’৭৫-এর ১৫ আগস্ট : সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল অ¤øমধুর সম্পর্ক। পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ইচ্ছায় বঙ্গবন্ধু আইনজীবী হওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে দেশে ফিরে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় তিনি মাতৃভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং এ কারণে কারাবরণ করেন। তিনি ক্যাম্পাসে একজন ত্যাগী ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিতি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা দাবিদাওয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট করলে বঙ্গবন্ধু তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন দেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১০ টাকা জরিমানা করে এবং ভালো হয়ে চলার মুচলেকায় স্বাক্ষর দিতে বলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করতে অস্বীকার করায় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালের ২৯ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করে। ফলে তার উচ্চ শিক্ষার পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার সময় সহপাঠীদের বলে যান, ‘আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে আসব। তবে ছাত্র হিসেবে নয়, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে।’ তিনি তার কথা রেখেছিলেন। তিনি একজন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন স্বল্পকালীন হলেও এ সময়ই তার রাজনৈতিক জীবনের উত্থান ঘটে। তার ছাত্রত্ব চলে যাওয়া এক অর্থে শাপে বর হয়। এরপর তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন; পরিণত হন এক অপরিহার্য রাজনীতিকে। তার হাতে গড়া ছাত্রলীগ এ সময় সব রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলকে (ইকবাল হল) ছাত্রলীগের ঘাঁটিতে পরিণত করা হয়। তার নির্দেশেই এ হল থেকে আন্দোলন পরিচালিত হয়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে গৌরবজনক ভূমিকা পালন করে তার রূপকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারিতে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ জনতার সামনে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করে। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা উপাধি দেয়া হয়। এবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে এক জমকালো সংবর্ধনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। স্বাধীনতার পর তিনি তার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বেড়াতে আসেন ১৯৭২ সালের ৬ মে তারিখে। তার এ সফরটি ছিল আড়ম্বরহীন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন কলাভবনের সামনে বটতলায় তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেয়া হয়; ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়। সেদিন তার সামনে তার ছাত্রত্ব বাতিলের আদেশপত্রের কপিটি ছিঁড়ে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের ভালোবাসায় অভিভূত হন।

এরপর বঙ্গবন্ধু আরো দুবার অনানুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। একবার তিনি আসেন দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরই। তখন দেশে তীব্র খাদ্য সংকট চলছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলের ডাইনিংয়ে একবেলা ভাত ও একবেলা রুটি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুদিন যাওয়ার পর ছাত্ররা দুবেলাই ভাত দেয়ার দাবিতে সন্ধ্যার সময় তৎকালীন উপাচার্য ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে তার বাসভবনে ঘেরাও করে। বঙ্গবন্ধু সে খবর শোনামাত্র প্রটোকল ছাড়া কেবল গেঞ্জি গায়ে ছুটে আসেন উপাচার্যের বাসভবনে। তিনি ছাত্রদের রুটির পরিবর্তে ভাত দেয়ার আশ্বাস দিলে ছাত্ররা ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে ছাত্ররা অটোপ্রমোশনের জন্য শিক্ষকদের ঘেরাও করে রাখলে বঙ্গবন্ধু তা শোনামাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং ছাত্রদের আশ্বাস দিয়ে সমস্যার সমাধান করেন।

তবে যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে তা হলে ’৭৩-এর অর্ডিন্যান্স’। এই যুগান্তকারী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লাভ করেন নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন, ফিন্যান্স কমিটি, শিক্ষক সমিতি তথা প্রতিটি বডি নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালনা বিধি চালু হয়। এমন কী উপাচার্য নির্বাচন শুরু হয় শিক্ষকদের সরাসরি ভোটে। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাজেট প্রণয়ন করার এখতিয়ার লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন আবাসিক হল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ হলটির নাম স্যার এ এফ রহমান হল।

এসব কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে সাড়ম্বরে সংবর্ধনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারিখ ঠিক হয় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। সে বছরের প্রথমদিকে তিনি বাকশাল গঠন করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার সে ডাকে সাড়া দিয়ে বাকশালে যোগদানের জন্য সেদিনটার অপেক্ষায় ছিলেন। তখন ক্যাম্পাসের সর্বত্রই শুধু একই আলোচনা চলছে- ‘বঙ্গবন্ধু ক্যাম্পাসে আসছেন’। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা, খুব কাছ থেকে তার বক্তৃতা শোনা সেদিন যেন ১২ হাজার ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীর একমাত্র মনোবাসনা হয়ে দাঁড়ায়।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর শুভাগমন উপলক্ষে আগস্ট মাসের শুরু থেকে এক মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবন ঘষে মেজে ঝকঝকে করে তোলা হয়। দেয়ালে দেয়ালে চমৎকার সব স্লোগান লেখা হয়। করিডোরে বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতি শোভা পায়। ব্যানার ও ফেস্টুনে ভরে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। কলাভবনের সামনে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়। নীলক্ষেত মোড় থেকে টিএসসি পর্যন্ত বিদ্যু খুঁটিতে মাইক লাগানো হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেসব ছাত্রছাত্রী জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবে তারা ডাকসুর কক্ষে রিহার্সেল দেয়। ইউওটিসির ক্যাডেটরা সালাম জানানোর প্যারেড করে জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে। অতিথিদের মাঝে বিতরণ করা হয় আমন্ত্রণপত্র। বঙ্গবন্ধু উদ্দেশ্যে লেখা মানপত্রটি লিখে প্রস্তুত রাখা হয়। দলমত নির্বিশেষে ছাত্রছাত্রীরা দিনরাত কাজ করে। সব কাজের তদারকি করেন তৎকালীন উপাচার্য বোস অধ্যাপক ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী। সার্বিক দায়িত্ব পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। তখন ডাকসুর ভিপি ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস ছিলেন মাহবুব জামান। অনুষ্ঠানটি যাতে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় সে জন্য দিনরাত কাজ করেন বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল। তখন তিনি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের এম এ শেষ বর্ষের ছাত্র। এমনিভাবে আসে ১৪ আগস্ট। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে পুরো ক্যাম্পাস। নিরাপত্তাকর্মীরা সব সময় পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এসবের মধ্যেই সেদিন সন্ধ্যার সময় বিকট আওয়াজে দুটি ককটেল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ও সায়েন্স এ্যানেক্স ভবনের পেছনে বিস্ফোরিত হয়। ফলে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, বঙ্গবন্ধু আগমনের প্রস্তুতিতে সাময়িক ছেদ পড়ে। এ জন্য জাসদকর্মীদের দোষারোপ করা হয়। পরে অবশ্য সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা। সব শেষে ক্যাম্পাস ছেড়ে জিপ চালিয়ে চলে যান শেখ কামাল। তখন কে জানত এটাই কামাল ভাইয়ের শেষ যাওয়া। বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের অনুষ্ঠানমালা নানা ব্যঞ্জনে সাজানো হয়েছিল। ’৭১-এর শহীদ শিক্ষকদের কবর জিয়ারত ও পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণের মধ্য দিয়ে দিনের প্রথম কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। এরপর ইউটিসির ক্যাডেটদের প্যারেড পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ, ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের দেয় পুষ্পমালা গ্রহণ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মিউজিয়াম পরিদর্শন, জগন্নাথ হলের গণকবরে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, সায়েন্স এ্যানেক্স ভবনের সম্প্রসারণের কাজ উদ্বোধন এবং সবশেষ কলাভবনের সামনে নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীদের উদ্দেশে বক্তৃতা প্রদান।

পরদিন ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার জেগে ওঠার আগেই এক মহাদুঃসংবাদ এসে ক্যাম্পাসে আছড়ে পড়ে। বেতার ঘোষণায় বারংবার বলা হতে থাকে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। এমন মর্মান্তিক আর হৃদয়বিদারক খবরে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। আয়োজকরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। আমরা কলেজ পড়–য়া সমবয়সীরা আমাদের নীলক্ষেত কোয়ার্টারের সামনে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে থাকি। তখন সকাল ৮টা। একটি ট্যাংক নিউমার্কেটের দিক থেকে এসে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিল। কালো পোশাক পরা ৪/৫ জন সৈন্য ট্যাংকের ওপর অস্ত্র হাতে বসেছিল। তারা আমাদের দেখে অস্ত্র উঁচু করে চিৎকার দিয়ে উর্দু ভাষায় বলছিল, ‘শালালোগ আন্দারমে যাও। নাহি তো গুলি ক্যার দ্যাউঙ্গা।’ আমরা তাদের এমন রক্তপিপাসু হুঙ্কারে ভয় পেয়ে যার যার ঘরে চলে আসি। মনে পড়ে ’৭১-এর ২৬ মার্চ সকালে নীলক্ষেত মোড়ের দৃশ্য। সেদিন সকালে বাসা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্যাংকের ওপর বসে তাচ্ছিল্যভরে বাঙালিদের গালিগালাজ করছিল আর দেখা মাত্রই গুলি করছিল। মাত্র কয়েক বছরের একই দৃশ্য দেখতে হবে ভাবতে পারিনি।

সকাল তখন সাড়ে আটটা। বাসায় এসে অন্যমনস্ক হয়ে নাস্তা খাচ্ছি। হঠাৎ শুনতে পাই খসরু ভাইয়ের (কামরুল আলম খান খসরু) গলার আওয়াজ। খসরু ভাই আমার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছেন। দোতলা থেকে দৌড়ে তার কাছে এসে দেখি তার উষ্কখুষ্ক চেহারা উত্তেজনায় কাঁপছেন। তিনি বলেন, তোমরা কয়েকজন আমার সঙ্গে এসো। মাটি খুঁড়ে অস্ত্র ওঠাতে হবে। আমরা ৩/৪ জন সমবয়সী খসরু ভাইয়ের পিছু পিছু আবু সাঈদ হলের (বর্তমানে বিলুপ্ত) সামনের মাঠে চলে আসি। খসরু ভাই বলেন, মন্টুকে (মোস্তফা মোহসিন মন্টু) খবর দিয়েছি। ও আসলেই কাজ শুরু করব। বিনা চ্যালেঞ্জে তাদের ছাড়ব না। প্রতিশোধ নিবই। আমি বলি, টিএসসির সামনে ট্যাংক রয়েছে। খসরু ভাই বলেন, ‘ট্যাংক ধ্বংস করার ট্রেনিং আমার আছে। দরকার কেবল কিছু গ্রেনেড আর একটি বেয়নেট।’ এদিকে বেলা ৯টা পেরিয়ে যায়। খসরু ভাই অস্থির হয়ে মাঠে পায়চারি করছেন। হঠাৎ এক লোক হন্তদন্ত হয়ে এসে খসরু ভাইয়ের কানে কানে কি যেন বলে। খসরু ভাই আমাদের যার যার বাসায় চলে যেতে বলে তিনি জহুরুল হক হলের পেছন দিক দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এর কয়েক বছর পর তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতায়। যাক সে কথা। বাসায় না ফিরে কৌত‚হলী মন নিয়ে আমি ক্যাম্পাসের অবস্থা দেখার জন্য চুপিসারে নীলক্ষেতের রাস্তা পার হয়ে রেজিস্টার বিল্ডিং ও কলাভবনের পেছনের সরু পথ দিয়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির কাছে চলে আসি। তারপর যুৎসই একটি স্থান খোঁজ করে সেখানে গিয়ে বসি। পুরো ক্যাম্পাস নীরব-নিস্তব্ধ। এতদিনকার চেনা ক্যাম্পাসকে বড় অচেনা মনে হয়। কোথাও একটি লোকও চলচল করতে দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে কাকের কর্কশ ডাক আর ট্যাংক-সামরিক যানের চলাচলের আওয়াজ। একটি প্রাইভেটকার রোকেয়া হলের সামনের রাস্তা দিয়ে একাধিকবার আসা-যাওয়া করছিল। সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে যথারীতি আজান দেয়া হয়। কিন্তু একজন মুসল্লিকেও নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যেতে দেখিনি।

এমনিভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। এদিক সেদিক দুএকজন মানুষকে চলাচল করতে দেখা যায়। আমি সাহসকে ভর করে ধীরে ধীরে কলাভবনের সামনে দিয়ে নীলক্ষেতে নিজেদের বাসায় ফিরে আসছি। দেখি কলাভবনের সামনে থাকা বিশাল মঞ্চটি ফাঁকা পড়ে আছে। আশপাশের দেয়ালের লিখনগুলো জ্বলজ্বল করছে। আজ তিনটি স্লোগান আমার মনে আছে ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই,’ ‘সবুজ বিপ্লবের পথ ধর বাংলাদেশ গড়ে তোল,’ ‘যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বহমান ততদিন রবে তোমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান’। সেদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিন ক্যাম্পাসে কাটিয়ে ব্যথিত মন নিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরে আসি। মা আমাকে দেখে বলে, সারা দিন কোথায় ছিলি বাবা। আমরা তোর চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছি। দেখি মার চোখে জল। আমি মনে মনে বলি, মা যদি কাঁদতে হয় বাংলাদেশের জন্য কাঁদ। দেশ আজ পিতৃহারা হলো।

স্বপন কুমার দাস : সাংবাদিক, লেখক।

SUMMARY

1769-1.png