১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শাহবাগের বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র দখল, সেখান থেকে ঘোষণা প্রচার এবং বাংলাদেশের নব্য মিরজাফরদের কীর্তিকলাপের বিবরণসহ পূর্বাবর প্রাসঙ্গিক ঘটনাসমূহের বস্তুনিষ্ঠ বিশদ বর্ণনা একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নির্মোহভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের দিবাগত রাত ১০টা থেকে ১৫ আগস্টের ভোর ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতার, শাহবাগ কেন্দ্রে শিফট ইনচার্জ হিসেবে আমি কর্মরত ছিলাম। আমার সঙ্গে আরো তিনজন ছিলেন। তারা হলেন সর্বজনাব মোহাম্মদ আলী, সাব এসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ও আনোয়ার হোসেন, রেডিও টেকনিশিয়ান। আরো একজন রেডিও টেকনিশিয়ান ছিলেন যার নাম এ মুহ‚র্তে আমার মনে নেই। ওই সময় বাংলাদেশ বেতারের হোম সার্ভিসের অনুষ্ঠান রাত ১২টায় শেষ হয়ে যেত এবং এক্সটারনেল সার্ভিসের অনুষ্ঠান রাত ২-৩০ মিনিটের শেষ হতো, এক্সটারনেল সার্ভিসের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সব স্টুডিও ও যন্ত্রপাতি বন্ধের কাজ তদারকি করে যথারীতি রাত প্রায় ৩টায় শিফট ইনচার্জের কক্ষে বিছানায় শুয়ে পড়ি। আমার কক্ষের পশ্চিম পাশে মেনটেইনেন্স কক্ষের উঁচু টেবিলে মোহাম্মদ আলী শুয়ে পড়ে। রাত আনুমানিক ৪-৩০ মিনিট থেকে ৪-৪৫ মিনিটের সময় গোলাগুলির বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। কিছু শব্দ রমনা পার্কের পূর্ব দিকে মন্ত্রীপাড়া থেকে আসছিল এবং কিছু শব্দ ধানমন্ডি এলাকা থেকে আসছিল। কেন জানি গোলাগুলির বিকট আওয়াজগুলো আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। তাই পাশের কক্ষ থেকে মোহাম্মদ আলীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। তার সঙ্গে আলোচনা করলে সে বলে যে বঙ্গবন্ধুকে আগামীকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেবে। বোধ করি পুলিশ বাহিনী গোলাগুলি করে মহড়া দিচ্ছে। তারপর আমরা যার যার কক্ষে শুয়ে পড়ি। কিন্তু আমার আর ঘুম আসছিল না। এপাশ-ওপাশ করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলাগুলির শব্দ শেষ হয়ে যায়। পরে আমি জানতে পেরেছি রমনা পার্কের পূর্ব পাশ থেকে যে গোলাগুলির শব্দ আসছিল ওগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তদানীন্তন কৃষিমন্ত্রী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা থেকে। আর ধানমণ্ডি থেকে যে গোলাগুলির শব্দ আসছিল তা ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি এবং তদান্তীন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির বাসা থেকে। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক চলে যাওয়ার পর আনুমানিক ভোর পৌনে ৬ ঘণ্টায় শিফট ইনচার্জের কক্ষের দক্ষিণ পাশের জানালা দিয়ে আর্মির বুটের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি আর্মিরা রাইফেল উঁচিয়ে দৌড়ে পুলিশ ব্যারাকের দিকে যাচ্ছে। এদের মধ্যে দু’তিনজন রাইফেল দিয়ে উপরের দিকে ফাঁকা গুলি করতে করতে প্রচণ্ড জোরে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করে সামনের দিকে এগোচ্ছে, ভোর হয়ে যাওয়াতে পুলিশ সদস্যরা ঘুম থেকে উঠে কেউ কেউ দাঁত ব্রাশ করছিল, কেউ কেউ বারান্দায় বসে হাত মুখ ধুচ্ছিল। আমিও উপরের দিকে ফাঁকা গুলির শব্দ ও ‘হ্যান্ডস আপ’-এর শব্দে পুলিশ সদস্যরা হতচিকত হয়ে দুহাত তুলে আর্মির কাছে স্যারেন্ডার করে। আমি দক্ষিণের জানালা দিয়ে এ দৃশ্য দেখতে পাই। তখন আমি আসন্ন মহাবিপদের আশঙ্কা করে কালবিলম্ব না করে লুঙ্গি ও গেঞ্জি খুলে ফেলে আমার সঙ্গে থাকা ছাই রঙের প্যান্ট, হাফহাতা হলুদ শার্ট ও জুতা পরে ফেলি, মুহ‚র্তের মধ্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেও পরক্ষণেই সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে মনের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে