শহীদ বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি


মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সৃষ্টি হয়, মানুষই সৃষ্টি করে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের সামনে কখনো কখনো কিংবদন্তিতুল্য নেতা ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালির শত বছরের মুক্তি সংগ্রামে হিমালয়তুল্য যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ইতিহাসের এক মহানায়ক যার জীবনাবসান হয় সপরিবারে স্বাধীনতা পরাজিত ঘাতকদের বুক বিদীর্ণ করা বুলেটের আঘাতে। অজপাড়াগাঁয়ে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মধুমতি নদীর তীরে বেড়ে ওঠা দুরন্ত কিশোর শেখ মুজিব আমৃত্যু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কালজয়ী নেতার আসনে, যতদিন বাঙালি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে ততদিন থাকবেন শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবের শৈশব, কৈশোর তথা সমগ্র জীবন পর্যালোচনা করলে একজন মহানায়কের আবির্ভাবের পেছনে ছায়া ও কায়ার মতো একজন মহীয়সী নারীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সেই মহীয়সী নারী আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু পতœী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গর্ভধারিণী মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম মুজিবের যখন বিয়ে হয় তখন বেগম মুজিবের বয়স ছিল ৩ বছর আর শেখ মুজিবের বয়স ছিল ১০ বছর। পৃথিবী তখনো বর্তমান সভ্যতার আলোকিত পর্বে উদ্ভাসিত হয়নি, তবুও শৈশব থেকে এই সংগ্রামী মানুষটিকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি আগলে রেখেছিলেন তিনি হচ্ছেন বেগম মুজিব। যার ছিল না কোনো লোভ, মোহ।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাঙালির প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নিজেকে আপসহীনভাবে সম্পৃক্ত করেছেন নিজেকে নিয়ে এসেছেন নেতৃত্বের কাতারে। ঠিক তারই পেছনে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

আজ ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৯তম জন্মদিন। বেগম মুজিবের জন্মদিন পালিত হবে অনাড়ম্বর পরিবেশে। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের পাতায় পাতায় তার যে অনস্বীকার্য অবদান তা হয়তো নতুন প্রজন্ম এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠী সেভাবে অবগত নয়। বেগম মুজিব একদিকে যেমন সামলিয়েছেন কারাবন্দি স্বামীর রেখে যাওয়া সংসার, অপরদিকে কারাবন্দি মুজিব সংগ্রামের যে কঠিন দিনগুলোতে নেতা ও কর্মী বাহিনীর প্রতি নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন সেই নির্দেশ সময়োচিত এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে তীক্ষè নজরদারি করেছেন বেগম মুজিব।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সংগ্রামের যে নবধারা সূচিত হয়, সেই থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অবধি বেগম মুজিব এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা একে একে সেই ঘটনাবলির দিকে কিছু কিছু আলোকপাত করি। বাঙালি জাতির একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মূল বাহন ছিল বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে এই নিউক্লিয়াস ঘটিত হয়েছিল। এই নিউক্লিয়াসের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে সংগঠন, আন্দোলন এবং সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ছাত্র ও তরুণ সমাজের প্রধান এবং সর্বাত্মক প্রেরণার উৎসস্থল ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে নেতৃত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোনো সংকটের কালো ছায়া পড়েছে বেগম মুজিব সেই কালো ছায়া দূর করার জন্য পর্দার অন্তরালে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ আমার কথা নয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাদের ঘরোয়া আলাপচারিতায় এই সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ কথাগুলো বারবার উঠে আসে। কিন্তু ইতিহাস তা লিপিবদ্ধ করেনি। উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিঃশর্তভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পেছনে। তিনি একদিকে কিছু কিছু টাকা জামিয়ে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য যে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেয়া হতো সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু ভবন খ্যাত ৩২ নম্বরের বাড়িটির কাজ সুসম্পন্ন করেন। পুত্রসম শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি, নিজ পুত্র শহীদ শেখ কামাল, কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছোট কন্যা শেখ রেহানা, পুত্র শহীদ শেখ জামাল এবং শহীদ শেখ রাসেলের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার সব দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের পেছনে যতটুকু আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তাও তিনি করেছেন। ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে কখনো কখনো বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই বিভেদও তিনি একজন দক্ষ সংগঠন ও নেতা যেমনভাবে সমাধান করেন ঠিক তেমনিভাবে সমাধান করেছিলেন। ইতিহাসের এই এক অনুল্লিখিত পর্যায়।

