শোকের আগস্টে সব পিতৃহারার জন্য


বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির জাতির পিতা। কিন্তু তিনি একদিনে কিংবা এমনিতেই জাতির পিতা বনে যাননি। সেজন্য তাঁকে পুরো জাতির আস্থা অর্জন করতে হয়েছে দিনে দিনে। নিতে ও দিতে হয়েছে পিতার মতো সারাদেশের মানুষের ভালোবাসা। প্রচলিত ধারায় আমরা সাধারণভাবে জানি যে, যিনি সন্তান জন্ম দেন তাকেই সেই সন্তানের বাবা বলা হয়। আর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক দেশটিরই জন্মদাতা। বাঙালি জাতিকেও উপহার দিয়েছেন একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি। সেজন্য তাঁকে জাতির জনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। মানুষ মাত্রই মরণশীল। বিধির বিধান না যায় খণ্ডন। কারো বাবার মৃত্যু হলে আমরা একটি সহজ ও কমন সান্ত¡না দিয়ে থাকি তাকে। বাবা কারোর চিরকাল বেঁচে থাকেন না। কী আর করা যাবে- ইত্যাদি ইত্যাদি। চিরাচরিত এ সত্যটিকে সামনে নিয়ে বলা যায়, পৃথিবীর সব বাবা এবং তাদের সন্তানদের জন্য বরণ্যে মনীষীদের কিছু বাণী রয়েছে। ঠিক সেরকমভাবেই বাবার মৃত্যু নিয়ে গ্রেট ইংলিশ ড্রামাটিস্ট শেক্সপিয়ার তাঁর ট্র্যাজিক ‘হ্যামলেট’ নাটকে কবিতার ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন-

To give these mourning duties to your father.

But you must know your father lost a father,

That father lost, lost his, and the survivor bound

In filial obligation for some term

To do obsequious sorrow. But to persever

In obstinate condolement is a course

Of impious stubbornness. ‘Tis unmanly grief.

It shows a will most incorrect to heaven,

A heart unfortified, a mind impatient,

An understanding simple and unschooled.

For what we know must be and is as common

As any the most vulgar thing to sense,

Why should we in our peevish opposition

Take it to heart? Fie! ‘Tis a fault to heaven,

A fault against the dead, a fault to nature,

To reason most absurd, whose common theme

Is death of fathers, and who still hath cried,

From the first corse till he that died today,

“This must be so.”

অর্থাৎ এক কথায় এর মর্মার্থ হলো- বাবার মৃত্যু নিয়ে কান্না করতে নেই, কারণ তোমার যিনি বাবা, তিনি তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। তাঁর বাবা আবার তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন, এভাবে বংশ পরম্পরায় বাবাদের হারাতে হারাতে আজ আমরা এখানে। কাজেই আগের তাঁরা যেহেতু তাঁদের বাবাকে হারাতে হারাতে এই অবধি এসেছেন, কাজেই তোমাদেরও এ নিয়ে এত দুঃখিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। শেক্সপিয়র তার নাটকের মাধ্যমে বিশ্বের সব বাবাদের সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

আমি আমার নিজের বাবাকে হারিয়েছি গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট। সেই হিসেবে এ বছরের (২০১৬) ৯ আগস্ট তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছর আমার বাবার (জনাব হেকমত আলী-৭৫) মৃত্যুর সান্ত¡না হিসেবে আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য, লেখক এবং ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম আমাকে হ্যামলেট নাটকের মর্মস্পর্শী এ কয়েকটি চরণ উপহার দিয়ে বলেছিলেন, বাবার মৃত্যুতে এর বড় সান্ত¡না আমার কাছে আর নেই। আপনি যেহেতু লিখেন, যদি সময়-সুযোগ হয় তাহলে বিশ্বের সব বাবাকে নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করলে হয়তো আপনার মন কিছুটা হালকা হতে পারে। সেজন্য আমার বাবার প্রথম মৃত্যুবাষির্কীতে তাঁকে স্মরণ করার জন্য পৃথিবী সব পিতৃহারার জন্য আমার এ লেখা উৎসর্গীকৃত।

বিশ্বের সব বাবার সঙ্গে তাই আজ বাংলাদেশের জাতির জনকের নামটিও বারবার মনে পড়ছে। কারণ বিশ্বের বেশিরভাগ বাবারই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলার বাবার অর্থাৎ বাঙালি জাতির জনকের মৃত্যুটি স্বাভাবিক হয়নি। কাজেই এ শোকাবহ আগস্ট মাসে তাঁকে নিয়ে কোনো সান্ত¡নাই পাওয়া যায় না। আর বাঙালি জাতির জন্য তো বটেই বিশ্ব মানবতার ইতিহাসেও এ আগস্ট মাসটি একটি শোকের আবহ সৃষ্টি করে থাকে। কারণ আমরা জানি আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি, যুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙালি জাতির স্রষ্টা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। বাবা-মা এবং পরিবারের সব নিকট সদস্যদের হারিয়ে নির্বাক বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পিতৃশোকে এখনো কাতর রয়েছেন। এখানে একটি বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে, আমরা আমাদের বাবাদের স্বাভাবিক মৃত্যুতে কতটুকু শোকাহত হচ্ছি আর বঙ্গবন্ধুর কন্যারা কীভাবে তাঁদের বাবা-মাসহ পরিবারের সব সদস্যের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে সহ্য করে নিচ্ছেন? ২০০৪ সালের এ আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে একটি পরিকল্পিত ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটাতে চেয়েছিল এ দেশে। সেখানে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী আজকের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও মহিলা নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নির্মম যন্ত্রণায় মারা গিয়েছিলেন সেদিন। তারপরে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে একমাত্র মানিকগঞ্জ জেলা বাদে সারাদেশের ৬৩ জেলায় একবারে একই সময়ে জেএমবির বোমা হামলায় স্তম্ভিত হয়েছিল দেশবাসী। আবার আন্তর্জাতিকভাবে দেখতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জাপানের হিরোসিমাতে ‘লিটল বয়’ নামের এক পারমাণবিক বোমা মেরে সেখানকার প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। এ নির্মমতা এখানেই শেষ না হয়ে তার মাত্র তিনদিন পর ৯ আগস্টে ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে আরেকটি পারমাণবিক বোমা মেরে সেখানে আরো অর্ধ লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এ মৃত্যুর মিছিলেও অনেকের বাবা, সন্তান ও মা ছিলেন। কাজেই শেক্সপিয়ারের অনুভূতিকে ধারণ করে আজকে আমার বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করার পাশাপাশি সপরিবারে বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ বিশ্বের সব বাবাদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম, দোয়া, প্রার্থনা ও শুভেচ্ছা। জীবিত বাবারা দীর্ঘজীবী হোন আর জান্নাতবাসী ও স্বর্গীয় বাবাদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাক।

ড. মো. হুমায়ুন কবীর : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1742-B12.jpg