আসন্ন মহাবিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেই। তখন স্পষ্টতই আন্দাজ করতে পেরেছি যে, একটা অঘটন ঘটে গেছে। কিন্তু এত বড় পৈশাচিক নারকীয় হত্যাকাণ্ড যে ঘটে গেছে তা তখনো কল্পনা করতে পারিনি। আমার পাশের রুমে গিয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত সহকর্মী, মোহাম্মদ আলীকে পিঠে জোরে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগাতে চেষ্টা করি। কিন্তু সে এতই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ছিল যে আমার ধাক্কাধাক্কি সত্ত্বেও ঘুম থেকে না উঠে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বলে যে, স্যার আমি একটু পরে উঠছি। তাকে আর ঘটনা বলার মতো সময় ছিল না। আমি শিফট ইনচার্জের কক্ষে ফিরে গিয়ে পায়চারী করতে থাকি, আমার কক্ষের উত্তর পাশের এফ এম ট্রান্সমিটার কক্ষ, এর পশ্চিম পাশে রেকর্ডিং কক্ষ এবং তারপরের পশ্চিমেই প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (সধংঃবৎ পড়হঃৎড়ষ ৎড়ড়স)। আমি যখন আমার কক্ষে পায়চারী করছি এর তিন চার মিনিটের মধ্যে পাঁচ-ছয়জন আর্মি অফিসার কয়েকজন জোয়ানসহ এফ এম ট্রান্সমিটারের কক্ষে প্রবেশের পশ্চিমের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করে আর্মস উঁচিয়ে শিফট ইনচার্জের কক্ষের দিকে এগুতে এগুতে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘শিফট ইনচার্জ কে? শিফট ইনচার্জ কে?’ আমি মনোবল অটুট রেখে আমার কক্ষ থেকে এফ এম ট্রান্সমিটারের কক্ষে প্রবেশের দরজা পর্যন্ত এগোই, দেখতে পাই সবাই আর্মির খাকি ড্রেস পরা এবং মেজর ডালিমসহ দু’তিন জনের ড্রেসে রক্তের বিন্দু বিন্দু দাগ। আমার সামনে তখন সঙ্গীন উঁচিয়ে সাক্ষাৎ যমদূতরা দাঁড়ানো। ঘটনার নৃশংসতা বুঝতে আমার আর বাকি রইল না। পূর্ব মানসিক প্রস্তুতি থাকায় আমি তখন মানসিকভাবে অবিচল, এও বুঝতে পারি এ কিলারদের সামান্যতম বিরুদ্ধাচারণ করা মানে আমার জীবন প্রদীপ মুহ‚র্তের মধ্যে নিভে যাওয়া।
মেজর ডালিমের ‘শিফট ইনচার্জ কে?’ জিজ্ঞাসার জবাবে আমি নিজেকে শিফট ইনচার্জ বলে পরিচয় দেই। তখন ডালিম রিভলবার উঁচিয়ে আমার বুকে ধরে বলেন, ঝযবরশয গঁলরন ধহফ ধষষ যরং মধহম যধং নববহ শরষষবফ. অৎসু যধং ঃধশবহ ঢ়ড়বিৎ. আমি এখন বেতারে ঘোষণা দেব। আপনি সব কিছু অন করে দিন। আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তারা সবাই আমাকে নিয়ে শিফট ইনচার্জ কক্ষে প্রবেশ করে আর্মস উঁচিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে একজন মেজর শাহরিয়ার আমার কাছে শিফটের অন্যান্য স্টাফ কোথায় জানতে চান। তখন আমি তাকে পাশের কক্ষে ঘুমন্ত মোহাম্মদ আলীর কাছে নিয়ে যাই। তাকে কয়েকজন অফিসার ও জোয়ান অনুসরণ করে। মোহাম্মদ আলীকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগতে বলি। কিন্তু সে ঘুম থেকে না উঠে আমার দিকে না তাকিয়েই আড়মোড় দিয়ে বলে ‘স্যার আমি কিছুক্ষণ পরে উঠছি’। সঙ্গে সঙ্গে এক আর্মি অফিসার তার রিভলবারের বাট দিয়ে মোহাম্মদ আলীর কোমরের নিচে সজোরে আঘাত করে। প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে সে ঘুম থেকে উঠে টেবিলে বসে তার সামনে আর্মি অফিসার ও জোয়ানদের দেখতে পায়। তখন সে প্রচণ্ড ভয়ার্ত। পরিস্থিতির বাস্তবতা ও ভয়াবহতা বুঝানোর জন্য তৎক্ষণাৎ আমি তার হাত সজোরে চেপে ধরি। অতঃপর মেজর ডালিমসহ অন্যান্য আর্মি অফিসাররা আমাকে ও মোহম্মদ আলীকে প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। এ কক্ষে এসে আমার সঙ্গে আরো দুই সহকর্মীকে ভয়ার্ত চেহারায় দেখতে পাই। এখানে এসে মেজর ডালিম পুনরায় আমাকে সব যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও অন করে দেয়ার জন্য বলেন। মেজর শাহরিয়ারের হাতে থাকা একটি রেডিও রিসিভার দেখিয়ে বলেন যে সে এখন স্টুডিও থেকে ঘোষণা দেবেন; যদি এই ঘোষণা রেডিওতে শোনা না যায় তবে তিনি আমাদের শেষ করে দেবেন বলে ভয় দেখান। আমি তখন আমার সহকর্মীদের নিয়ে সব যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও অন করে দেই। কিন্তু আমি মনে মনে ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত। কারণ আমি জানি শাহবাগ স্টুডিও থেকে ঘোষণা দিলেও এই ঘোষণা রেডিওতে সম্প্রচারিত হবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত মিরপুর ও সাভারের প্রেরণ যন্ত্র (ঞৎধহংসরংংরড়হ) চালু হয়। তখন আনুমানিক ভোর ৬টা ৫ মিনিট। অধিবেশন শুরু হয় ভোর সাড়ে ছয়টায়। তদুপরি প্রেরণ কেন্দ্রের শিফট ইনচার্জ যদি এই ঘোষণা সম্প্রচার করতে রাজি না হয় তবে তাদের ঘোষণা রেডিওতে সম্প্রচার হবে না। আমি তখন সাহস করে মেজর ডালিমকে বলি যে, মিরপুর প্রেরণ কেন্দ্রের যন্ত্র অন না করলে এখান থেকে ঘোষণা দিলেও তা রেডিওতে প্রচারিত হবে না। ডালিম তখন রাগত কণ্ঠে আমার কাছে কী করতে হবে জানতে চান। উত্তরে আমি তাকে বলি যে, মিরপুর কেন্দ্রের শিফট ইনচার্জ দ্বারা ট্রান্সমিটার অন করালে আপনার ঘোষণা সম্প্রচারিত হবে। তখন তিনি অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠে আমাকে মিরপুর কেন্দ্রের শিফট ইনচার্জকে টেলিফোন করতে বলেন। আমার সামনে তখনো পিস্তল উঁচিয়ে কিলার গ্রুপের চার-পাঁচ জন আর্মি অফিসার দাঁড়ানো। আমি প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফিক্সড মেগনেটো টেলিফোনে মিরপুর প্রেরণ কেন্দ্রের শিফট ইনচার্জ জনাব আব্দুল লতিফের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী, জনাব লতিফকে আনুপার্বিক কোনো সূচনা না দিয়ে টেলিফোনে সরাসরি বলি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর অফিসাররা আমার সামনে দাঁড়ানো আছে। তারা ঘোষণা দেবে; আপনি ট্রান্সমিটার অন করে দিন।’ উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের জুন মাসে রেডিও পাকিস্তান মিরপুর কেন্দ্রে যোগদান করার পর থেকে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমি ও জনাব আব্দুল লতিফ একসঙ্গে চাকরি করার সুবাদে এবং সমবয়সী হওয়াতে (মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস বাদে কারণ তখন আমি মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রকৌশল বিভাগের কর্মী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি) এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় যে, আমাদের পরস্পরের সম্বোধন অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি পেরিয়ে ‘আপনি’ থেকে ‘তুই’-এ চলে এসেছিল। আমার কথা শুনে লতিফ বিশ্বাস করতে না পেরে হতভম্ব হয়ে আমাকে বলেন, ‘এই শালা, তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। তোকে পাবনার হেমায়েতপুরের পাগলা গারদে পাঠাতে হবে।’ তখন আমি তাকে বলি, ‘লতিফ, বি সিরিয়াস। আর্মির অফিসাররা আমার সামনে দাঁড়ানো, তুমি ট্রান্সমিটার অন করে দাও। তারা এখন ঘোষণা দেবে।’
সম্মানিত পাঠকগণ জনাব লতিফ কর্তৃক আমাকে সম্বোধন করা শ-বর্গীয় ওই শব্দটি লেখার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। শুধুমাত্র ওইদিন ভোরের ঘটনা প্রবাহের সঠিক চিত্রটি তুলে ধরার জন্য এ শব্দটি চয়ন করেছি।
আমাদের দুজনের কথোপকথন আঁচ করতে পেরে মেজর ডালিম আমার হাত থেকে টেলিফোনের হ্যান্ড সেটটা কেড়ে নিয়ে জনাব লতিফকে অকথ্য ভাষায় মা-বাপ তুলে গালিগালাজ শুরু করেন এবং বলেন যে- তুই এখন ট্রান্সমিটার অন করে দে। তা না হয় এখন আমি আর্মির গাড়ি পাঠাচ্ছি, তোকে শেষ করে দেব। এগুলো বলে মেজর ডালিম পুনরায় হ্যান্ড সেটটা ফেরত দিয়ে লতিফকে আবার টেলিফোন করতে বলেন। আমি আবার জনাব লতিফকে ট্রান্সমিটার অন করতে বলি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই লতিফ মিরপুর কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার অন করে দেন যা আমি শাহবাগ প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষের রিসিভার মনিটর করে নিশ্চিত হই।
