১৯৭২ সাল। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে নিবন্ধ লেখেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ লে. জে. জিয়াউর রহমান। লেখা থেকেই উদ্ধৃতি দেয়া যাক- ‘…তারপর এলো ১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক আন্দোলন। … ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। … ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনা শুরু হলে আমরা ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আশা করলাম, পাকিস্তানি নেতারা যুক্তি মানবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’ জিয়াউর রহমানের এই নিবন্ধটি বহুজনের স্মৃতিস্থ। এই মুহ‚র্তে এই নিবন্ধের কিঞ্চিত অংশ পুনঃস্মরণের কারণ, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা, ৭ মার্চকে স্বাধীনতা ঘোষণার গ্রিন সিগন্যাল মনে করা এবং শেখ মুজিবকে দেয়া বঙ্গবন্ধু উপাধি গ্রহণ করে তা লিখিত রূপে চর্চার উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমানের শাসনামল বঙ্গবন্ধুর ঋণ স্মরণের জন্য অনুক‚ল ছিল না। অন্য বহু ঘটনার উদাহরণ থাক। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি নিরীহ কবিতা লেখাও যে সেদিন সম্ভব ছিল না তার প্রমাণ ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের কবিতা অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে ‘আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি পাঠ করে নির্মলেন্দু গুণকে বাংলা একাডেমির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। মুজিব বিরোধী সেই প্রতিক‚ল ও রোষানলের পরিবেশকে কিছুটা আশ্বস্ত করতে নির্মলেন্দু গুণকে এই মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে হয়েছিল যে তিনি কারো রক্ত চাইতে আসেননি, কেবল ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলেন- তার কবিতার মাধ্যমে। কবিতায় নিরীহ গোলাপ, পলাশ, খসে পড়া ইট, না ফোঁটা কৃষ্ণচূড়ার গোপন মঞ্জুরি, কোকিল এবং স্বপ্নের মতো নির্দোষ রূপক ব্যবহারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে হয়েছিল তাঁকে। জাতির পক্ষ থেকে সাহিত্যের মাধ্যমে সেই ছিল প্রথম প্রকাশ্য কোনো সভায় বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। কবিতায় তিনি নিজেকে সমবেত সবার মতো বললেও ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে তিনি সমবেত সবার মতো নন। সমবেত সবার মতো অনুক‚ল পরিবেশে দশ দিকে মাইক বসিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা তিনি বলেননি। ‘তাঁর কথা বলতে এসেছি’ বলে যখন তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছিলেন সে সময় কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের সাহস পেতেন না। নিজের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ করার মতো বেহিসেবি মানুষের সংখ্যা সব সময় কম থাকে। ‘বুদ্ধিমান’ লোকের সংখ্যা সব সময় বেশি। যা হোক।
এখন ২০১৫। চল্লিশ বছরের ব্যবধানে ইতিহাসের সেই ভুল পাতা খসে গেছে। স্বাধীনতার স্থপতি এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের মৃত্যুময় ‘করুণ ১৫ অগাস্ট’ দীর্ঘদিন পাপ ও কলঙ্কের একটি তারিখ হয়ে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছিল। কয়েকজন খুনির বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার পর অভিশপ্ত সেই ১৫ আগস্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে বলে নির্ভার বোধ করেছে জাতি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে অভিশপ্ত সেই ১৫ আগস্ট কতটা অভিশাপমুক্ত হতে পেরেছে? বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অন্তত অর্ধেকাংশ বহাল তবিয়তে আছেন মানবাধিকারের (!) বিষয়ে সোচ্চার দেশ দুটিতে। পদে-সম্পদেও পিছিয়ে নেই। নতুন ষড়যন্ত্রের মালমশলা ও আবহ, তাও অনায়ত্ত নয়। শেকড়ে-বাকড়ে ডালপালা ছড়িয়েছে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। ভাবার কারণ নেই যে মোশতাক মারা গেছেন। তিনি আছেন। তার উত্তসূরিদের মধ্যে- এমনকি ১৫ অগাস্টের শোক সভাতেও খুঁজলে পাওয়া যাবে ‘মোশতাকদের’।
