১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস- শ্রেষ্ঠতম অর্জন এবং স্মরণীয় দিন। আনন্দ, উচ্ছলতা আর পবিত্রতম দিন। এই দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি জাতীয় চার নেতাকে যাঁদের নেতৃত্বে সেদিন মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের সঙ্গে তাদের নাম মিশে আছে। স্মৃতিকথা লিখতে বসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অতি নিকট থেকে দেখা ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে অবনত মস্তকে সালাম করে হ্যান্ডসেক করার মতো বিরল ঘটনার কথা আজ আমার বারবার মনে পড়ছে। সত্যিই তিনি ছিলেন বাঙালির জাতির পিতা।
১৬ এপ্রিল ১৯৭১ সাল রোজ শুক্রবার। তৎকালীন বাগোয়ান সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি, ভবেরপাড়া সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আব্দুল মোমিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন মণ্ডল বাইসাইকেলে চড়ে বিকেলে তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএনএ সহিউদ্দিন সাহেবের মেহেরপুরস্থ বাসভবনে যাই। বাসার বাইরে আমরা আরো কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে সেই সময়কার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা বলছি- এমন সময় মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইসমাইল হোসেন, সহ-সভাপতি আ ক ম ইদ্রিস আলী ও সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জালাল উদ্দিন আমাদের এমএনএর বাসার ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলেন। আমাদের বলা হলো- আগামীকাল ১৭ এপ্রিল সকাল ৯টায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেবে, তোমাদের একটি মঞ্চ তৈরি করে উপরিভাগে একটি টেবিল ও সামনে কয়েকটি চেয়ার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তৎক্ষনাৎ বৈদ্যনাথতলা-সংলগ্ন ভবেরপাড়া গ্রামে চলে এসে সুশীল মণ্ডল, পিন্টু বিশ্বাস, রফিক মাস্টার, সৈয়দ মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন প্রায় সারা রাত ধরে স্থানীয় মিশন ও আশপাশের মানুষের বাড়ি থেকে ৪টি চৌকি, ১টি টেবিল এবং ৩৪টি কাঠের চেয়ার সংগ্রহ করে মঞ্চ তৈরিসহ সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। সেই সময়ে ভবেরপাড়া মিশনের ফাদার ফ্রান্সিস, সিস্টার ক্যাথরিনার সহযোগিতার কথা ভুলবার নয়।
১৭ এপ্রিল দিনটি ছিল শনিবার। ঠিক সকাল ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক গাড়ি এসে বৈদ্যনাথতলা আমবাগানটিকে ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে ও গাড়ি থেকে বেশ কয়েক ড্রাম মিষ্টি আমবাগানের একটি স্থানে নামিয়ে রাখে, যা পরবর্তীতে শপথ গ্রহণ শেষে উপস্থিত জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করা হয়। বিএসএফের কিছু গাড়িতে করে জাতীয় নেতাদের বসার জন্য কিছু সংখ্যক চেয়ারও আনা হয়। এর পরপরই ৯টা ৩০ মিনিটে প্রায় ১০০টির মতো গাড়িতে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিকসহ জাতীয় নেতারা সভাস্থলে এসেই শপথ অনুষ্ঠান শুরুর ব্যবস্থা নিলেন। প্রথমে আমরা ক’জনের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুজিবনগর আম্রকাননে অধ্যাপক ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (প্রক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স্) পাঠ করেন এবং সাংবিধানিক পরিষদের চিফ হুইপ হিসেবে বাংলাদেশের সার্বভৌম সর্বোচ্চ সংস্থারূপে নবগঠিত সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনছুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, কামরুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী। মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে এম এ জি ওসমানীর নাম অতি নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে যায়। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দানের কথা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুজিবনগরের সেই বিশাল সমাবেশে জনতার উদ্দেশে তাঁর ভাষণে বলেন, আজ এই মুজিবনগরে একটি স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। বিগত ২৪ বছর যাবৎ বাংলার মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগোতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদীরা তা হতে দেয়নি। তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাতেও তারা বাধার সৃষ্টি করে আমাদের ওপর চালালো বর্বর আক্রমণ। তাই আমরা আজ মরণপণ যুদ্ধে নেমেছি। এ যুদ্ধে জয় আমাদের অনিবার্য। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ মুজিবনগরের শপথ অনুষ্ঠানে বলেন, আজ হোক আর কাল হোক বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। আমরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ন করবই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করছেন তার জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখিত। আমি প্রশ্ন করতে চাই- লাখ লাখ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করাকে ইসলাম অনুমোদন করে কি? মসজিদ, মন্দির বা গীর্জা ধ্বংস করার কোনো বিধান কি ইসলামে আছে? বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনো সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু, মুসলিাম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করছে। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষেকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম কে স্তব্ধ করা যাবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযোজন হলো; তা চিরদিন থাকবে। এমন কোনো শক্তি নেই যে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে পারে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৭১-এর মার্চ মাসের ৩০ তারিখ কুষ্টিয়ার তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা, দামুড়হুদা হয়ে ওপারে চেংড়াখালী বিএসএফ ক্যাম্পে যান। ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ তাদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। ওইদিনই কলকাতায় গিয়ে ১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম এমএনএ ভারতের রাজধানী দিল্লি পৌঁছে যান। ৪ এপ্রিল ও ৬ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের সঙ্গে সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা শেষে একটি ঐকমত্য সৃষ্টি হয়। ৮ এপ্রিল কলকাতায় ফিরে একটি গেস্ট হাউসে উপস্থিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যসহ যুব ও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ৯ এপ্রিল ৬ সিটের একটি ছোট্ট প্লেনে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলামসহ আরো কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা শিলিগুড়ি পৌঁছান। তোরা পাহাড়ের নিচে এক গেস্ট হাউস থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নানকে নিয়ে ১০ এপ্রিল আগরতলায় উপস্থিত হন। ওইদিনই রাতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় পার্টির সভা করে সরকার গঠন করাসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত হুইপ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম এমএনএ রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ‘মুজিবনগর সনদ’ অনুমোদন দেয়া হয়।
তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার জাতীয় পরিষদ সদস্য ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল-ইসলাম, এডভোকেট আজিজুর রহমান আক্কাস, সহিউদ্দীন আহমেদ, ব্যারিস্টার বাদল রশিদ, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া, এডভোকেট আহসান উল্লাহ, ডাক্তার আসহাবুল হক (হেবা), এডভোকেট ইউনুছ আলী, মো. নূরুল হকসহ মেহেরপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডাক্তার আবু আব্দুল্লাহ, কোষাধ্যক্ষ ডাক্তার আব্দুর রশিদ, সাহাবাজ উদ্দীন লিজ্জু, একে আসকারী (পটল), খাদেমুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম (পটল মিয়া), আতাউল হাকিম (লাল মিয়া), ইসমাইল হোসেন মণ্ডল (মানিক মিয়া), মুজিবনগর এলাকার দারিয়াপুরের ডা. আলহাজ শামছুল হুদা, ওয়াজেদ আলী, বাকের আলী, কলিম উদ্দিন, এ বি এম আসাদুল হক, আলীজান মাস্টার, ইউনূছ আলী মাস্টার, মোকাম আলী, মোজাম্মেল হক মাস্টার, সোনাপুরের এডভোকেট রুস্তম আলী, এডভোকেট আবু তৈয়ব, আকবর আলী মাস্টার, নাজিরাকোনা গ্রামের জামাত আলী মোল্লা, বাগোয়ানের সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দীন (সেন্টু), মতিয়ার রহমান, আনন্দবাস গ্রামের রফিক উদ্দিন, মানিকনগরের দোয়াজ আলী, এদের সার্বিক সহযোগিতায় মেহেরপুর মহকুমার এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে ভবেরপাড়া গ্রামের ১২ জন আনসার কর্তৃক মুজিবনগর সরকারের ১ম উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মুজিবনগরে প্রধান অনুষ্ঠানসহ জাতীয়ভাবে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে পালন করেছে। ঐতিহাসিক এই দিনে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় বীর জনতাকে যারা মুজিবনগর সরকারকে অস্ত্র দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আমি তৎকালীন ভারতীয় সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যাবাদ জানাচ্ছি।
আমি দাবি করছি, মুজিবনগরকে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হোক। মুজিবনগর স্থলবন্দর, মুজিবনগর ইপিজেড/বাণিজ্যিক জোন, মুজিবনগর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুজিবনগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি- যা আজো পূরণ হয়নি। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ এখন সময়ের দাবি। জনসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে- মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা, মাগুরাকে নিয়ে মুজিবনগরের একটি প্রশাসনিক বিভাগ সৃষ্টি করে তার দপ্তর মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না তাও আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আমাদের ভেবে দেখা দরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার এ দাবি সব মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতির দাবি হিসেবে পরিগণিত হোক।
মো. জয়নাল আবেদীন : বীর মুক্তিযোদ্ধা।