জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সবশেষে কাছ থেকে দেখি ১৯৭৫ সালের ১১ আগস্ট। ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটে শহীদ হওয়ার মাত্র ৪ দিন আগে। ঠিক ৪০ বছর পর ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট কলামটা লিখতে গিয়ে কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালির সেই দিনের চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে, মনকে দিচ্ছে দুমড়ে-মুচড়ে আর কান যেন শুনতে পাচ্ছে তারই উদাত্ত আহ্বান। ওই দিন ছিল জাতীয় দল কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল দলের জেলা সম্পাদকদের ট্রেনিং কোর্সের উদ্বোধন বঙ্গভবনে। ইতোমধ্যে আমি জেনে গেছি বাকশাল অফিসে আমাকে কাজ করতে হবে এবং কোন ঘরে কোথায় কোন চেয়ার-টেবিলে বসবো তাও ঠিক হয়ে গেছে। শুরুতেই এই দায়িত্ব পাওয়ার কারণ ছিল দুটো। প্রথমত বার্লিন যুব উৎসবে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি। ওই প্রতিনিধিদলে আমি ছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র প্রতিনিধি। যাওয়ার আগে এবং বার্লিনের কাজকর্মে তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করলেন। আর ছাত্র আন্দোলন করার সুবাদে বাকশালের অপর সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকও আমাকে ভালো জানতেন। দ্বিতীয়ত তখনকার রাজনৈতিক দলগুলোর অফিসের মধ্যে সবচেয়ে গুছানো ছিল কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। ১৫ জানুয়ারি ’৭৫ বাকশাল ঘোষিত হওয়ার আগে-পরে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বড় কাজ ওই অফিস থেকে করে দেয়া হয়েছিল।
এ দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক দিন পর ওই দুই নেতার কাছ থেকে জানতে পারলাম, বঙ্গভবনের জেলা সম্পাদকদের ট্রেনিং কোর্সের উদ্বোধনী দিনে আমাকেও উপস্থিত থাকতে হবে অফিসের কাজে। সেদিন ওখানে কোনো কাজ করতে হয়নি। তাই বেশ কাছে থেকেই বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, বক্তৃতা শুনেছি। এখনো মনে পড়ে ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অবিচল প্রতিভাত হলেও বেশ পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। ওই দিনের বক্তৃতায় কেন তিনি শাসনতন্ত্র ও সিস্টেম পরিবর্তন করেছেন, গণতন্ত্র কিভাবে কার্যকর থাকবে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি কি, কিভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে, জনগণকে কিভাবে সমবেত করে কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে হবে, দলীয় সংগঠনের ভূমিকা কী হবে প্রভৃতি সব সহজ-সরলভাবে বুঝিয়েছিলেন। বক্তৃতা শুনতে শুনতে এটাই আমার মনে হয়েছিল যে, জাতীয় চার মূলনীতি গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র- তিনি এক ও অখণ্ড সমগ্র রূপে নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন এবং দেশ-জাতি-জনগণের মুক্তির জন্য তা বাংলাদেশের মাটিতে বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।
এই চার মূলনীতিই ছিল তাঁর রাজনৈতিক সাধনার ধন; বাঙালি জাতির হাজার বছরের পথপরিক্রমার সংগ্রামের সঞ্চিত অমূল্য ফসল, সম্পদ। জনগণের রক্ত-ত্যাগ দিয়ে গড়া এই চেতনা। যা তিনি তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ভেতর দিয়ে চেতনায় প্রোথিত করেছিলেন এক সঙ্গে এবং কর্মের ভেতর দিয়ে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেদিন তিনি এমনটাই বলতে চেয়েছিলেন যে, বিদ্যমান সংকট মোকাবেলা করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এটা একটা সাময়িক বা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এটা করা হয়েছে। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই জাতীয় দলে ব্যতিক্রম বাদে রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা সবাই সমাবেত হয়েছিলেন। যদিও তা বাধ্যবাধকতার মধ্যে ছিল না। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা তিনি করতে পারেননি। কিন্তু জীবন দিয়ে তিনি রেখে গেছেন তার সেই অমর চেতনা, জাতীয় চার মূলনীতি। আজকের এই ক্ষুদ্র কলামের স্বল্প পরিসরে জাতির স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে থাকা জাতীয় চার মূলনীতি তিনি কিভাবে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আত্মস্ত করেছিলেন, এর কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো। যা দিয়ে এটা অনুধাবন করা সম্ভব হবে, কিভাবে তিল তিল করে এই মহান নেতা জাতীয় চার মূলনীতিকে জাতির জন্য অমূল্য এক সম্পদে পরিণত করেছিলেন।
জাতীয়তাবাদ- এই চেতনার স্ফ‚রণের ভেতর দিয়েই এক জাতির দেশ পাকিস্তানে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৪ মাসের মাথায় ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবনে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) ঢাকা নগরের মুসলিম লীগ কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ওই সভা চলাকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ভাষার দাবিতে ছাত্রদের একটি মিছিল সেখানে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৬ জনের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তার মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পরে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই এই দুই সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়ার বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব। ষাটের দশকে ‘জয় বাংলা’, ‘জাগো বাঙালি জাগো’, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ প্রভৃতি স্লোগানগুলো ছিল এই মহান নেতার উত্থাপিত ৬-দফারই যথাযথ অভিব্যক্তি। একটু খেয়াল করলেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতি তিনি অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমেই দৃঢ় ও একনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গভীর আবেগ বুকে ধারণ করে তিনি প্রায়ই বলতেন যে, যে দিন ভুলে যাব আমরা বাঙালি, সে দিন আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। প্রসঙ্গত বলতেই হয় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে জাতির যাত্রা শুরু হয় তিন মূলনীতি দিয়ে। জাতীয়তাবাদ তখন কথায়-লেখায় ছিল না। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারি তিনি প্রথমেই কবিগুরুর কবিতা উদ্ধৃত করে জাতীয়তাবাদী চেতনা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বক্তৃতায় বলেছিলেন, কবিগুরু তুমি দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড গ্রাউন্ডের ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি জাতীয় মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি উচ্চারণ করেন।
১৯৪৭-এ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফ‚রণ থেকে ‘জাতীয়তাবাদ’ জাতীয় মূলনীতি হিসেবে যুক্ত করার পথপরিক্রমাটা খুব সোজা-সরল ছিল না। নীতিতে সুদৃঢ় ও কৌশলে নমনীয় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি এক জাতির দেশ পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে এই চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিল তাঁর হিসেবি ও বিবেচনাপ্রসূত এবং আবেগময় পদক্ষেপ। ১৯৫৪ সালের মে মাস। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের দিনেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার আদমজী মিলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা বাধালো। নিয়োগ করা হলো মিলিটারি, তারা ছিল সব ‘অবাঙালি’। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে একা উপদ্রুত এলাকায় অভাগা বাঙালিদের পাশে দাঁড়ান তিনি। কথাটা শুনে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। শুরু করলেন চেঁচামেচি, ধমকা-ধমকি। নেতা থেকে প্রশাসন পুলিশ সবাই খেলেন ধমক। কেন একা রেখে সবাই চলে এসেছে ঢাকা। এক সময় ফিরলেন বিধ্বস্ত শেখ মুজিব। তখন দাদু শেরে বাংলা নাতি শেখ মুজিবকে বসালেন পাশে, গায়ে বুলিয়ে দিলেন হাত। একইভাবে ’৬৪-এর জানুয়ারির দাঙ্গায় তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুরান ঢাকায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বাঁচাতে গেছেন। ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ বলে যে স্লোগানটি তাঁর নেতৃত্বে জনপ্রিয় হয়েছিল, তা ছিল ওই চেতনার যথার্থ প্রতিফলন। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ‘পূর্ব বাংলা অরক্ষিত’ স্লোগানটাও তাঁর কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছিল। আগরতলা মামলা ছিল এই চেতনা বাস্তবায়নের পথে ফাঁসির দড়ি। জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি ও মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় নিয়ে তিনি সভা-সমাবেশ প্রভৃতি শুরুর আগে সব ধর্ম পুস্তক পাঠের প্রথা চালু করেছিলেন। অভিজ্ঞতার কথা বলি, সংখ্যালঘু ছাত্রবাস জগন্নাথ হলে কোনো ছাত্রলীগ সংগঠন ছিল না, সমর্থকও না। ৬-দফা ঘোষণার পর এই প্রথা চালু হলে ওই হলে ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে ওঠে।
গণতন্ত্র- এই চেতনা ছিল কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান টিকিয়ে রেখে পূর্ব বাংলার ওপর শোষণ-শাসন অব্যাহত রাখার স্বার্থে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে উত্থিত। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কয়েক দিন পর শেখ মুজিব ছাড়া পেলেন। আব্বা ঢাকা জেল গেটে এসে বললেন, বাড়ি চল। কিন্তু গেলেন না। পরে এক সময় গেলেন বটে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনসভা ও সাংগঠনিক কাজ। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করল গোপালগঞ্জে জনসভা ভণ্ডুল করতে। এমন কি মসজিদের ভেতরেও ১৪৪ ধারা দিল। গ্রেপ্তার করা হলো শেখ মুজিবকে। কিন্তু রাত পর্যন্ত মানুষ নড়ে না। বাধ্য হয়ে প্রশাসন শেখ মুজিবকে বলতে দিল এই শর্তে যে, তিনি মানুষকে চলে যেতে বলবেন। সুযোগ পেয়ে তিনি গণতন্ত্র ও ভাষার দাবি নিয়ে পুরো বক্তৃতাই দিয়ে দিলেন। কিন্তু মানুষ নড়ে না। শেষ পর্যন্ত জামিন দিতে বাধ্য হলো প্রশাসন। এভাবে শুরু যাত্রা, তারপর তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আর পেছনে ফিরে তাকাননি। এ কথা কার না জানা যে, আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় এবং ভাষা আন্দোলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের সঙ্গে ছিলেন না। তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে জিন্নাহ মুসলিম লীগ গঠন করে বিরোধী রাজনীতি শুরু করেছিলেন তিনি। এদিকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে জেলে অনশন করতে গিয়ে মরণাপন্ন অবস্থা হয় শেখ মুজিবের। ২৭ ফেব্রুয়ারি ’৫২ তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। মাওলানা ভাসানীসহ নেতারা তখন জেলে।
প্রসঙ্গত মাওলানা ভাসানী ছিলেন আসামের নেতা। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্র্দী। তাই পূর্ব বাংলার সর্বত্র সোহরাওয়ার্দীর অনুগামী অসংখ্য নেতাকর্মী ছিলেন আর জনগণও তাকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনীতির প্রধান নেতা হিসেবে বিবেচনায় নিত। সোহরাওয়ার্দীকে দলে নিয়ে আসা এবং পূর্ব বাংলা বিধান সভার নির্বাচনের দাবি নিয়ে ১৯৫২ সালের ১৪ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব যান পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে তিনি একদিকে নির্বাচন ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সংবাদ সম্মেলনসহ রাজনৈতিক তৎপরতা করেন আর অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দলে যোগদান ও পূর্ব বাংলায় এসে দলের কাজে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। সোহরাওয়ার্দী দুই অনুরোধই রেখেছিলেন। পরে ঢাকা এসে শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সারা পূর্ব বাংলায় সাংগঠনিক সফর করেন। এই তৎপরতার ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়েই আওয়ামী লীগের সংগঠনের ভিত্তি আরো প্রসারিত ও গভীর হয় এবং ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় সুনিশ্চিত হয়। একটা সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগে ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত নেতৃত্বের সেতুবন্ধন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
কিন্তু এই বন্ধন টিকেনি। এ কথা কার না জানা যে, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কর্মসূচিতে যুক্ত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংগ্রাম হয়, সেই সংগ্রামে তরুণ নেতা শেখ মুজিবই ছিলেন যুব সমাজের অগ্রণী নেতা। কিন্তু মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী এক সময় কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এই অবস্থায় যুক্ত নির্বাচনপ্রথা ও এক লোক এক ভোটের শাসন ব্যবস্থা চালু করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন পাকিস্তানের মেজরিটি পূর্ব বাংলার ৫৬ ভাগ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে তিনি স্বায়ত্তশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে পাকিস্তানের শাসক- শোষক গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। তখন মাওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে বিরোধ বাধে। পাকিস্তানের শাসক-শোষক গোষ্ঠী এটাই চাইছিল। এই অবস্থায় শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এই প্রথম পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে শেখ মুজিব গণতন্ত্রের অধীনস্ত করেন। গণতন্ত্র থাকলে পূর্ব বাংলা ও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের শাসন থাকবে আর তাতে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচিত হবে- এই ছিল সোহরাওয়ার্দীর কৌশল। প্রসঙ্গত পরবর্তীতে আইয়ুবের প্রকৃত প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন বলেই সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ’৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তাই ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ উপাধিটা সোহরাওয়ার্দী এমনি এমনি পাননি। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবিকে গণতন্ত্রের অধীনস্ত করেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। যুক্ত নির্বাচন প্রথা মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না পাকিস্তানের শাসক-শোষক গোষ্ঠীর। ফলে আসে সামরিক শাসন। তারপর শেখ মুজিব কিভাবে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির সঙ্গে গণতন্ত্রের দাবি একই মাত্রায় যুক্ত করে ১৯৭০-এর নির্বাচন করেছিলেন, তা নিয়ে এই ক্ষদ্র কলামে আলোচনার সুযোগ নেই।
ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চেতনা ছিল গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের চেতনার সম্মিলিত ফসল। গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী চেতনা যিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ ও লালন-পালন করবেন, তিনি ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার এই মতের বাইরে থাকতে পারেন না। শেখ মুজিব তাই প্রথম থেকেই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেক্যুলারিজমের প্রবক্তা ছিলেন। মাতৃভাষা বাংলার দাবি ছিল এই চেতনার মহান বহিঃপ্রকাশ। পর্যবেক্ষণে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর আওয়ামী সরকার গঠিত হলে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব বাংলায় বাস্তব বিচারে যথাসম্ভব সেক্যুলার শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ইতোপূর্বে উল্লিখিত পঞ্চাশের দশকে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়া এবং সভা-সমাবেশ সব ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের প্রথা চালু করা ছিল এরই বাস্তবসম্মত প্রয়োগ। ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে ধর্মহীনতা- এই প্রচারণা বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ছিল পরাজিত শক্তির ছিল মূল প্রচার। বলাই বাহুল্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু মুজিব যে চেতনাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, সেই চেতনাটাই হচ্ছে পরাজিত শক্তি, যারা পাকিস্তানকে মিনি পাকিস্তান বানাতে চায় তাদের প্রকৃত টার্গেট। এ কারণেই সেনাশাসক জিয়া ক্ষমতায় এসে এই চেতনাটিকে শাসনতন্ত্র থেকে বাদ দেন এবং চিরদিনের জন্য উৎখাত করতে তৎপর হন। হত্যা-খুন ও ক্যুয়ের রাজনীতি এই চেতনাকে চির নির্বাসন দিতেই দেশের রাজনীতি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন জেঁকে বসেছিল। পরাজিত শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় সুদীর্ঘ বছর থেকে অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রচার চালানোর ফলে জনগণের এক বিরাট অংশ এখনো মনে করে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা। বর্তমান জাতীয় বাস্তবতায় ও জনগণের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় নিয়ে নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও এই চেতনাকে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম অব্যাহত রাখছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ।
সমাজতন্ত্র- এই চেতনা আমাদের দেশের বাস্তবতা থেকে উল্লিখিত তিন চেতনাকে ধারণ করে উত্থিত। যে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হতদরিদ্র-বুভুক্ষু, যে দেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে গরিব মানুষ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে জীবন দিয়েছে, যে দেশের মুক্তিসংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সমর্থন দিয়েছে; সেই দেশের জাতীয় মূলনীতিতে তখনকার বিশ্ববাস্তবতায় সমাজতন্ত্র শব্দটি যুক্ত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, পাকিস্তানি আমলের প্রথমদিন থেকেই পূর্ব বাংলার আন্দোলন ছিল গরিবমুখী এবং এতে শেখ মুজিব ছিলেন সামনের কাতারে। ’৪৮ সালের শেষ দিক। গোপালগঞ্জের বাইরের শ্রমিক যায় ধান কাটতে। ধান কেটে ভাগের ধান শ্রমিকরা বাড়ি নেবে নৌকা করে; কিন্তু তাতে পড়ল বাধা। ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম। এই নিয়ে শুরু হলো আন্দোলন শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। ‘জিন্না ফান্ড’ তুলতে গরিবের ওপরও চাঁদা ধরা হলো ৫ টাকা। নালিশ নিয়ে শেখ মুজিবের কাছে এল গোপালগঞ্জের গরিব কৃষকরা। শেখ মুজিব দাঁড়ালেন শ্রমজীবীদের পক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে ছাত্রনেতা মুজিব অবস্থান ধর্মঘট করার সময়ে হলেন গ্রেপ্তার। জরিমানা গুনতে হয়েছিল শেখ মুজিবসহ ছাত্রনেতাদের।
প্রকৃত বিচারে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব-শোষণ-নির্যাতন- নিপীড়ন থেকে মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা বিগত শতকে সমাজতন্ত্র শব্দটি ভেতর দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছিল। কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না- স্লোগানটি বাংলার অবিসংবাদিত নেতার মুখে প্রকাশ পেয়েছিল ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি’ শব্দগুলো দিয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এসে তিনি প্রথমেই ‘গণতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রের’ লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন। দেশের ইতিহাসের প্রথম সংবিধানে তিনি গণতন্ত্রের সঙ্গে জনগণের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের তখা মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। আমাদের জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানই বলতে পেরেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত’। তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ছিল দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর কাছে দ্বিতীয় বিপ্লবের পথ গ্রহণ ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। এই প্রথম তিনি গণতন্ত্রকে দুঃখী মানুষের হাসির অধীনস্ত করেছিল জাতির মুক্তির লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রচারের কী প্রচণ্ড প্রতাপ। দুর্ভাগ্যের বিষয় এখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরাও পারতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা উচ্চারণ করতে চান না। প্রকৃত বিচারে সময়ের প্রকৃত প্রতিমূর্তি এবং সাহসী সন্তান ছিলেন তিনি। মেন্ডেলা, নাসের, হোচিমিন, ক্যাস্ট্রো, নেহেরু, আলেন্দে- তৃতীয় বিশ্বের সব নেতারাই তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী কমবেশি একই পথ গ্রহণ করেছিলেন। এই জন্যই ওই সময়কালের বিশ্বের প্রধান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক মানবদরদী প্রগতিকামী নেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানও বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বঙ্গবন্ধু মনে করেছিলেন, কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ করে বাঙালি জাতি মানুষ হয়েছে। কিন্তু বাঙালি জাতির মধ্যে যে রয়েছে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের রক্ত। পরশ পাথরের মতো নেতা, যিনি হাজার বছর ধরে নিষ্পেষিত হওয়া এই মানচিত্রের কোটি কোটি মানুষকে জাগ্রত করে এক সূত্রে গ্রথিত করেছিলেন; স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ভালোভাবে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার; তাঁকেই ঘাতকরা বুলেটের নিষ্ঠুর আঘাতে হত্যা করে। মানব ইতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংস ঘটনা সংঘটিত হয় বাংলার মাটিতে। পরাজয়ের প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে রাজধানী ঢাকায় তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী দেহকে না রেখে সুদূর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় চিরনিদ্রায় শায়িত করতে। এই মহান নেতার নাম ইতিহাস থেকে মুছে দিতে সামরিক ফরমান জারি করে বলা হয়, তাঁর নাম নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। সবশেষে প্রহসনের নাটক চলছিল প্রতি বছর বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের দিনে জাতীয় শোক দিবসে জন্মদিনের কেক কাটার। এই জন্মদিন যার, তিনি আবার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে। এবারে বিদেশ গিয়ে এই প্রহসন নাটক থেকে জাতিকে তিনি রক্ষা করেছেন কিনা, কে জানে!
কলামটা শেষ করছি একটা গল্প দিয়ে। গল্পটা আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। তখন বর্ষাকাল। চারদিকে পানি। তাতে কচুরিপানা ভর্তি। এক কৃষক বের হয়েছেন নৌকা নিয়ে। হাতে তার ধারালো কাঁচি। গরুকে খাওয়ার জন্য জন্য তিনি কচুরিপানা কেটে নেবেন। কাটতে গিয়ে বিষধর সাপ ডান হাতের বুড়ো আঙুলের আগায় ছোবল দেয়। মৃত্যু অনিবার্য বুঝে কাঁচি দিয়ে দিয়ে তিনি আঙুলটা কেটে ফেলে দিলেন। জামা খুলে ব্যান্ডিজ বাঁধলেন। প্রাণ বাঁচলো তার। ফিরবেন বাড়ি। এমন সময় দেখলেন তার কাটা আঙুল পড়ে আছে কচুরিপানার ওপরে। পরম মমতায় নিজের রক্তমাখা আঙুলটি তিনি হাতে নিলেন। বাড়লো আরো মায়া। কাটা হাতের দিকে তাকালেন। আঙুলটা নেই। দুঃখে বিহŸল হয়ে সেই রক্তমাখা আঙুলটা তিনি ব্যান্ডিজের ওপরে রাখলেন। আর যায় কোথায়। বিষ তার জীবন ছিনিয়ে নিল।
কমবেশি একই ধরনের ঘটনা কি ঘটেনি আমাদের জাতির দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাসে। ’৭২-এর নির্বাচনের আগে গেলাম কুমিল্লায় অধ্যাপক মোজাফফর আহামেদ জিতবেন কি না দেখতে। পথে আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাকের নির্বাচনী এলাকা দাউদকান্দি। এলাকায় দেখা পাওয়া সবার সঙ্গে কথা বলে জানলাম, মোস্তাক নির্ঘাত পরাজিত হবেন। কয়েক দিন পর রাতে পুরানা পল্টনের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে বসে নির্বাচনের ফলাফল শুনছি। ফল আসতে শুরু করল। নির্ঘাত ফেল করছে মোস্তাক। কিন্তু না। ক্ষমতার বলে প্রশাসনকে কব্জা করে তিনি শেষ পর্যন্ত জিতে গেলেন। প্রসঙ্গত চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের টিকেটও মোস্তাক পায়নি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করিয়ে তাকে জিতিয়ে এনেছিল। কি দুর্ভাগ্য! জনগণ যাকে দেয় সেই বিষধর আঙুলের মতো বিসর্জন, সেই বিষধর মানুষরূপী সাপকে জনগণের নেতা করেন আবাহন; করে দেন জায়গা। জাতির পিতার মৃত্যু দিনে এটাই কামনা, যেন মানুষরূপী বিষধর সাপেরা রাজনীতি থেকে চির বিসর্জনে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্য রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। যুগ যুগ তিনি আমাদের জাতির অন্তরে তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন এবং চলার পথকে আলোকিত করবেন।
শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।