বঙ্গবন্ধুর জন্য মায়া কান্নাধারী সুবিধাবাদী রেডিমেড বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। যে কোনো স্বার্থ আদায়ের ভিত্তিপ্রস্তরের প্রাথমিক ইটও বঙ্গবন্ধু। তাঁকে নিয়ে কবিতা বা কলাম লিখলে এখন আর কারো জীবন ঝুঁকিময় ও অনিরাপদ হয় না বটে। এই সুযোগে সরকারি ও বেসরকারি লেখকরা বঙ্গবন্ধু পূর্ণিমা ভালোবাসতেন না অমাবস্যা, তা নিয়ে ইতোমধ্যে বহু পাতা লিখে ফেলেছেন। এমনকি বহুমাত্রিক অপরাধ করে অপরাধী নিজের জীবন ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করছেন। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা সাধারণ মানুষদের আজ আর কোথাও দেখি না। আবুল হাসানের ভাষায় কেবল কতগুলো রাজহাঁস দেখি। দশদিক মাইক বাজিয়ে যারা বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে এসেছি বলে দাবি করেন, আসলে কি তারা বঙ্গবন্ধুর কথা বলেন নাকি ১৫ আগস্টকে পুঁজি করে নিজেদের বাণিজ্যকে প্রসারিত করেন? তাদের কথার মধ্যে কত শতাংশ বঙ্গবন্ধুর কথা আর কত শতাংশ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কথা। কান পাতলে মাইক থেকে ভেসে আসা খুচরো-পাতি নেতাদের কথা শুনলে পরিষ্কার বোঝা যায় তারা আসলে বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে আসেননি। এসেছেন তাদের লোভ লালসার কথা বলতে। সেই কৌশল ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন বটে তবে তাদের মেকি ভালোবাসার ধ্বংসস্ত‚প থেকে নগ্নভাবে খসে খসে পড়ছে স্বার্থান্ধতার ইটকাঠ। কোনোমতেই ঢেকেঢুকে রাখা যাচ্ছে না। বহুমাত্রিক অপরাধ সংঘটনের হোতারাও বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করেন শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার ঢাল হিসেবে। বুকে-ঠোঁটে, পিঠে-পেটে, দেয়ালে-গাছে, আকাশে-পাহাড়ে পোস্টার ফেস্টুন ব্যানারে কতিপয় ‘বঙ্গবন্ধু প্রেমিক’ নিজেদের বিশাল ছবির পাশে বঙ্গবন্ধুকে তিল পরিমাণ জায়গা দিয়ে পারলে ৫৬ হাজার বর্গমাইল ছেয়ে ফেলে নিজের পাপ স্খলনের সুযোগ খুঁজছে। ১৫ অগাস্ট এই একটি দিনের জন্যও তারা তাদের বাণিজ্যিক মনকে কোথাও ফেলে আসতে পারেন না। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত অগ্রসরমান। ব্যবসা হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু’-ই যে সব ব্যবসার সেরা ব্যবসা সে কথা বাণিজ্য বুদ্ধির এই জুয়াড়িরা না বুঝলে আর কে বুঝবে।
বাড্ডার আদর্শ নগরের ‘আদর্শ নেতারা’ ঝুট ও পশুর হাটের ইজারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারিতে শেষ। আদর্শবাদী এই সব নেতারা আবার সবাই ‘সোনার বাংলা সমাজ কল্যাণ সংস্থার সদস্য’। কুষ্টিয়ায় জাতীয় শোক দিবসে র্যালি শেষে আওয়ামী লীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে একজন মারা গেছেন। ছুরির আঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত দশ জন। এরা পরস্পর প্রতিপক্ষ হয়েছে পরিতোষ পাওয়ার লক্ষ্যে। এ জাতীয় উদাহরণের শেষ নেই। কৃত্রিম বঙ্গবন্ধু প্রেমিকদের বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর জন্য সব ভালোবাসা কেবল ক্ষমতাকালে ঢেলে না দিয়ে কিছুটা অন্তত প্রতিক‚ল সময়ের জন্য রেখে দিন। চারপাশের ‘চাটার দল’ ও ‘গমরুলরা’ দুঃসময়ে উধাও হলে ‘তাঁর কথা বলতে এসেছি বললে’- সেই বলার মধ্যেই গৌরব।
জয়া ফারহানা : কলাম লেখক।