১৯৬২ সালের সমারিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন শুরু হয় তার কিছুদিন পরই বন্ধবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে যান। সেই সময় আন্দোলন পরিচালনার নির্দেশনা দিত ধানমণ্ডি ৩২-এর ইতিহাস খ্যাত সেই বাড়ি থেকে বেগম মুজিবের মাধ্যমে। ১৯৬৬তে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন সেই ৬ দফার আলোকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যেসব ছাত্র-যুবক ও আওয়ামী নেতারা ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের পাশেও ছায়ার মতো ছিলেন বেগম মুজিব। ৬ দফা কেন্দ্রিক আন্দোলন প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এক লৌহ-কঠিন ঐক্যের কাতারে নিয়ে আসে। ছাত্রনেতারা ছড়িয়ে পড়েন শ্রমিক ও শিল্পাঞ্চলে সেখানেও শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রচার-প্রপাগান্ডা ধরনের আন্দোলন থেকে ক্রমশই আন্দোলনে রাজপথে দানা বাঁধতে থাকে। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, সেই আন্দোলনেও বেগম মুজিবের সুচিন্তিত মায়াময়, মাতৃতুল্য, ভগ্নিতুল্য স্নেহের পরশ ছিল না। আন্দোলন দমন করতে না পেরে আইযুবশাহী বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতার নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) দায়ের করে। বঙ্গবন্ধু আবারো কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের এই কঠিন পর্যায়ে দলের মধ্যে আপসহীন/আপসকামী ধারা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণায় কিছুসংখ্যক ছাত্র আপসকামী ধারাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করে সেই আন্দোলনকে এক দফার আন্দোলনের দিকে অগ্রসর করে নিয়ে যায়। দিশাহারা হয়ে আইয়ুবশাহী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। জান্তার গুলিতে শহীদ হন সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিক্ষক শহীদ শামসুজ্জুহা, আসাদ, মতিউর। সূচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান। জনরোষে ভেসে যায় আগরতলা মামলা, তার বিচারক এবং পাকিস্তানি জান্তার দোসরদের সর্বশেষ ঠিকানা। ইতিহাসের এই পর্যায়ে বেগম মুজিব এক দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। সামরিক জান্তা আইয়ুবের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিলে বসার জন্য। সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন নেতৃত্ব ও ছাত্র তরুণদের দৃঢ়তার মুখে বেগম মুজিব এক দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। সেই সময় আওয়ামী লীগের কিছু কিছু প্রভাবশালী নেতা ৩২ নম্বরে বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসেন প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নেন কিন্তু বেগম মুজিব অনমনীয় ভাব প্রদর্শন করেন। পরবর্তী সময় বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার বিষয়ে অনুরোধ করেন এবং বঙ্গবন্ধু নিজেও প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সামরিক জান্তা রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তি পাচ্ছেন এবং আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন। প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানের সব পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এমনিতরভাবে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব সব গোপনীয় বিষয়গুলো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দেখভাল করেন।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি আমাদের স্বাধীনতা এবং আমাদের বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের যে কালরাত্রীতে স্বাধীনতা বিরোধী কু-নেতারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সে সময়ও অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে। বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বেগম মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধু-পতœী হিসেবে নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাতা হিসেবে নয়; একজন নীরব দক্ষ সংগঠকের, যিনি ধুপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম মহানায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। ইতিহাসের উচিত বেগম মুজিবের এই অবদানকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করা।

শফী আহ্মেদ : নব্বইয়ের গণআন্দোলনের অন্যতম সংগঠক; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।

SUMMARY

1741-1.jpg