কিন্তু কিলার গ্রুপের হাতে কোনো লিখিত ঘোষণাপত্র ছিল না। আমার নিকট থেকে কাগজ ও কাঠ পেন্সিল চেয়ে নিয়ে প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসেই মেজর ডালিম ‘ঘোষণাটি’ লেখেন। এরপর তিনি তার ঘোষণা প্রচারের জন্য স্টুডিওতে নিয়ে যেতে বলেন এবং মেজর শাহরিয়ারের হাতে থাকা রেডিও রিসিভারটি দেখিয়ে আমাকে বলেন তিনি এখন স্টুডিও থেকে ঘোষণা দেবেন। যদি এই ঘোষণা মেজর শাহরিয়ারের হাতে থাকা রেডিওতে শোনা না যায় তবে আমাকে শেষ করে দেয়া হবে। মেজর ডালিমের কথানুসারে তাকে আমি ৪নং স্টুডিওতে নিয়ে যাই। কনট্রোলিং বুথে একজন রেডিও টেকনিশিয়ান বসিয়ে লাইন পরীক্ষা করা হয়। মেজর ডালিম আমাকে স্টুডিওর করিডোরে রেডিও রিসিভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর শাহরিয়ারের কাছে থাকতে বলেন। মেজর ডালিম ৪নং স্টুডিও থেকে আনুমানিক ভোর ৬টা ১০ মিনিটে ঘোষণা দেন, ‘স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে, খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। সারা দেশে কারফিউ জারি করা হইয়াছে।’ কিছুক্ষণ পরপর এই ঘোষণা প্রচার করতে থাকে। পরে রেকর্ডিং করে এই ঘোষণা বার বার প্রচার করা হয় এবং ঘোষণার ফাঁকে ফাঁকে তাদের নির্দেশ মতো গান বাজানো হতে থাকে। এর মধ্যে হঠাৎ সিভিল ড্রেস পরা চুল খাটো ২ জন যুবককে ৩ নং স্টুডিওতে বিমর্ষ মুখে বসে থাকতে দেখতে পাই। এক ফাঁকে আমি সাহস করে মেজর শাহরিয়ারের কাছে তাদের পরিচয় জানতে চাই। মেজর শাহরিয়ার স্বাভাবিকভাবে বলেন যে, একজন রক্ষী বাহিনীর লিডার এবং অপরজন ডেপুটি লিডার, উত্তর শুনে আমি যা বুঝার বুঝে নিলাম।
তাদের ঘোষণা রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার পর তাদের উত্তেজনা প্রশমিত হয়। কিন্তু আমি ভাবছি কোনো কারণে যদি কমার্শিয়াল বিদ্যুৎ লাইন চলে যায় তবে অনুষ্ঠান চালানো সম্ভব হবে না। কারণ রেডিওর নিজস্ব ইমারজেন্সি জেনারেটরের ব্যাটারি খারাপ। তখন তারা মনে মনে ভাববে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সাবোটেজ করছি। সে জন্য বিষয়টি আমি মেজর ডালিমকে আগেই জানাই। এ কথা শুনে মেজর ডালিম আমাকে স্টুডিওর ভেতর থেকে তার সঙ্গে শাহবাগ রেডিও অফিসের বিল্ডিংয়ের সামনের বাগানে নিয়ে যান। সেখানে আর্মি এন.সি.ও এবং জে.সি.ও সহ পঞ্চাশ ষাটজন আর্মির জোয়ান দেখতে পাই। সেখানে এসে মেজর ডালিম একজন সুবেদারকে ডেকে বলেন, ‘মিনিট পনেরর মধ্যে প্রেসিডেন্টকে রেডিও সেন্টারে নিয়ে আসছি। তোমরা সবাই প্রস্তুত হয়ে যাও। প্রেসিডেন্ট আসলে তাকে প্রেসিডেন্ট স্যালুট দিতে হবে।’ তারপর তিনি আমাকে দেখিয়ে অন্য একজন নায়েক সুবেদারকে বলেন যে গেটের বাইরে রক্ষী বাহিনীর গাড়ি থেকে উনাকে একটি ব্যাটারি খুলে দেয়ার ব্যবস্থা কর। এ কথা বলে সে তার জিপ নিয়ে বাইরে চলে যান। আমি তখন নায়েক সুবেদারকে বলে স্টুডিওর ভেতরে গিয়ে কিছু টুলসসহ রেডিও টেকনিশিয়ান আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে এসে ওই নায়েক সুবেদারের সহায়তায় রেডিও অফিসের গেটের বাইরে থাকা রক্ষী বাহিনীর দুটি খালি ট্রাকের মধ্যে একটি ট্রাক থেকে একটি ব্যাটারি খুলে নেই। বাইরে এসে দেখতে পাই যে শাহবাগের চৌরাস্তার মোড়ে পিজি হাসপাতালের সামনে (বর্তমান পূবালী ব্যাংকের সঙ্গে) রেডিও অফিসের দিকে মুখ করা দুটো ট্যাংক দাঁড়ানো। আনোয়ারের সহায়তায় আমি ব্যাটারিটি নিয়ে রেডিও অফিসের ভেতরে ঢুকে রেডিওর ক্যান্টিন পেরিয়ে জেনারেটর কক্ষে নিয়ে ব্যাটারিটি সংস্থাপন করি। এখানে এসে দেখতে পাই যে, পুলিশ ব্যারাকের পশ্চিম পাশের এবং শিফট ইনচার্জের কক্ষের দক্ষিণ পাশের মাঠে প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ জন রক্ষী বাহিনীর জোয়ানকে নিরস্ত্র করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তখন আমি বুঝতে পারি ৩নং স্টুডিওতে আটকে রাখা রক্ষী বাহিনীর ২ জন অফিসার দুটি ট্রাক ভর্তি করে অস্ত্রশস্ত্রসহ রক্ষী বাহিনীর জোয়ানদের নিয়ে রেডিও অফিস রক্ষা করতে এসেছিল। কিন্তু বোধ করি ট্যাংকগুলো দেখে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারবে না ভেবে তারা আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ট্যাংকগুলোতে কোনো গোলাবারুদ ছিল না। যদি রক্ষী বাহিনীর এই অফিসারদ্বয় তাদের জোয়ানদের নিয়ে এই কিলার গ্রুপের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো তবে আমার বিশ্বাস কিলার গ্রুপ নিশ্চিতভাবে পরাজিত হতো এবং শাহবাগ রেডিও সেন্টার কিলারদের দখলমুক্ত রাখতে পারত। অসমাপ্ত
যা হোক আমি প্রসঙ্গান্তরে চলে এসেছিলাম। মেজর ডালিম যখন বেতারে ঘোষণা দিয়ে বলছিলেন যে, খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে তখন এই নামে সেনাবাহিনীর কোনো সিনিয়র অফিসার আছে বলে আমার জানা ছিল না। কারণ সেনাবাহিনীর প্রায় সব সিনিয়র অফিসারদের নামই আমি জানতাম।
পনের মিনিটের মধ্যে মেজর ডালিম খোন্দকার মোশতাক আহমদকে রেডিও অফিসে নিয়ে আসেন। মেজর ডালিম তার জিপ থেকে নেমে মোশতাকের গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমি তখন রেডিও অফিসের বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ানো। মোশতাক গাড়ি থেকে নামলেন। পরনে তার কালো সেরোয়ানি, কালো চোস্ত পায়জামা, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ও কালো রঙের মোশতাক টুপি। বাংলাদেশের এই নব্য মীরজাফর গাড়ি থেকে নেমে কিলার গ্রুপদের অধীনস্থ সৈন্যদের স্যালুট গ্রহণ করল। আর আমি খোন্দকার মোশতাককে দেখে বিস্ময়ে হতবাক। দুচক্ষুকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আমি জানতাম তিনি বঙ্গবন্ধুর খুবই আস্থা ও প্রিয়ভাজন। তাঁর মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী বাণিজ্যমন্ত্রী। এই বিয়োগান্তক ঘটনার মাত্র দেড় মাস পূর্বে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে তদানীন্তন বাণিজ্য সচিব জনাব সিদ্দিকুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে সে শাহবাগ রেডিও অফিসে এসেছিলেন সরকারের বাৎসরিক বাণিজ্য নীতির ওপর একটি ভাষণ রেকর্ড করতে। তখনো আমি ডিউটিতে ছিলাম এবং আমার তত্ত্বাবধানেই তার ভাষণ রেকর্ড করা হয় এবং সম্প্রচারিত হয়। সব কিছু ডিঙিয়ে খোন্দকার মোশতাককে বিশ্বাসঘাতকের মুখ্য ভূমিকায় দেখে বারবার একটি প্রবাদ আমার মনে পড়ছিল তাই হলো- ঞৎঁঃয রং ংঃৎধহমবৎ ঃযধহ ভরপঃরড়হ।
পরক্ষণেই আমার মনে পড়ে যায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের ভেতরে একটি কুচক্রীমহলের কথা। যার নেতৃত্বে ছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং তার সঙ্গে ছিল তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষীসহ গুটি কয়েক এমএলএ ও এসপিএ। এই কুচক্রী গ্রুপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগসাজশে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা মুজিবনগরে এই ধুয়ো তুলেছিলেন যে- বঙ্গবন্ধুকে জীবিত চাই না স্বাধীনতা চাই। কিন্তু তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বলিষ্ঠ ও সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে মোশতাক সংসদের ওই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরে বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু খোন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মোশতাকের পরিবর্তে লন্ডন থেকে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতিসংঘে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। সম্মানিত পাঠকগণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে ১৯৭১ সালে মোশতাকের ওই ষড়যন্ত্রের গভীর যোগসূত্র আছে বলেই তা আপনাদের জ্ঞতার্থে তুলে ধরা হলো।
স্যালুট প্রদানের পর মেজর ডালিম খোন্দকার মোশতাক আহমদকে রেডিও বিল্ডিংয়ের ভিতরে ২ নং স্টুডিওতে নিয়ে বসান। আমার সামনেই মোশতাক তদানীন্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে রেডিও অফিসে আনতে মেজর ডালিমকে গাড়ি পাঠাতে নির্দেশ দেন। মেজর ডালিম কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে রেডিও অফিসে নিয়ে আসেন। তিনি বেশ হাসিখুশি মুডে ২ নং স্টুডিওতে ঢুকে মোশতাকের সাথে গিয়ে বসেন। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আমাকে দেখে কিছুটা অবাকই হলেন বলে মনে হলো। তিনি আমাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সাল থেকেই ভালোভাবে চিনেন। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিল্ডিংয়ে আমরা এক সঙ্গেই থাকতাম। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। খোন্দকার মোশতাক তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মেজর ডালিমকে নিয়ে ২নং স্টুডিওতে কিছুক্ষণ সলাপরামর্শ করলেন। তারপর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খোন্দকার মোশতাক আহমদের একটি ভাষণের খসড়া লিখে দেন। অতঃপর মোশতাকের ওই ভাষণটি রেকর্ড করা হয় এবং আনুমানিক ভোর ৮টায় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কর্তৃক লিখিত মোশতাকের ওই ভাষণটি রেডিওতে সম্প্রচার করা হয়। অথচ এই মোনাফেক তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে বঙ্গবন্ধু রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনার মতো করে ইত্তেফাকের একজন রিপোর্টার থাকাকালীন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল থেকে নমিনেশন দিয়ে এমএনএ করে প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় নেতাদের নিয়ে গণভবনের একটি কক্ষে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শেষ করে অন্য কক্ষে যান। ওই বৈঠকে উপস্থিত তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর পায়ের স্যান্ডেলদ্বয় তার চরণযুগলে ঢুকিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন। এই কাহিনীটি আমি ওই বৈঠকে উপস্থিত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার তৎকালীন এমপি, বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ও বন্ধু সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন সিনিয়র এডভোকেট মরহুম সিরাজুল হকের মুখ থেকে ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসের কোনো একদিন মিন্টু রোডের একটি সরকারি বাড়িতে বসে শুনেছি। ওই বাড়িতে তখন পাবলিক প্রসিকিউটররা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাজসাক্ষীদের নিয়মিত ব্রিফিং দিতেন। ওই সময় তদানীন্তন আইন প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, মরহুম সিরাজুল হকের ছেলে বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাহারা খাতুন ও বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলামসহ সব পাবলিক প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। পাঠকগণ চাটুকার ও মোনাফেকরা যুুগে যুগে মহাপুরুষদের এভাবেই বিভ্রান্ত করে দেশ ও জাতির সর্বনাশ সাধন করে। এর পরের দৃশ্যপট ছিল আরো লজ্জাজনক, ধিক্কারজনক এবং অভাবনীয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল একটি মসিলিপ্ত অধ্যায় হয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে। এই কিলার গ্রুপ একে একে সেনাবাহিনী প্রধানসহ সব বাহিনী প্রধানদের শাহবাগের রেডিও অফিসের ২নং স্টুডিওতে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম খলনায়ক, নব্য মীরজাফর খোন্দকার মোশতাক আহমদের কাছে হাজির করায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর শাহবাগের বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র দখল, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ক্ষমতা দখলের ঘোষণা প্রচার ও পূর্বাপর প্রাসঙ্গিক ঘটনাসমূহের বিশদ বিবরণ একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর অবৈধ মোশতাক সরকারের প্রতি বিভিন্ন বাহিনী প্রধানের আনুগত্যের শপথবাক্যের খসড়া তৈরি করে দেন। আর তারা স্বেচ্ছায় আনুগত্যের শপথবাক্য পাঠ করেন যা রেকর্ড করে রেডিওতে সম্প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্সার ব্যাটালিয়নের একটি ক্ষুদ্র অংশ কিছু চাকরিচ্যুত তস্কর জুনিয়র