বাঙালি জাতির ইতিহাসে ৭ জুন একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৬৬ সালের ওই দিনে পশ্চিম পাকিস্তানের মাটির ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা। কেন তাকে ৬ দফার ঘোষণা দিতে হয়েছিল তার উত্তর পেতে হলে পাকিস্তান সৃষ্টি ও তারপর ওই রাষ্ট্রের বাস্তব ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি মুসলমানরা এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। যদি ধরে নেয়া হয় দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তান ছিল এই উপমহাদেশের আবাসভূমি। তথাপি বাস্তবতা হচ্ছে এই উপমহাদেশে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নামে দু’টি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত হওয়ার পরও উভয় রাষ্ট্র কোনোটিই শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের আবাসভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি এবং যুক্তিসঙ্গত কারণেই তা ঘটেছে। পাকিস্তানে রয়ে যায় বিপুল সংখ্যক হিন্দু। অনুরূপভাবে ভারতেও থেকে যায় অগণিত মুসলমান। সুতরাং দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম একেবারেই ভিত্তিহীন ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ও হিন্দুদের ভারতের চর হিসেবে গণ্য করত। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের পূর্ণ স্থায়িত্ব বজায় ছিল মাত্র ২৩ বছর। এই ২৩ বছরের পাকিস্তানের সামরিক, আধাসামরিক ও তথাকথিত বেসামরিক সরকারসমূহ পূর্ব বাংলাকে শোষণের নীতি অনুসরণ করে। ফলে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ভয়াবহ বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলার অর্জিত অর্থে পাকিস্তানে পরপর তিনটি রাজধানী গড়ে ওঠে। অথচ পূর্ব বাংলার প্রধান রাজধানী শহর ঢাকায় তখন কেন্দ্রীয় সরকারের একটা সচিবালয়ও পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করেনি। মাথাপিছু একজন বাঙালির চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আয় ছিল অনেক বেশি। অথচ সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো পূর্ব বাংলার পাট বিক্রয় করা অর্থে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় মাত্র কয়েক মাসে পাট রপ্তানি করে ১৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। যার সব টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়। অর্থনৈতিক এই বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভেতর অসন্তোষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তাছাড়া রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পূর্ব বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাতে পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ যুবসমাজ বিদ্রোহ শুরু করে এবং সেই বিদ্রোহ মোকাবেলায় পাকিস্তানের শাসকরা রাজপথ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করে। সেই থেকে বাংলার জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। রক্তের বিনিময়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও অন্যান্য বৈষম্যে তারা ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হতে থাকে। স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্রমাগত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তাতে পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়লেও পাকিস্তানি শাসকদের সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে আরো সুরক্ষায় মেতে ওঠে। তাছাড়া যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনো সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে পূর্ব বাংলার মানুষকে বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে বাঙালি কখনো মেনে নিতে পারেনি। বরং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোর কারণে, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে। আর এই জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ক্রমাগত এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যার নেতৃত্বে পালিত হয়, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শুরু হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিসত্তায় রূপান্তরিত করে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুর। এজন্য তিনি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনৈতিক বিবেচনায় এক মহান ক‚টকৌশলী। স্বায়ত্তশাসনের দাবি সুস্পষ্ট নয়, বিধায় তিনি ঠিক সঠিক মুহূর্তে, সঠিক স্থানে, সঠিক ভাষায় তাঁর ৬ দফার ঘোষণা দেন। তাঁর সেই ঘোষণায় পাকিস্তানি শাসকরা বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ পেয়ে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। শুরু হয় নিপীড়ন-নির্যাতন, সীমাহীন অত্যাচার। এমনকি শেখ মুজিবকে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র। অন্যদিকে ৬ দফা ঘোষণার মাত্র ২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলায় এক মহাজাগরণের সৃষ্টি হয়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এই সুদীর্ঘ সমতলে একটা পল্লীও ছিল না, যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বিশ্লেষিত হয়নি। হয় বঙ্গবন্ধু নিজে অথবা তার পক্ষে কর্মী বাহিনী (লক্ষ-কোটি) ৬ দফার প্রচার করে বাংলার মানুষকে চরম বিদ্রোহী করে তোলে। ইস্পাতকঠিনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলার জনগণ পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলাতে আগরতলা মামলায় এক নম্বর আসামি হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি মুজিবকে ঢাকা সেনানিবাসে এনে ক্যামেরা ট্রায়াল শুরু করে। লক্ষ্য ছিল তাকে ফাঁসি দেয়া। কিন্তু বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ- কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার নেতৃত্বে ১৯৬৯ সালে যে গণঅভ্যুত্থান ঘটে তাতে তারা বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব তখন জনতা কর্তৃক বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন ও পাকিস্তানি সরকারকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করেন। ওই নির্বাচনে ৬ দফার কারণেই বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করেন এবং ওই বিজয়ের কারণেই তার পক্ষে পূর্ব বাংলার স্বশাসন প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। পাকিস্তানি শাসকরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও হঠাৎ তা স্থগিত করে, তখন বঙ্গবন্ধু তার অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সেই আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পূর্ব বাংলার শাসন করার আইনগত ও নৈতিক অধিকার পাকিস্তানি শাসকদের নেই, মূলত পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীন। লক্ষণীয় ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে গণঅভ্যুত্থান পর্যায়ে যে পরিণতিতে পৌঁছে যায়, তারই ফলে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়। আর ওই বিজয় পাকিস্তান সরকার মেনে না নিলে পূর্ব বাংলার একচ্ছত্র নেতা, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আইনগত ও নৈতিক অধিকার অর্জন করেন। ৬ দফার আন্দোলন আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট অর্জন করে ১৯৭০-এর নির্বাচনে। ৬ দফাকে ম্যান্ডেট হিসেবে গ্রহণ করে বিজয়ী হওয়ার কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন জনগণের রায়ের প্রতি তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ৬ দফার প্রশ্নে কোনো আপস নয়। তার এই ঘোষণার পরই পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং তা ২৫ মার্চ রাতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে একই সময়ে ঢাকায় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
আসলে বাস্তবতা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সঠিক কার্যক্রম শুরু। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রশ্নেও অনেকের প্রত্যাশা ছিল তিনি ৭ মার্চেই পুরোপুরি ঘোষণা দেবেন। আর ঘোষণা দেয়ার কিছু বাকিও রাখেননি। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ঘোষণা দেন ২৫ মার্চে আক্রান্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে। যখন বিশ্বের কোনো নেতাই তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম বলে দায়ী করতে পারবেন না। প্রাজ্ঞ, দক্ষ, বিচক্ষণ শেখ মুজিব ভালো করেই জানতেন, রাজনৈতিক আন্দোলনকে অর্থনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করতে পারলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। তাই ৬ দফার মাধ্যমে তিনি যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন তা জনগণের মন জয় করে এবং তারা ৬ দফার দাবি মেনে নিতে জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়। ৬ দফার ভেতর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সূ² রাজনীতি কার্যকর ছিল তা বাংলার মানুষ সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিল বলেই ৬ দফা আন্দোলন এত দ্রুত বিস্তার লাভ করে। মুজিব নিজে ও তার নিকটতম সহযোগীরা ভালো করেই জানতেন ৬ দফার মূল দাবি একটাই, তা হলো স্বাধীনতা। অথচ জনগণকে এমনকি অসহযোগ আন্দোলন পর্যায়ে তিনি তা জানতে দেননি। বরং পাকিস্তানি কাঠামোর মধ্য থেকেই তিনি সংকটের সমাধানের পথ দেখান। যদিও তিনি ভালো করে জানতেন পাকিস্তান সরকার ৬ দফাকে মেনে নেবে না এবং পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী বিজয়ী নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই ৭ মার্চের ঘোষণাই ছিল ৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন। ওই ঘোষণার মাধ্যমেই তিনি পূর্ব বাংলার অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের চির অবসানের আহ্বান জানান। তাই ৬ দফাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট।
ডা. এস এ মালেক : বিশিষ্ট রাজনীতিক ও কলামিস্ট।