১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উপস্থাপন করেন। ১৯৪০ সালে এই লাহোর শহরে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি করে। সেখানে একাধিক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। এই প্রস্তাবের উত্থাপনকারী ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। আবার ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে এই প্রস্তাবের সংশোধনী এনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উল্লেখ করা হয়। একাধিক রাষ্ট্রের কথা উবে যায়। এবারও প্রস্তাবের উত্থাপনকারী আরেক বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেননি যে, এর দ্বারা বাঙালিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হচ্ছে। পরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে শৃঙ্খলমুক্ত হয় বাঙালিরা। লাহোর প্রস্তাবের ২৬ বছর পর বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তিসনদ পেশ করেন। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সোপান। কেননা একে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। তবে হতে পারত ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে উপস্থাপিত ২১ দফা বাঙালির মুক্তি সনদ। কিন্তু তা হয়নি। বাঙালিরা ২১ দফা বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্টকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল। এই ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন লাভ করে যুক্তফ্রন্ট । পক্ষান্তরে শাসক মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জ্যেষ্ঠ ও বরেণ্য নেতারা ২১ দফা বাস্তবায়নের চেয়ে নিজেদের দলীয় কথিত আদর্শ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে শুরু হয় রাজনৈতিক হানাহানি। ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। এদিকে পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকরা তো ষড়যন্ত্রের জাল নিয়ে তৈরি ছিলেন। ক্ষমতা আরোহণের লোভ এত নিচু পর্যায়ে গিয়েছিল যে, পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল (সাবেক আমলা, লম্পট এবং শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ) গোলাম মোহম্মদকে কে আগে মালা দেবেন, তা নিয়ে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এবং আরেক বরেণ্য নেতা আতাউর রহমান খানের ভেতর প্রতিযোগিতা হয়েছিল যা দেশে গোটা বাঙালি জাতি লজ্জায় মাথা হেঁট করেছিলেন। নানা ষড়যন্ত্রের পর ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারির সময় পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এভাবে ২১ দফা রাজনীতির চোরাবালিতে তলিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রণয়ন নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত। বাম আঁতেলদের কেউ কেউ বলতেন যে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দলিলটি তৈরি করে দেয়। আবার উগ্র ভারত বিরোধীরা বলতেন এটি ভারতের কাজ। এখানে ২১ দফার ১৯ নম্বরটি তুলে ধরা হল। “ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বশাসিত ও ‘সভরেন্ট’ করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যবস্থা ব্যতীত অন্য সব বিষয় অবশিষ্ঠাত্মক ক্ষমতাসহ পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং একটি সমরাস্ত্র কারখানা নির্মাণপূর্বক পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষার স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।” সম্মানিত পাঠক, উপরের কথাগুলোর সঙ্গে ছয় দফার কি বেশি দূরত্ব ছিল। খুব সংক্ষেপে ছয় দফার উল্লেখ করতে চাই। (১) ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে যেখানে প্রদেশসমূহ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। পাকিস্তানে সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে সার্বভৌম আইন পরিষদ গঠিত হবে। (২) কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল দুটি বিষয় যথা দেশরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে। (৩) দুটি অঞ্চল যথা পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু থাকবে। (৪) কেন্দ্রীয় সরকারের কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। এই ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অঙ্গরাজ্যগুলো থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যের রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ লাভ করবে। (৫) পাকিস্তান ফেডারেশনভুক্ত দুটি অঙ্গরাজ্যের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুইটি পৃথক খাত থাকবে। বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত পূর্ব পাকিস্তানের আয় পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। (৬) আঞ্চলিক সংহতি এবং সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীন আধাসামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রক্ষার ক্ষমতা দিতে হবে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে ইহার নিজস্ব আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন এবং পোষণের অধিকারী হবে। ১৯৬১ সালে একটি বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটে যায়। যদিও তখন দেশে পূর্ণ সামরিক শাসন এবং ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব একচ্ছত্র অধিপতি পাকিস্তানের।
১৯৬১ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান অর্থনীতি এসোসিয়েশনের সম্মেলনে তরুণ বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘দুই অর্থনীতি থিওরি’ উপস্থাপিত করেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের বিশেষ ভৌগোলিক পরিস্থিতিতে দুই প্রদেশের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যদিও অধ্যাপক রেহমান সোবহান সরাসরি উপস্থাপন করেন। তবে এটি প্রণয়নে আরো কয়েকজন নবীন অর্থনীতিবিদের অবদান ছিল, তার মধ্যে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান খান, আখলাকুর রহমান প্রমুখ। এর ফলে ২১ দফায় উল্লিখিত ফেডারেল সরকারকে প্রদত্ত মুদ্রার বিষয়টি ছয় দফাতে বিলীন হয়ে যায়। ছয় দফার কোনো একক প্রবর্তক নেই। এটি বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে। তবে এই বিবর্তন ঘটানোর মূল নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কেননা তিনিই একমাত্র বাঙালি রাজনীতিক যিনি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে কোনো আপস করেননি। অষ্টপ্রহর তার মাথার একটি চিন্তা ছিল, তা হলো কিভাবে বাঙালির মুক্তি আসবে। ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ জাতীয় কোনো কথাবার্তায় তিনি যাননি। আর এ কারণে বঙ্গবন্ধুর মেন্টর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে তিনি তার রাজনীতিক কর্মসূচিতে নেমে যান। সোহরাওয়ার্দীর পাকিস্তানের ওপর একটু বেশি মায়া ছিল কেননা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে সুপ্রিতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডের উদযাপনকে কেন্দ্র করে দাঙ্গাকে উৎসাহিত করেছিলেন। এই সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, দলীয় রাজনীতি না করে একটি মোর্চা গঠন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার। এই মোর্চার নাম ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৬৮-৬৯-এ আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। জেনারেল ইয়াহিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তার নির্বাচনী প্রচারণায় দ্ব্যার্থহীনভাবে বলেন যে, তিনি এই নির্বাচনকে ছয় দফার ম্যান্ডেট হিসেবে নিয়েছেন। নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্য পেলেন তিনি। ভোট পড়েছিল শতকরা ৫৫ ভাগ। প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৭৫ ভাগ আওয়ামী লীগের বাক্সে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের ভেতর ১৬০টিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এর সঙ্গে সংযুক্ত হয় মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৭টি আসন। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের ভেতর ২৮৮টি আওয়ামী লীগের দখলে আসে। এক ইউনিট ভেঙে দেয়ার ফলে ৭০ সাল থেকে পশ্চিম পাকিস্তান নামে কোনো প্রদেশ ছিল না। তার পরিবর্তে চারটি প্রদেশের পুনঃজন্ম হয়। যথা- পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান নাম খাইবার পাকতুনখাওয়া)। ’৭০-এর নির্বাচনে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। তবে বঙ্গবন্ধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতো নয়। শোনা যায় যে, পাকিস্তানের সামরিক এবং বেসামরিক গোয়েন্দারা নাকি এই মর্মে রিপোর্ট দিয়েছিল যে, কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তাহলেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ’৫৪-’৫৬ সালের মতো রাজনৈতিক খেলা খেলবে। বিধিবাম। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের বলে দিলেন যে, ছয় দফা থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। অতীতের ঘটনা স্মরণে থাকায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সব নির্বাচিত জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ১৯৭১-এর ৩ ফেব্রুয়ারি রমনা মাঠে জনসমক্ষে এই মর্মে শপথ পড়ালেন যে, তারা কোনো অবস্থাতে ছয় দফা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে এক ইঞ্চিও সরে আসবেন না।
সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের বিজয় এবং ছয় দফার ব্যাপার বঙ্গবন্ধুর অমননীয় মনোভাবের কারণে ভুট্টো চিন্তিত হয়ে পড়েন। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি আইয়ুবের মন্ত্রিসভায় ৭ বছরের অধিক পররাষ্ট্র দপ্তরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। একপর্যায়ে তিনি আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার প্রস্তাব করেছিলেন। ’৬৮-৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি আইয়ুব বিরোধী ভূমিকা নিয়ে পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হন এবং পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের স্বঘোষিত একমাত্র প্রতিনিধি বনে যান। তিনি প্রতিজ্ঞা করে বসলেন যে, আওয়ামী লীগকে এককভাবে ক্ষমতায় আসতে দেবেন না। যে জন্য কখনো বললেন- এদিকে আমি, ওদিকে তুমি; আবার বললেন- দুটি সংবিধানের কথা। সর্বোপরি তার পৈতৃক গৃহ লারকানায় পাকি জেনারেলদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ঘটানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। কেন তিনি ছয় দফা আতঙ্কে আক্রান্ত হয়েছিলেন? নির্বাচনের পর তিনি তার দলকে ছয় দফা কার্যকর হলে কি প্রতিক্রিয়া হবে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে বলেন। ভুট্টোর বন্ধু এবং এক সময়ের মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফি রাজার বইতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান হবে একটি শিথিল ফেডারেশন। চার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের ৩৮০০ কোটির ভার পশ্চিম অঞ্চলকে বহন করতে হবে। তিন হাজার কোটি টাকার দেশি ঋণের পুরো বোঝা টানতে হবে পশ্চিমাঞ্চলকে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়ের মাত্র শতকরা ২৪ ভাগ বহন করবে। তা ছাড়া অতীতের বৈষম্যের ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রশ্ন আসবে। এই তথ্য জানার পর ভুট্টোর মাথা আর ঠিক ছিল না। অতএব পাকিস্তানে ভাঙার কাজটা তিনিই গ্রহণ করলেন।
অনেক ওয়াইজ ম্যান বলে থাকেন যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। অনেকে বলেন যে, তিনি স্বাধীনতা চাননি। তিনি উন্মুক্ত রাজনীতি করতেন। তার লক্ষ্য বাঙালির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। যে জন্য তিনি ছয় দফা দিয়ে তার বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করেন। ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণীত হলে পাকিস্তানের পুরো কর্তৃত্ব বাঙালির হাতে চলে আসে, কেননা পার্লমেন্ট গঠিত হলে তাতে পূর্ব পাকিস্তানিরা স্থায়ীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন। অতএব বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলার প্রয়োজন কোথায়? তিনি তো ছয় দফার ব্যাপারে এতটুকু আপস করেননি। তা করলে তাকে আপসকামী বলা যেত। যখন পাকিস্তানিরা দাবি না মেনে আঘাত করে বসল, এখন তিনি প্রত্যাঘাতের নির্দেশ দিলেন। ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতায় পাকিস্তানের শেষ সৈন্যটি বিতাড়িত না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে বললেন। অবশ্য কেউ কেউ বিশেষ করে কিছু তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তা বলে থাকেন যে, পাকিস্তান ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আমাদের উচিত ছিল তাদের আক্রমণ করা। আমরা ৯ মাস চরম অত্যাচার, নিপীড়ন এবং গণহত্যার শিকার হওয়ার পরও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মাত্র ১১টি দেশ আমাদের অনুক‚লে ভোট দিয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হলে একটি ভোটও (এমন কি ভারতেরও) আমাদের কপালে জুটত না। আফ্রিকার বায়ফ্রোর মতো অবস্থা হতো। সবচেয়ে বড় কথা সিভিল সার্ভিসে কর্মরত বাঙালিরা কতজন সাড়া দিতেন, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। শতকরা দশমিক ১ একভাগ সিভিল সার্ভিস সদস্যও মুজিবনগরে যাননি। যদিও অসহযোগ আন্দোলনের সময় শতকরা একশভাগের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল।
ছয় দফা কেন বাঙালির মুক্তিসনদ এটা বুঝতে আর কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ২১ দফা নিয়ে তৎকালীন নেতারা নয়-ছয় করেছিলেন। ছয় দফা অর্জনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অটল, সেই সঙ্গে তার সহকর্মীরা। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফা দাবি আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান করা হয়েছিল। সেদিন ঢাকাসহ তৎকালীন প্রদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়েছিল। রাজপথ সংগ্রামী জনতার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আর থামেনি। হয়তো গতি কখনো কখনো শ্লথ হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে এই উপলব্ধি আসে যে জাতি হিসেবে তাদের বাঁচতে হলে ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য তাদের লড়তে হবে। তারা বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিলেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রতিটি বাঙালি অংশগ্রহণ করলেন। ৩০ লাখ শহীদ আর ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো বাঙালিরা পেল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। অতীতে কোনো বাংলার শাসক দিল্লি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখলে সেটি হতো তার স্বাধীনতা। ভূস্বামীরা স্বাধীনতা ভোগ করলে সেটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। জনগণ স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে ছুটে গেছেন, জনগণকে বলেছেন ছয় দফার কথা। সেটি জনগণের হৃদয়ে গ্রথিত হয়েছিল বলেই তারা ১৯৭১ সালে অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে মুক্ত করেছেন। ছয় দফা, বঙ্গবন্ধু এবং জনতা এক এবং অভিন্ন সত্তা হয়ে গেলেন। আর সে জন্য আবার নেতাদের ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু হলেন হাজার বছরের সেরা বাঙালি।
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ : সাবেক ইপিসিএস, কলাম লেখক।