অফিসারদের সহায়তায় গোলাবারুদহীন কয়েকটি ট্যাংক নিয়ে ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের রাখাল রাজা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে শাহবাগের রেডিও অফিসে এসে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেন। আর বিভিন্ন বাহিনী প্রধানরা তাদের পবিত্র কর্তব্য বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা না করে কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করে একজন নিকৃষ্টতম মীরজাফরের প্রতি তাদের আনুগত্যের শপথবাক্য পাঠ করেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু স্বয়ং লাল টেলিফোনে সেনাবাহিনী প্রধানকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন তিনি উপ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে টেলিফোন করেন। কিন্তু তার কোনো পজিটিভ রেসপন্স না পেয়ে আর কোনো ত্বরিত ব্যবস্থা নেননি। যদি তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দিয়ে চিফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের সহায়তায় অকুতোভয়ে নিজে কমান্ড পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যেতেন তবে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পাওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে বিদ্রোহী কিলার গ্রুপ নিশ্চিতভাবে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হতো বা নিহত হতো। পাশাপাশি বিমান বাহিনী প্রধানকে নির্দেশ দিয়ে শাহবাগ রেডিও সেন্টারে যুদ্ধ বিমান দিয়ে বোমাবর্ষণ করাতেন তবে নব্য মীরজাফর মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুরসহ কিলার গ্রুপের বেশির ভাগ সদস্যই নিহত হতো। তখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদতবরণ করার পরও জাতীয় চার নেতাসহ অনেক ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন যারা ওই ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের হাল ধরতে সক্ষম হতেন। তাই তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর কাপুরুষোচিত ভূমিকা ইতিহাসে মসিলিপ্ত অধ্যায় হয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে।
অথচ বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন সামরিক সচিব কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে কালবিলম্ব না করে নিজে গাড়ি নিয়ে ৩২নং ধানমন্ডির বাড়িতে রওনা হয়ে তার জীবন রক্ষার জন্য শেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ৩২নং রোডে ঢুকার মুখে কিলার গ্রুপ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই মহান দেশপ্রেমিক অফিসার শাহাদতবরণ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসীম আনুগত্য, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের যে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।
বিভিন্ন বাহিনী প্রধানরা ছাড়াও সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররাও রেডিও অফিসে এসে ২নং স্টুডিওতে খোন্দকার মোশতাকের পাশে বিভিন্ন চেয়ারে বসেছিলেন। মোশতাক ২নং স্টুডিওর কনট্রোলিং বুথ মুখ করা চেয়ারে বসেছিলেন। ঠিক তার দক্ষিণ পাশে চেয়ারে সিভিল ড্রেসে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ বসেছিলেন। তিনি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিলেন। আমি স্টুডিও ও বুথের মাঝের গøাস দিয়ে এ দৃশ্য দেখেছি। একবার তাকে দেখলাম খোন্দকার মোশতাককে একটি সিগারেট অফার করতে। কিন্তু মোশতাক তার অফার করা সিগারেটটি নিলেন না। প্রটোকল অনুযায়ী একজন ব্রিগেডিয়ার প্রেসিডেন্টের পাশে বসে সিগারেট খাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে তার ভেতরে থাকা প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রশমনের জন্য একটার পর একটা সিগারেট টানছিলেন।
এক পর্যায়ে দেখলাম সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২নং স্টুডিও থেকে বেরিয়ে স্টুডিওর ভেতরে করিডোরে ও মেইন দরজা পেরিয়ে বাইরের করিডোরে চলে এসেছেন। তার সঙ্গে তখন কিলার গ্রুপের অন্যতম প্রধান হোতা মেজর ডালিম। তারা দুজন করিডোরের মূল দিকে (যে দিকে ডিউটি অফিসারের কক্ষ এবং এরপর ট্রান্সমিশন সার্ভিস বিল্ডিং অবস্থিত) শেষ প্রান্তে গিয়ে করমর্দনরত অবস্থায় অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা বলছেন। আমি আমার স্টাফদের ডিউটি তদারকির ফাঁকে ফাঁকে স্টুডিওর ভেতর থেকে বেরিয়ে বাইরের করিডোরে এসে তাদের এই কথাবার্তা পর্যবেক্ষণ করেছি। আনুমানিক সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সোয়া ৯টা পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪৫ মিনিট তারা কথাবার্তা বলেছেন। উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কিলার গ্রুপের অন্যতম প্রধান হোতা মেজর ডালিমের এই দীর্ঘ সময় অন্তরঙ্গ কথোপকথন আমার কাছে খুবই ইঙ্গিতবাহী ও তাৎপর্যবহ রূপে মনে হয়েছে।
কিলার গ্রুপের শাহবাগ রেডিও অফিসের মিশন শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেলা প্রায় ১০টায় মেজর শাহরিয়ার পরবর্তী শিফটের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তাদেরকে চলে যেতে বলেন। আমি তখন পরবর্তী শিফট ইনচার্জ আমার সহকর্মী ও বন্ধু জনাব রিয়াজুল হকের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমার শিফটের লোকজনদের নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। শাহবাগের মোড় থেকে রিকশায় আমার বাসা বাংলাবাজারের দিকে রওনা হই। রিকশায় উঠে এই মহাপুরুষের কথা ভেবে আর অশ্রæ সংবরণ করতে পারছিলাম না। অবিশ্রান্ত ধারায় গন্ডুষ বেয়ে অশ্রæ বের হচ্ছিল যা রুমাল দিয়ে মুছেও শেষ করতে পারছিলাম না। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আমার অজস্র স্মৃতি মনে পড়ে যায়।
সেই ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে আমার মামার বাড়ি নরসিংদীর মেঘনা নদীর তীরে ঈদগা ময়দানের জনসভায় তখনকার তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনলবর্ষী বক্তৃতা শুনে প্রথম সেই কৈশোরেই আমার শরীরে শিহরণ জেগেছিল। সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এরপর বহুবার তাঁর কালজয়ী জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে উদ্বেলিত ও রোমাঞ্চিত হয়েছি। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্ত মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালির তীর্থভূমি, বঙ্গবন্ধুর ৩২নং ধানমন্ডি বাড়িতে এবং পুরানা পল্টনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ অফিস বহুবার গিয়েছি এবং একজন ক্ষুদ্র মানুষ হয়েও কয়েকবার তাঁর সান্নিধ্য লাভের দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছে। বেশ কয়েকবার তিনি তাঁর হাত দিয়ে আমার দু’গালে ও চিবুকে স্পর্শ করে আদর করে ধন্য করেছেন। তাঁর হাতের পরশের সে কি সম্মোহনী শক্তি। তাঁর পরশে সব শরীরে ও মনে বিদ্যুতের বেগে শিহরণ জাগত। তাই তো আমৃত্যু আমি তাঁর ভক্ত ও ভাবশিষ্য। ওই সময় রিকশায় এসব স্মৃতি আমার মনের গহীনে আঘাত করে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আর আমার ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আমাকেই রেডিওতে এই মহামানবের সপরিবারে হত্যার সংবাদ প্রচার করতে বাধ্য করা হলো। এ বেদনা ও গøানি আমাকে আমৃত্যু তাড়িত করে বেড়াচ্ছে।
আর বাংলাদেশের মানুষের চরম দুর্ভাগ্য, যে ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করেছেন, তাদের শত ভ্রƒকুটি ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বাংলার মানুষের জয়গান গেয়েছেন তাকেই কি না মুষ্টিমেয় পথভ্রষ্ট ও বিশ্বাসঘাতক বাঙালি কুলাঙ্গারের হাতে প্রাণ দিতে হলো। (সমাপ্ত)
প্রণব চন্দ্র রায় : মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাজসাক্ষী, বাংলাদেশ বেতারের অবসরপ্রাপ্ত আঞ্চলিক প্রকৌশলী; টরেন্টো প্রবাসী।