১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। নির্দিষ্ট তারিখে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বলা যেতে পারে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের শাসনামলে কেবল এটিই একটি পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের কিছুদিন পরই ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের হবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পাকিস্তানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ ভেবেছিল, ইয়াহিয়া খান হয়তো অন্য সামরিক জেনারেলদের থেকে ব্যতিক্রমী হয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অবদান রেখে পাকিস্তানের রাজনীতির ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্রের মুখোশ খসে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। নির্বাচন হওয়ার তিন মাসের মধ্যেও ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেননি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকার জন্য ইয়াহিয়াকে অনুরোধ করেন। ইয়াহিয়া ১৪ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভুট্টো বললেন, ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি ১ মার্চ ঘোষণা করলেন, পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে কোনো অধিবেশন চলতে পারে না। অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলে আমি পেশায়োর থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা অচল করে দেব। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে একজন সদস্যও যদি ভালো কথা বলেন আমরা তা গ্রহণ করব। ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাত দেখিয়ে ১ মার্চ দুপুরে বেতার ভাষণে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর কর্মকাণ্ড ষড়যন্ত্রের নাটক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা ‘আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো ব্যাপার হয়েছে’। প্রেসিডেন্টের ঘোষণার প্রতিবাদে বাংলার সংগ্রামী জনতা রাজপথে নেমে আসে। সারা দেশে দাবানলের মতো রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘তোমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। ‘বীর বাঙালি অস্ত্রধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’।
১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের যৌথ সভা চলছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের ঢল হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে জড়ো হয়। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জনতাকে শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি ২-৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ২টা পর্যন্ত হরতাল পালন করার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন বলে উপস্থিত জনতাকে আশ্বস্ত করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে কি বলেন তা শোনার জন্য সারা দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আবশেষে জনতার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক লোকের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশেবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। সেদিন তিনি বাঙালি জাতিকে একটি নির্দিষ্ট ঠিকানার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আর সে ঠিকানা হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থেকো, শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতার মতোই বক্তব্য রেখেছিলেন, সেদিন তাঁর ভাষণের বজ্র নিনাদে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কেঁপে উঠেছিল। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার ঊর্মিমালায় সুনামি সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর ডাকেই মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে নির্দেশনামূলক কাব্যময় বক্তৃতা প্রদান একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব বলে আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজউইক একাত্তরের ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধে ‘রাজনৈতিক কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। ইতিহাস পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মর্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ভাষণটি ছিল খুবই সাজানো ও প্রাণবন্ত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ তারিখে প্রদত্ত গেটিসবার্গ ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে, তেমনিভাবে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং নির্যাতিত মানুষের কাছে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রতুল্য বলে বিবেচিত হবে। এ কথা আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা-ই ছিল স্বাধীনতার প্রথম আহ্বান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বজ্রকণ্ঠ’ শিরোনামে ভাষণটি প্রচার করা হতো
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্তরে স্তরে ছিল পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় বার্তা এবং এ দেশে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শাসনের পরিসমাপ্তির ঘোষণা ও বিবরণ। তাঁর ভাষণের প্রতিটি পঙ্ক্তি যেন কালজয়ী কবিতার পঙ্ক্তি। এই মহাকাব্য বাঙালি জাতির সংগ্রাম-আন্দোলনের ধারা ও লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। এ মহাকাব্য বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দীক্ষিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণটি ছিল তাঁর দীর্ঘ ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণত ফসল। সেদিনটি ছিল বাঙালি জাতির একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিনের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যতটুকু বলা সম্ভব ছিল, তিনি তাঁর বক্তৃতায় তা বলেছেন। তিনি কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তাহলে দশ লক্ষাধিক লোক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর ব্যবস্থা করত, যা তারা আগেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। আর বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের নামে বাংলার জনগণকে পাখির মতো গুলি করে স্বাধীনতা আন্দোলন স্তব্ধ করে দিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে মহল বিশেষ বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। তাদের মতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি বলে ৭ মার্চ জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেননি। যারা এ জঘন্য মিথ্যা বক্তব্য দিতে পারে তারা জাতির বিবেকের শত্রু। তারা অসুস্থ রাজনীতির ধারক ও বাহক। তারা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিতর্কিত করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয় এটা সমগ্র বাঙালি জাতির। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করতে চায় তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী এবং পাকিস্তানের অনুসারী। তারা ঘুমের মধ্যেও পাকিস্তান স্বপ্ন দেখে। তাদের চোখের সামনে লাল-সবুজের পতাকার বিপরীতে চাঁনতারা পতাকা ভেসে ওঠে। তাই বঙ্গবন্ধু তাদের কাছে অসহ্য। কারণ বঙ্গবন্ধু তাদের সাধের পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ঠিকানা ছিল সেনা ছাউনিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দোসর হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো উজ্জীবিত রাখবে বলে বিশ্বাস করি। তাঁর এ ভাষণটি বারবার বাঙালি জাতির কাছে ফিরে আসবে। যতদিন পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বহমান থাকবে, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন ৭ মার্চ বাঙালি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকবে।
রবীন্দ্র কুমার বক্সী : লেখক, সংগঠক।