আগস্ট মাস এলেই স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একজন আবাসিক ছাত্র ছিলাম। ৪০ বছর আগের কথা। কিন্তু মনে হয় যেন, এই তো সেদিন। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়। আমি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জগন্নাথ হল শাখার একজন কর্মী ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি যখন বাকশাল গঠন করেন তখন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ একীভূত হয়ে একমাত্র ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সুবাদে আমি জাতীয় ছাত্রলীগের একজন সদস্য হই। জাতীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বর্তমানে জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রদ্ধেয় সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসবেন। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে সপ্তাহকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্ণিল সাজে সাজানো হচ্ছিল। ১৪ আগস্ট আমরা হলের ছাত্ররা গভীর রাত পর্যন্ত জেগেছিলাম। হলের ভেতরে রাস্তাগুলোতে চারুকলার শিক্ষার্থীরা আলপনা আঁকছিলেন। ১৫ আগস্ট আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাবো তা হলের নেতারা জানিয়ে দিলেন এবং প্রত্যেককে গলায় পরার জন্য একটি করে লাল স্কার্ফ দিলেন। এরপর আমরা যার যার রুমে চলে গেলাম। ১৫ আগস্ট অতি প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে সকালের নিত্যকর্ম শেষ করে প্যান্ট-শার্ট পরে সবেমাত্র স্কার্ফ গলায় পরছিলাম, এমন সময় পাশের রুমের একজন ছাত্র এসে আমাকে বলল, ‘খবর রাখেন? বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ আমি বললাম, ‘কী বলেন? অবিশ্বাস্য কথা’। প্রত্যুত্তরে সে আমাকে বলল, ‘রেডিও শুনুন, তখন বুঝতে পারবেন’। ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি জানার জন্য আমার রুমের কয়েকটি রুম পরে একটি রুমে রেডিও শুনতে গেলাম। রেডিও থেকে বারবার বলা হচ্ছিল- আমি মেজর ডালিম বলছি, ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ ওই মুহূর্তে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলাম। রাস্তায় নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় আবার হলে ফিরে এলাম। হলের প্রায় সব ছাত্র বাড়ি চলে যাচ্ছে। টিউশনি করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালাতে হতো বিধায় টিউশনি ধরে রাখার জন্য আমি আতঙ্কের মধ্যেও হলে থেকে গেলাম। দুপুরের দিকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ হলের ভেতরে ঢুকল। আমরা কয়েকজন ছাত্র দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জিপ দেখে খুবই ভয় পেলাম। জিপের মধ্যে বসা অবস্থায় একজন জুনিয়র অফিসার (সম্ভবত) আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনারা ভয় পাবেন না, আমাদের সহায়তা করুন। কিছু লোককে শেষ করা হয়েছে। আরো কিছু লোককে শেষ করা হবে। শেষ করার অর্থ যে, ‘জাতীয় চার নেতাকে’ হত্যা করা তা সেদিন বুঝতে পারিনি। ১৫ আগস্ট রাতে আমরা ১৫-২০ জনের মতো ছাত্র একসঙ্গে জগন্নাথ হল ‘ছাত্র সংসদ’ ভবনের নিচতলায় ছিলাম। হলে ওই রাতে আর কোনো ছাত্র ছিল না। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পরই খবর পেলাম, ছাত্রনেতারা গোপনে কোনো এক স্থানে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কালক্ষেপণ না করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ জানানোর জন্য কর্মসূচি দিতে হবে।
এমন খবর ছাত্রকর্মীদের কাছে দ্রুত চলে আসে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের দেয়ালে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’ বলে ‘চিকা মারা’ হয়েছে। খন্দকার মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়ে বঙ্গভবনে বসে সামরিক ফরমান জারি করার মাধ্যমে দেশ শাসন করছিল। সারা দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। তখন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলত গেরিলা পদ্ধতিতে। একদিন হঠাৎ আমার রুমে লিফলেটের একটি বড় বান্ডেল ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী আমার অনুপস্থিতিতে দিয়ে গেল। ছাত্রদের মধ্যে বিলি করার জন্য। লিফলেটের হেডলাইন ছিল ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’। আমার সঙ্গে কালীপদ নামের ফরিদপুরের একজন ছাত্র ডাবলিং করত। একদিন গভীর রাতে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ ভবনের বিভিন্ন রুমে লিফলেটগুলো দেয়ার সময় তাকে আমার সঙ্গে থাকার জন্য অনুরোধ করলাম, প্রত্যুত্তরে সে আমাকে বলল, ‘আপনি মরতে চাইলে মরতে পারেন, আমি মরতে পারব না।’ তখন একাই রাতভর নানান কৌশল অবলম্বন করে প্রত্যেক রুমের দরজার ফাঁক দিয়ে সব লিফলেট দিলাম। তখন জগন্নাথ হলের প্রতি খুনিদের কড়া নজরদারি ছিল। ধরা পড়লে আর রক্ষা ছিল না। পরদিন সকালবেলা হাতমুখ ধোয়ার জন্য বেসিনের দিকে আসার সময় সামান্য দূর থেকে দেখি, আশপাশের রুমের ছাত্ররা জটলা করে কী যেন আলোচনা করছিল। তাদের কাছে আসার মুহূর্তেই একজন ছাত্র আমাকে বলল, ‘বক্সী দা, গতরাতে কে বা কারা বঙ্গবন্ধুর ফটো সংবলিত লিফলেট দিয়ে গেছে। বোঝা গেছে বঙ্গবন্ধুর লোক দেশে এখনো আছে। আমি সত্য কথাটা গোপন করে বললাম, আমিও একটি পেয়েছি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর লোক। যদি সুযোগ থাকে পরকালে গিয়েও বলব, আমি বঙ্গবন্ধুর লোক। বঙ্গবন্ধু আমার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। যদি আমি আওয়ামী লীগার নই। বিভিন্ন হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রায়ই ঝটিকা মিছিল হতো। এভাবে আন্দোলন ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদের প্রথম প্রকাশ্য মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে যাত্রা শুরু করে। ওই মিছিলে আমার অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন সাবেক ন্যাপ নেত্রী (বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চেীধুরী, খালেদ মোশারফের মাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে, মিছিলের ওপর সেনাবাহিনীর সদস্যরা আক্রমণ করবে। বিভিন্ন বাসার গেটে, অলিগলিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পজিশন নিয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী মিছিলের ওপর যে কোনো কারণেই হোক আক্রমণ করেনি। শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটের সামনে গিয়ে পৌঁছে। পাহারারত সেনাসদস্যরা কাউকে গেটের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। আমাদের হাতের ফুলগুলো শ্রদ্ধার সঙ্গে গেটের ওপর রেখে দিলাম। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে মানুষকে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে দেখেছি। তখনই বুঝতে পেরেছি, বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসছেন। কারণ এই অতিমানব, মানুষের মনের মণিকোঠায় চির অ¤øান হয়ে আছেন। হলে ফিরে এসে শুনতে পেলাম আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সংবাদ। ৩ নভেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে খুনি মোস্তাকের নির্দেশে (খবঃ ঃযবস ফড়, ডযধঃ বাবৎ ঃযবু ষরশব) ঘাতকচক্র জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
জিয়ার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্যান্টের পকেটে করে গোপনে ফুল নিয়ে বাসযোগে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হই। মেইন রোড থেকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তার মুখে শত শত পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়েছিল। বাস থেকে নামতে না পেরে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ফুল ছুড়ে দিই। তারপর আমরা সবাই শুক্রাবাদে গিয়ে জড়ো হই। পুলিশের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারিনি। পুলিশ ছাত্র মনে করে বিভিন্নজনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফুল বের করে বেদম মারধর করে এবং বলে, ‘তোর বাপেরে এখনো ভুলতে পারিসনি’।
আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালিত হচ্ছে। পুলিশ-সেনাবাহিনী জাতির জনকের উদ্দেশে স্যালুট জানাচ্ছে। বড়ই আনন্দ বোধ করছি। এ দিনটির জন্যই আমরা সেদিন সংগ্রাম করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমার সামান্য অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছিল বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
দুই. ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ খ্যাত ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট কবিতায় লিখেছিলেন, এপ্রিল হলো নিষ্ঠুরতম মাস। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আগস্ট হলো নিষ্ঠুরতম মাস, শোকের মাস। রাষ্ট্রের অভিভাবককে হারানোর মাস। কেবলই বেদনা ও হারানোর মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদেক মুহূর্তে সেনাবাহিনী থেকে অসদাচরণের দায়ে বহিষ্কৃত স্বল্পসংখ্যক জুনিয়র অফিসার ডাকাতের মতো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে তাঁর ৮ বছরের নিষ্পাপ শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাহারায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা খুনিদের বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করতে সক্ষম হননি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গার্ড কমান্ডার সুবেদার গনি আদালতে বলেছেন, তাদের সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দার ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া ৪টার দিকে এসে গার্ড পরীক্ষা করার পর তাদের কাছ থেকে পুরনো সব গুলি নিয়ে নতুন গুলি দিবে বলে আর কোনো গুলি না দিয়ে চলে যান। যার ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিকরা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের এটিও একটি অংশ হতে পারে। ১৫ আগস্ট জোয়ার্দারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা জনগণের কাছে পরিষ্কার করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ১৫ আগস্টের খুনিরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শগুলোকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় যার রেশ এখনো চলছে। সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনীসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্রের অনুগত ছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ বিদ্রোহ করেননি। রাস্তায় তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মিছিল হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এতসব ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও স্বল্প সংখ্যক নররূপী পশু বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে হত্যা করতে সক্ষম হলো, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। নচেৎ নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক সত্য অজানা থেকে যাবে।
রবীন্দ্র কুমার বক্সী : সাবেক অধ্যাপক, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর।