৬৮-তে আওয়ামী লীগ : বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা


আজ ২৩ জুন ২০১৬ স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার ৬৭ বছর এবং তা ৬৮তম জন্মদিন। আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামের একটি উদ্ভট রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু প্রগতিশীলরা সে উদ্ভট বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। তারই অংশ হিসেবে ১৯৪৯ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ জুন পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল আয়োজন করেন। তখন সে দলের প্রথম সারির নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান পূর্ববাংলার একাংশকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। পরে এই সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির কে এম দাশ লেনে অবস্থিত রোজ গার্ডেন হলরুমে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। শেরেবাংলা সে সম্মেলনে খানিক সময়ের জন্য উপস্থিত থেকে সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এই সম্মেলনেই পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদল হিসেবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করা হয়। সেখানে সভাপতি হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। তখন শেখ মুজিব জেলখানায় থেকেই সেই দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৪০ সদস্যবিশিষ্ট এ অর্গানাইজিং কমিটিতে ২৯ বছর বয়সী শেখ মুজিব সেদিন তাঁর যোগ্যতাবলেই দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হতে পেরেছিলেন। সেই কমিটির অন্যান্য কয়েকজন ছিলেন- সহসভাপতি এডভোকেট আতাউর রহমান খান, ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমদ এমএলএ, এডভোকেট আলী আমজাদ খান, এডভোকেট আব্দুস সালাম খান, ২নং যুগ্মসম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমদ, সহসম্পাদক এ কে এম রফিকুল হোসেন এবং কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রমুখ। পরে শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দলকে আস্তে আস্তে সংগঠিত করে ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনিই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৪ সালের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৩ আসন লাভ করে। তার মধ্যে শরিক আওয়ামী লীগ একাই পায় ১৪৩ আসন। ১৯৫৫ সালে ২১ অক্টোবর দলের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিব পুরো সময় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে আরেক নজির সৃষ্টি করলেন, যা রাজনীতিতে সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক হন এবং সে বছরই ছয়দফা ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৮ সালের ৩ মে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জনের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। এ সময় জেলে থেকেই শেখ মুজিব বাংলার মুকুটহীন সম্রাটে পরিণত হন। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। এরপর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন আসে আওয়ামী লীগের দখলে। এগুলো ছিল স্বাধীনতার পূর্বেকার আওয়ামী লীগের সাফল্যগাঁথা। তারপর আওয়ামী লীগের হাত ধরেই দেশের স্বাধীনতা। তবে এ দলটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে, যার বলি হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু নিজেই। তবে বাংলদেশের মানুষের কল্যাণে আজো তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরা পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। তাই এখন অতীতের ঐতিহাসিক দিবসগুলো পালন করা যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে গত ৭ জুন পালিত হয়ে গেল বাঙালির ইতিহাসের আরেক ঐতিহাসিক দিন। বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি ১৯৬৬ সালের ৭ জুন যে ৬ দফার বদৌলতেই পরবর্তীতে তাঁরই নেতৃত্বে রচিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতা। আর বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি হিসেবে তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশকে কোথা থেকে কোন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন তা কল্পনাই করা যায় না। এসব কোনো কিছুই সম্ভব ছিল না যদি স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু এবং ১৯৮১ সালের ১৭ মে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা বীরের বেশে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে না পারতেন।

১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে দলের সভানেত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর যাবৎ তিনি এ দলটি সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর ৭ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত নয় মাসের গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে জাতির জনক বন্দি ছিলেন। সে সময় শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যগণই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসায় গৃহান্তরীণ ছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরদর্পে স্বদেশে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মতোই ছিল ১৯৮১ সালের সেই তাঁরই কন্যার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে পার্থক্য শুধু এক দশক সময়ের।

