছি। রেডিওতে শুনলাম ডালিমের কণ্ঠ অনবরত বলেই চলেছে- বঙ্গবন্ধুকে খুন করার কথা। শুনতে শুনতে একেবারে চোখে পানি এসে গেল। বেলা ১১টা হতে হতে নেভি, এয়ারফোর্স, আনসার, পুলিশ হুমকির মুখে কুচক্রীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করল। বিডিআর করল সব শেষে। পরে বুঝলাম ওরা পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেলেছে। আর্মি, পুলিশ, নেভি, এয়ারফোর্স সবাই ওদের সঙ্গে চলে গেল বন্দুকের মুখে, ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুধু গুলির ভয়ে। বঙ্গবন্ধুর মতো লোককে যারা হত্যা করতে পারে তারা ওদের হত্যা করতে একটু পিছপা হবে না। যেমন হত্যা করেছিল কর্নেল জামিলকে রাতে। কিছুটা হতাশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম পুরান ঢাকার কয়েকটি বাড়িতে। সব জায়গাতে দেখলাম একটা চাপা ক্ষোভ এবং হতাশা। কোনো একটা নির্দেশের অপেক্ষায়। কিন্তু তেমন কোনো সাড়া আসল না কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে। সবাই স্তম্ভিত হয়ে কৌশল নিল সরে থাকার। আমিও আলাপ করে তাই করার সিদ্ধান্ত নিলাম অন্তত কদিনের জন্য। ঢাকা শহরের কিছু কর্মীদের নিয়ে আমরা কদিনের মধ্যেই নেটওয়ার্ক গড়ে তুললাম। শুরু হলো আবার নতুন করে প্রস্তুতি। যেহেতু আমি ছাত্র ইউনিয়নের সর্বশেষ নগর কমিটির সভাপতি ছিলাম তাই স্বাভাবিকভবে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল নারায়ণগঞ্জসহ বৃহত্তর ঢাকার। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। শেখ শহীদ ভাইকে কোনোভাবেই যোগাযোগ করা গেল না। সেলিম ভাই, লেনিন ভাই, মাহবুব ভাই, আকরাম ভাই ও ঢাকা ইউনিভার্সিটির নেতাদের সঙ্গে ভালো নেটওয়ার্ক গড়ে উঠল অল্প সময়ের মধ্যেই। আমরা ঠিক করলাম যে, যেভাবেই হোক একটা ডেট ঠিক করে আমরা বড় ধরনের একটা প্রটেস্ট র্যালি করব।
ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা হলো। ঠিক হলো আমরা কজন ওখানে বসে দিন তারিখ ঠিক করব। আমরা প্রায় জন দশেক ছিলাম মিটিংয়ে মমতাজ ভাইয়ের বাসায় নয়া পল্টনে। নুরুসহ আরো কজন এবং নগর ও কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। নুরু বলল, ওদের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে লড়তে হবে। ওই খুনিদের অস্ত্র দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। ভীষণ সাহসী কর্মী সৈয়দ নুরু। সে ছিল ছাত্রলীগের নগর সভাপতি। কিন্তু আমরা অনেককেই বললাম তা নয় আমাদের দেশের ভেতর থেকে ওদের মোকাবেলা করতে হবে সবাইকে নিয়ে। সবাই মত দিল আমাদের পক্ষে। নুরু বেশ উত্তেজিত হয়ে সভা থেকে চলে গেল এবং পরে জানলাম সে চলে গেছে খুনিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য। তার অনেক সহকর্মী তার সঙ্গে দেশের বাইরে প্রতিরোধ লড়াইয়ে অংশগ্রহণের জন্য চলে গিয়েছিল। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু দেশপ্রেমিক তরুণদের নিয়ে সে চেষ্টা করেছিল তাদের সংগঠিত করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে কোনো ষড়যন্ত্রে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
এক মাসের মধ্যেই আমরা আবার নিয়মিত প্রকাশ্যে আসা শুরু করলাম আমাদের কন্ট্যাক্ট পয়েন্টগুলোতে। উদ্দেশ্য একটা বড় ধরনের প্রতিবাদ সংঘটিত করা। কেউ বা ক্যাম্পাসে, কেউ বা খেলার মাঠে গিয়ে নিজেদের সবার সঙ্গে এসোসিয়েট করেছে। আমাদের এই কৌশল বেশ কাজে দিল। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কিছু শক্তি যারা ছিল তারা তো ওঁৎ পেতে রইল কিভাবে আমাদের ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেয়া যায়। এজেন্সিগুলো অনেক টাকা ঢালল আর নানাভাবে হুমকি দেয়ার চেষ্টা হলো। মূলত তথাকথিত পিকিংপন্থী কিছু দল আমাদের বিভিন্নভাবে ঝামেলা শুরু করতে লাগল। যাই হোক কয়েকদিনেই মধ্যেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে আমরা একটা প্রটেস্ট র্যালি করব এবং তা বের হবে মধুর ক্যান্টিন থেকে। যেই চিন্তা সেই কাজ। আমরা ইউনিভার্সিটি ছাত্র আর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্রদের নিয়ে জড়ো করলাম মধুর ক্যান্টিনে। সকালে জমায়েত হয়ে দেখি ওরা হকিস্টিক নিয়ে কজন বসে আছে ক্যান্টিনের ভেতর।
আমাদের জমায়েত একটু বড় হতেই ওরা প্রস্তুতি নিল আমাদের আঘাত করতে। আর আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের একসঙ্গে রণহুঙ্কার দিয়ে তাদের ইউনিভার্সিটি ছাড়া করছিলাম আর সবাইকে নিয়ে প্রথম প্রতিবাদ সংহত করেছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। কাজী আকরাম হোসেনের সেই এসালটের নেতৃত্ব দেখাল। সেদিন ওই প্রতিবাদ সংহত করার পর আমাদের দুঃখ, বেদনা যেন কিছু সময়ের জন্য তিরোহিত হলো। প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু হত্যার সংঘটিত হওয়ার পর কোনো প্রতিবাদ না করতে পরাই আমরা অনেকটা মনোবেদনাই হতাশাই ভুগছিলাম। সবাইকে নিয়ে এমনি একটি প্রতিবাদ করাতে দেশজুড়ে খবর ছড়িয়ে গেল আর প্রস্তুতি শুরু হলো এমনি একটি কর্মসূচির। ছোট ছোট গোপন সভা আর লিফলেট ওয়াল পোস্টারিংয়ের চেষ্টা হলো। আমাদের নেতারা লিফলেট ছেপে ঢাকা শহরে বিলির প্রস্তুতি নিল। ঢাকা শহরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে আমরা কাজ করতাম। যথাসময়ে লিফলেট ছেপে বিভিন্ন কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়া হলো এ কাজে মোটর কার, বেবি ট্যাক্সি, মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হলো। কয়েকশ লিফলেট পৌঁছে গেল মুহূর্তের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায়। এ কাজে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা ছিল সবচেয়ে উদ্যোগী। লিফলেট বিলি করতে গিয়ে ধরা পড়ল ঢাকা নগর কমিটির শওকত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও চামেলীবাগের শাহ জামাল, সিদ্দিকসহ আরো অনেকেই। ওদের দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয়েছে আর কঠিন নির্যাতনের মধ্যে থাকতে হয়েছে। ওদের আজকের দিনে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। তাদের সাহসে আজ আমরা কিছুটা হলেও সামনে এগুতে পেরেছি। হয়তো আমাগীতে আরো পারব।
কেন্দ্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য বেশ কটা তারিখ হলো। কিন্তু এবার ঠিক হলো একটু সময় নিয়ে করা হবে যাতে ব্যাপক মানুষকে নিয়ে করা যায়। সর্বশেষ তারিখ ঠিক হলো ৩ নভেম্বর। সিদ্ধান্ত হলো আমার শুধুই পদযাত্রা করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফুল দিয়ে আসব। বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সাড়া মিলছিল এ প্রোগ্রামের। ক্রমশ এই বর্বর হত্যার বিরুদ্ধে মানুষ গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে আসছিল। ৩ নভেম্বর খুব সকালেই শোক র্যালি হবে। সব প্রস্তুতি শেষ। যোগাযোগ করে চলছি যাতে সুশৃঙ্খলভাবে র্যালি করা যায়। আমাদের বড় প্রোগ্রামের প্রস্তুতির কাজ প্রায় শেষ, ঠিক ওইদিন ৩ নভেম্বর সকালে আমাকে ফোন করে সেলিম ভাই জানালেন, একটা খারাপ খবর শুনলাম। তুমি এখনই মোটরসাইকেল নিয়ে সেন্ট্রাল জেলে চলে যাও। আমি খোন্দকার শওকত হোসেন জুলিয়াসকে (বর্তমানে ডিভিশনাল কমিশনার, ঢাকা) নিয়ে চলে গেলাম সেন্ট্রাল জেলে এবং ডেপুটি জেলারের বাসাতে গিয়ে চার নেতা হত্যার বিষয়টি কনফার্ম হলাম। মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গেলাম সেলিম ভাইয়ের কাছে খবর পৌঁছানোর জন্য। উনি জানালেন, তুমি এটা কাউকে আপাতত বলো না, তাহলে পুরো ব্যাপারটা গুবলেট হয়ে যাবে। মিছিল আর শেষ করা যাবে না। তাই হলো, আমি চুপ করে থাকলাম। পরে ওই শোকযাত্রার পরেই জানানো হলো চার নেতার নির্মম হত্যার কথা। ৪ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে জেলের ভেতরে নির্মমভাবে। খুনিরা আমাদের জাতীয় নেতা তাজউদ্দিনসহ সবাইকে হত্যা করেছে যাতে আমরা বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে না পারি।
এসব হচ্ছিল ছকবাঁধা নকশা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর পরে ৪ নেতাকে হত্যা করে আমাদের সামনে চলার পথকেই রুদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছিল এবং এমনি অনেক ঘটনার জন্য চেষ্টা চলছে আজো। সবাই জানতো খন্দকার মুশতাক একজন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট এবং ভেতর ভেতর ষড়যন্ত্র আঁটছে। তবুও তাকে নিয়ে এবং তার মতো আরো লোকদের নিয়ে করা হয়েছিল বাকশাল। তাদেরই হাতে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হলো বঙ্গবন্ধু আর তার পরিবার আর তার সহকর্মী বীর ৪ জাতীয় নেতাকে। আজো যারা তোষামোদি করে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও তার দলকে নানাভাবে বিপদগ্রস্ত করতে চাচ্ছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন। যারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নামে সবকিছু নামকরণে অতিউৎসাহী হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করেছেন অতিসত্তর তাদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পুরো জাতিকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেক। যে আদর্শের কারণে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হলো সেই আদর্শ থেকে সরে এসে তাঁকে শুধু জাতির পিতার আসনে বসিয়ে রাখলে কি কোনো লাভ হবে আমাদের? তাই ভাবি, যদি সত্যি বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয় তাহলে তার ঘোষিত নীতিকে অনুসরণ করেই এগুতে হবে অন্যথায় আমরা কোনো বিজয়কে ধরে রাখাতে পারব না।
কামরুল আহসান খান : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী; সংস্কৃতিসেবী ও পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠন।