বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত সুদীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ‘বাংলাদেশের’ রক্তাক্ত অভ্যুদয় ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ হত্যা করার প্রচেষ্টা করা হয়। তবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে শারীরিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্বের ক্রিয়াশীলতা সাময়িকভাবে থমকে দেয়া সম্ভব হলেও, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনার’ শাশ্বত প্রকৃতির কারণে খুনি চক্র তা চিরতরে স্তব্ধ করতে পারেনি। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম, নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও সরকার পরিচালনার কারণে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ সফলভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের উন্নয়নের গতিকেও তা বেগবান করেছে। এ সঙ্গে ত্যাগের মহিমায় দেদীপ্যমান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাসঙ্গিকতা সূর্যের মতো উজ্জ্বল স্থান লাভ করেছে।
বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে লাখ কোটি ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ব্যতিক্রম। নিজ কর্মগুণে মহত্ত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যিনি পৌঁছেছিলেন। ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) বাংলা বিভাগ ২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত “Greatest Bengalis of All Times” শীর্ষক এক জরিপ পরিচালনা করে। বিবিসির ১২ মিলিয়ন শ্রোতা বিশেষত বাংলাভাষী শ্রোতারা যারা বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে আছে তারা এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। এই জরিপের ফলাফল প্রক্রিয়াকরণের জন্য ২০ দিন সময় ব্যয় হয়। এবং ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ১ বৈশাখ এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। “২০ এৎবধঃবংঃ ইবহমধষরং” এর তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রথম স্থানে এসে যায়। পর্যবেক্ষকদের মতে এরকম ফলাফলই স্বাভাবিকভাবে আশা করা গিয়েছিল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিবিসির শ্রোতা জরিপে বঙ্গবন্ধুর পরেই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্থান পেয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। বাংলাদেশের সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সাধারণ অনুভূতি হচ্ছে হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ আর চেতনায় নজরুলকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রক্তের সাগর পেরিয়ে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেট বিশাল হৃদয় ধারণকারী বঙ্গবন্ধুর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল। এই দিনটি বাঙালি জাতি ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালন করে।
প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের বিখ্যাত বাগ্মী, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ এবং ল্যাটিন ভাষায় বিখ্যাত গদ্য রচয়িতা মার্কুস টুল্লিয়াস সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রি.পূর্ব) রাষ্ট্রকে ‘দ্য এফেয়ার অব দি পিপল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে জনগণ হচ্ছে একটি স্বশাসিত সংগঠন যার নিজেকে টিকিয়ে রাখা এবং এর অস্তিত্ব অব্যাহত রাখার ক্ষমতা আছে। সিসেরা বলছেন, ‘A people is a self-governing organization, which has necessarily the powers to preserve itself and continue its existence: Salus populi suprema lex esto’
অপরদিকে সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থা। ফরাসি জ্যুরিস্ট জ্যাঁ বোঁদা ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে সার্বভৌম হচ্ছেন তিনি যিনি আইনের ব্যতিক্রম নির্ধারণ করেন, অপরদিকে ম্যাজিস্ট্রেসি শুধু এটি বাস্তবায়ন করে। বোঁদার মতে সার্বভৌমত্ব একসময় রাজার ওপর অর্পিত ছিল, এখন এই (সার্বভৌম) ক্ষমতা জনগণের মধ্যে অবস্থান করে এবং প্রধানত নির্বাচিত পার্লামেন্ট এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য এপারেটাসের দ্বারা এর অনুশীলন করা হয়ে থাকে। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত বিতর্কে একটি ঔৎসুক্যের দিক হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে মহান সর্বশক্তিমান স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের ধারণার অবতারণা। বিশেষত স্রষ্টার আইন হিসেবে আখ্যায়িত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বাণী অনুযায়ী শাসন কার্য পরিচালনা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের দাবি। যেখানে বলা হচ্ছে, মহান স্রষ্টাই সার্বভৌম। এবং স্রষ্টার বিধানই হবে শাসনের অন্যতম অবলম্বন। তবে এখানেও মনে রাখা সঙ্গত হবে যে মহান স্রষ্টা স্বয়ং কখনো শাসন কার্য পরিচালনা করবেন না বা করেন না। তাই সার্বভৌমত্বের কথা বলে শাসক যা করেন তা ‘জনগণের’ কাছে অর্থাৎ যাদের শাসন করা হচ্ছে, তাদের কাছে ‘জবাবদিহিতার’ প্রশ্নটি প্রধানতম বিষয়। মৃত্যুর পরে স্বর্গ বা নরকের বিষয়টি না হয় স্রষ্টা স্বয়ং বিবেচনা করতে পারেন কিন্তু এই মর্ত্যলোকে যে ‘জনগণ’ ওই ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গের শাসনের ভুক্তভোগী তাদেরও তো বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। তাদের জন্য কোনোটি ভালো আর কোনোটি মন্দ, কোনোটি ন্যায় আর কোনোটি অন্যায়, এগুলোর ভুক্তভোগী যেহেতু তারাই সেহেতু এ সম্পর্কে তাদের মতামত জরুরি। জবাবদিহিতার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘পার্লামেন্ট’। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ‘পার্লামেন্ট’ এর কাছে সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে। আর এখানেই, এমনকি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার না করে কোনো উপায় থাকে না।
এ দেশের জনগণের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণের দ্বারা পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের সার্বভৌমত্বের ক্রিয়াশীলতা তাই অনস্বীকার্য। বর্তমান লেখকসহ প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষই, অন্ততপক্ষে ব্যক্তি জীবনে, স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে আস্থাশীল। আবার প্রায়শ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের কথা সচরাচর বলা হয়ে থাকে। সে তুলনায় জনগণের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আলোচনা অবহেলিত। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বের ক্রিয়াশীলতা এ ক্ষেত্রে কদাচিৎ উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কারণ নির্বাচন হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম একটি মাধ্যম। জনগণের সার্বভৌমত্বের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নির্বাচনের দ্বারা বৈধতা প্রাপ্ত হয়। কিন্তু নির্বাচনের বাইরে জনগণের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কীয় আলোচনা বেশিদূর অগ্রসর হতে দেখা যায় না। জনগণের রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্বই প্রধানতম বিষয়, সে ক্ষেত্রে এ সম্পর্কে আলোচনার অবহেলা প্রকারান্তরে অন্ধকারময়তার জন্ম দেয়। অমর্ত্য সেনের কথার শব্দান্তর করে বলা যায়, The neglect… obscures the world in which we live. সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণই সব ক্ষমতার উৎস অর্থাৎ এ দেশে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ বিদ্যমান।
জনগণের সার্বভৌমত্বের এই সাংবিধানিক স্বীকৃতি সম্ভব হয়েছে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের ফলে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সংবেদনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার দ্বারা। পাকিস্তানি ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসনামলে জনগণের সার্বভৌমত্ব কখনো বাস্তবতার রূপ দেখেনি। সে সময়ে জনগণের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি আন্দোলনের দাবি হিসেবে ঝুলে থাকত। সবশেষে একবার ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপারটির একটি সুরাহা হওয়ার আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বভাবসিদ্ধ চেতনা অনুযায়ী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়নি। ফলে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার’ আহ্বানের মধ্য দিয়ে সে সময়ের বাঙালি জনগণের চেতনা ও সার্বভৌম ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। জনগণের সার্বভৌমত্বের এই চরম প্রকাশ সম্ভব হয়েছে বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশের জনগণকে একত্রিত করে মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কারণে। এই কারণের পেছনে এ দেশের আপামর জনসাধারণের পাশাপাশি, উল্লেখযোগ্য হিসেবে অনেক স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী, নেতা ও ঘটনা জড়িত থাকলেও একজন নেতা এই সবকিছুকে সফলভাবে সমন্বয় করতে ও নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন। তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
‘জনগণকে’ ঘিরেই বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্ম পরিচালিত হতো। তিনি তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতিতে অসংখ্যবার ‘জনগণ’ পদবাচ্যটি ব্যবহার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ‘জনগণ’ই ছিল তাঁর চেতনার উৎস। তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণিত হতো ‘জনগণের’ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সুর। মিটিং-মিছিলে, আলোচনা-পরামর্শে, সাক্ষাৎকারে, তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতি জনগণকে ঘিরে আবর্তিত হতো। জনগণের চাওয়া-পাওয়ার কথাই সেখানে অনুরণিত হতো। অনেক বক্তৃতার মধ্য থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তৃতার অংশবিশেষ তুলে ধরতে পারি। উনিশশ একাত্তরের আঠাশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের লনে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু এবং (১৯৭০ সালের নির্বাচনে) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সম্মানে ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘… উন্নত জীবনের আশাতেই জনগণ সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছিল। কিন্তু তার জায়গায় এ পর্যন্ত তারা এমনভাবে শোষিত হয়েছে যে তাদের মেরুদণ্ডই ভেঙে গেছে…।’ হাজার বছর যাবৎ এ দেশের জনগণের ওপর চলে আসা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনা আর দুঃখ-কষ্টের অনুভূতি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথরেখা অঙ্কন করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান স্বকীয়তায় ভাস্বর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি এ দেশের জনগণকে ‘আমার মানুষ’, ‘বাঙালি’ প্রভৃতি অভিধায় সম্বোধন করে তাদের দুর্দশা বা তাদের রক্তঝরা সংগ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ভাষণে তিনি জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণ এবং এর প্রতিবাদে বাঙালিদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁর নিজের সুদীর্ঘ সংগ্রামী প্রচেষ্টার কথা অনবদ্যভাবে বর্ণনা করে স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। শুধু এই ভাষণই নয় বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনই প্রকৃতপক্ষে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল উৎসর্গীকৃত।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ (অধুনালুপ্ত) দৈনিক বাংলায় ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একজন সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক লিখিত স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধের অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, ‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে যখন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য ষড়যন্ত্র করছিল তখন সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর দিকেই তাকিয়েছিল। জাতি বঙ্গবন্ধু আদেশের অপেক্ষায় ছিল। এই দুর্যোগের সময় বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে আপস না করে যেভাবে অনড় ছিলেন তাতে করে তিনি বাঙালিদের কাছে কিংবদন্তির মহাপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। সে সময়টায় তিনি ছিলেন বাঙালিদের মুকুটহীন সম্রাট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এ দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
একদিকে জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাবান বাঙালি ও তাদের সমর্থকরা, অন্যদিকে অস্পষ্ট এবং অব্যাখ্যাত চেতনায় উদ্বুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকরা এক ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এই যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। কারণ জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক বৈধতা আসে না। সে হিসেবে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু যে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থায় বৈধতা আনা। ডেভিড ম্যাকক্রোনের ভাষায় ‘Without this bonding of people to state, it could not have achieved political legitimacy to itsactivities.’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরিণতিতে খণ্ডিত ও বিকৃত চেতনায় তাড়িত পাকিস্তানি পক্ষ পরাজিত হয় এবং তাদের দৃষ্টিতে অসম্ভব ঘটনা বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যায়। জনগণের সার্বভৌমত্বে আস্থাবান বাঙালি জয়লাভ করে।
‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা একটি ধ্বংসস্ত‚প আকারে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অপার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হওয়া একটি দেশকে জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়; শত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও দেশ গড়ার কাজ দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকে; ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছার কারণে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়; পাকিস্তানি বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটিরও বেশি স্মরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়; নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালের মার্চে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; সমুদ্রবন্দর, রেল যোগাযোগ, সেতু, কালভার্ট প্রভৃতি দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন এবং অবকাঠামো পুনর্বাসন করা হয়; সমাজ উন্নয়নের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিতদের অর্থনৈতিক মুক্তি অঙ্গীকার নিয়ে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের মনে ক্রমান্বয়ে দেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে। শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন পরিচালনার মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব যখন ইতিবাচকভাবে পূর্ণ মাত্রায় ক্রিয়াশীল ছিল সেই পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল।
রক্তার্জিত স্বাধীনতার মাত্র প্রায় সাড়ে তিন বছর পর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্তব্ধ করে দেয়ার অপচেষ্টার পর থেকে জনগণের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কীয় আলোচনার প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ অবহেলার পুনরাবির্ভাব লক্ষ করা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের সার্বভৌমত্বের ক্রিয়াশীলতার কারণে ইনডেমনিটি আইন বাতিল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকর হচ্ছে। কয়েকজন খুনি এখনো বিদেশে পলাতক আছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার সেসব পলাতক খুনিদের ধরে এনে বিচারের রায় বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে তাঁরই কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ ক্রিয়াশীলতার কারণে ইনডেমনিটি আইন বাতিল হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ ক্রিয়াশীলতার প্রভাবে জাতীয় শোক দিবসকে ‘জন্মদিন’ হিসেবে পালন করার প্রহসন ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ ক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। পাশাপাশি জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘ধর্মের’ দোহাই দিয়ে ‘গণহত্যা’, ‘ধর্ষণ’, ‘অগ্নিসংযোগ’, ‘লুটপাটকারী’ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধীদের বিচারও চলছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসব কর্মকাণ্ড প্রকৃতপক্ষে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ ক্রিয়াশীলতার লক্ষণ।
অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।