১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের ফসল হিসেবে দেশে গণতান্ত্রিক ধারার প্রবর্তন করতে পারলেও দেশ চলে যায় গভীর ষড়যন্ত্রের কশাঘাতে। উপর্যুপরি ভারতবিরোধী ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতির গভীর এক ষড়যন্ত্রের অপপ্রচারে পড়ে যায় তাঁর দল। তারপরেও তার আন্দোলন থেমে থাকেনি এবং হাল ছাড়েননি তিনি। কিন্তু অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন এক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আরোহণ করেন তিনি। সে মেয়াদে তিনি সংসদে কালো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলপূর্বক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার শুরু করেন। ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, দীর্ঘদিনের অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, দেশের প্রথম ও দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু উদ্বোধন, দেশকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচিত করেছিলেন তখন তিনি।

তাঁর কর্মকাণ্ডে আবারো ষড়যন্তকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে নতুনভাবে বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁকেও হত্যার পরিকল্পনা করে। তাঁকে মারার জন্য কমপক্ষে ২০ বার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৮৩ সালের ১৬ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর তাঁর বাসভবন আক্রান্ত হয়েছিল, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তার ওপর গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল, ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট খোদ ৩২ নম্বরেই ফ্রিডমপার্টির ক্যাডারদের গোলাগুলির স্বীকার হন তিনি। ১৯৯১ সালে ঢাকায় তাঁর ওপর হামলা হয়, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোরে ট্রেনে ভ্রমণের সময় তাঁর ওপর হামলা হয়, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় একটি জনসভার কাছে ছিয়াত্তর কেজি বোমা পুঁতে রাখা হয় তাঁকে হত্যা করার জন্য, ২০০৪ সালের ৫ জুলাই তুরস্কে ভ্রমণের সময় তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল। সবচেয়ে ভয়াবহতম হামলাটি ঘটেছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিন ঘাতকরা আরেকটি ১৫ আগস্ট বানাতে চেয়েছিল। মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জনের প্রাণ গেছে সেদিন। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে! প্রতিবারই তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং মানুষের ভালোবাসার জোরে রক্ষা পেয়েছেন। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য যখন তিনি আবারো আন্দোলন করছিলেন, তখন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে দেশে এক অগণতান্ত্রিক জরুরি সরকারের আবির্ভাব ঘটে। তখন তিনি ব্যক্তিগত, চিকিৎসা ও পারিবারিক কাজে বিদেশে অবস্থান করলে, সেই জরুরি সরকার আবার তাঁকে দেশে ফিরতে বাধা দেয়। কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা তাঁকে বাবার মতোই দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি ২০০৭ সালের জুলাই মাসে দেশে প্রত্যাবর্তন করলেও আবার জরুরি সরকারের রোষানলে পড়ে বঙ্গবন্ধুর মতোই ১৬ জুলাই ২০০৭ সালে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে তাঁকে। সেই জেলখানায় প্রায় এক বছর থেকে ২০০৮ সালের এক ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে আবার তিনি দেশের সরকার গঠন করতে সমর্থ হন।

এর পর থেকে পাঁচ বছর সফলভাবে দেশ পরিচালনা করার সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নেয়া এবং প্রধান প্রধান কয়েকটি রায় কার্যকর করা, দেশকে অর্থনৈতিকভারে নিম্ন-আয়ের কাতার থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের কাতারে উঠিয়ে নিয়ে আসা, দেশকে পুরোপুরি ডিজিটালে রূপান্তরিত করেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন, দেশকে আগামী মিশন-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১ লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ করছেন। তিনি দেশের জন্য এবং নিজের জন্য বিরল সম্মান, সম্মাননা ও পুরস্কার বয়ে আনছেন, নারীর ক্ষমতান করছেন। কাজেই এসব ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। এ কথা খুব দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের জন্ম না হলে যেমন বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না, ঠিক তাঁর কন্যা দেশের হাল না ধরলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো না। বাংলাদেশকে হয়তো সেই তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। কাজেই আওয়ামী লীগের জন্যই বঙ্গববন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরিই আজকের দেশের কাণ্ডারি দেশরতœ শেখ হাসিনা। কাজেই আজ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ক্ষমতায় থাকলে দল ও সরকার অনেক সময় একাকার হয়ে যায়। সেজন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে যেত হবে।

ড. মো. হুমায়ুন কবীর : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1750-B3.jpg