বঙ্গবন্ধু ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল


বঙ্গবন্ধু- বাংলাদেশ আর বাঙালিদের জন্য একটা অনস্বীকার্য নাম। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু এক সূত্রেই গাঁথা। বাংলাদেশের নামের সঙ্গে উচ্চারিত যেমন হাজারো লাখো কোটি মানুষের আত্মত্যাগ আর বিসর্জনের নাম, ঠিক সেভাবেই যেন রক্তের অক্ষরে লিখিত আরেকটা নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

যুগের পর যুগ জনতার সঙ্গে মিশে যে বঙ্গবন্ধু বাংলার জনতাকে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখালেন। জনগণের এই স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে গিয়ে নিজের জীবনের শত-সহস্র দিন-রজনী কাটালেন জেলের অভ্যন্তর প্রকোষ্ঠে। বাঙালির জীবনে ফল্গুধারার মতো বয়ে যাওয়া স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাধকে যিনি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। শাষক আর শোষকের রক্তচক্ষু কিংবা কালো হাতকে জনগণের শক্তি দিয়েই মোকাবেলা করলেন তিনি। অথচ সেই মানুষটিকেই প্রাণ দিতে হলো তারই দেশের কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনাদের হাতে। আরো প্রকট সত্য যে, যে মানুষগুলোকে তিনিই ক্ষমতার সারিতে নিয়ে এসেছিলেন তারই পার্টির কিছু ক্ষমতালিপ্সু বিশ্বাসঘাতকরা তাকে হত্যা করল এক নিকষ কালো রাতে। সেই বিশ্বাসঘাতকরা হত্যা করল সেদিন তার গোটা পরিবারকে। হয়তো আরেক বাংলাদেশ গড়ার প্রয়োজনেই প্রসন্ন ভাগ্যের কারণে শুধুমাত্র বেঁচেছিলেন তখন শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা। পাহাড় সমান বেদনা নিয়ে এখনো তারা সাগরের নীল জলের সমান হতাশা নিয়েই পাড়ি দিচ্ছেন তাদের জীবন। শেখ হাসিনা যুদ্ধ করছেন অসংখ্য অপশক্তির বিরুদ্ধে। সে জন্যই রাজনীতির নষ্ট ধারায় আমাদের আঁৎকে উঠতে হয়, এখনো কি কোনো মীরজাফর ওঁৎ পেতে আছে, বুনে যাচ্ছে পঁচাত্তরের প্লট?

বঙ্গবন্ধু- রাজনীতির প্রবাদতুল্য এই নেতা যিনি রাজনীতিকে বিভেদশূন্য করতে চেয়েছিলেন, এই মানুষটি রাজনীতিকে মুক্ত আলোচনার একটা প্লাটফরম হিসেবে দেখে বিবেচনা করতেন দেশসেবার একটা জায়গা হিসেবে। স্বাধীনতার অব্যবহতি পরে বাংলাদেশের তৎকালীন বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়াই ছাত্র ইউনিয়েনের নেতাকর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রশংসা করেছিলেন সেই মঞ্চে। এমনকি তখনকার সময়ে ডাকসু কিংবা ইউকসুসহ দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয়কে তিনি দেখিছিলেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। ছাত্র ইউনিয়নের এই বিজয় তিনি আগেভাগেই বুঝে নিয়েছিলেন। আর তাইতো তখন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি আজকের বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আর সম্ভাব্য ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে নির্বাচনের দু’দিন আগে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তোরা এবার ডাকসু নির্বাচনে জয়লাভ করবি। তোরা আমার সঙ্গেই আছিস, কাজেই আমার দুশ্চিন্তা নেই।’ সদ্য স্বাধীন দেশ, তাঁর নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। অথচ তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। তার ছাত্র সংগঠনের পরাজয়কে তিনি বাংলাদেশের আপামর ছাত্রদের সুচিন্তিত রায় তথা গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। একজন উদার দেশপ্রেমিক জননেতা ছাড়া এরকম একালে কি কল্পনা করা যায়? ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলনেও প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতির মানুষের সঙ্গে কীভাবে সৌহার্দ্য রাখা যায়, কীভাবে একটা সদ্য স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক ভেদ-বিভেদ ভুলে গিয়ে দেশ গঠনে সবাই সম্মিলিত ভূমিকা রাখতে পারে, তা একজন জননেতা ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ঠিকই উপলব্ধি করতেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়। লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিলেন এবং এই ষড়যন্ত্রেরই শেষ পরিণতি হলো তিনি নিহত হলেন। কিন্তু কেউ জানলো না, কিভাবে তিনি মারা গেলেন, কীভাবেই প্রকাশ্য সভায় পিস্তল উঁচিয়ে তাকে হত্যা করা হলো। তখন বঙ্গবন্ধুও কারাগারে, মওলানা ভাসানীও জেলে। এবং লিয়াকত আলী খানের নির্দেশেই তারা তখন কারাগারের অভ্যন্তরে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ পেয়েছিলাম’। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি দিয়ে আর যাই হোক গণতন্ত্র আসে না। গণতন্ত্রহীন একটা দেশ মানে অস্থিতিশীল একটা জাতি। পাকিস্তান সেই অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতাই চলছে এখনো প্রতিদিন। বোমা পড়ছে, নিহত হচ্ছে মানুষ প্রতিদিন, পাকিস্তানে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫১ সালের শেষের দিকে ঢাকা জেলে এসে দেখা হয় তারই এক সময়ের সতীর্থ (মুসলিম লীগের কর্মী) মহিউদ্দিনের সঙ্গে। মহিউদ্দিন সাহেবকে তিনি এবং তার সহকর্মীরা ভালো চোখে দেখতেন না। পাকিস্তানের পক্ষের শক্তির নেতা ছিলেন মহিউদ্দিন। অথচ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কারণে পাকিস্তান সরকারই তাকে বান্দ করল। জেলে মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তার দেখা হয়, আলাপ হলে দেখলেন তিনি মহিউদ্দিন সাহেবের নীতিগত পরিবর্তন আসছে। তখন তার সঙ্গে তিনি আন্তরিক হলেন। আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা তিনি বানিয়ে নিলেন আবারো তাকে। জেলে থেকেই তিনি মহিউদ্দিনের মুক্তির ব্যাপারে আন্দোলন করার জন্য তার সহকর্মীদের অনুরোধ করেন। মহিউদ্দিকে কেউই তখন ভালো চোখে দেখত না। বঙ্গবন্ধু সবাইকে তখন বলে-কয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবির সঙ্গে মহিউদ্দিনের মুক্তির দাবিটিও সরকারের নজরে নিয়ে আসেন। এভাবেই একজন বিরুদ্ধ ধারার কর্মীকেও বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বে আপন করে নিতে পারতেন। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় নেতারা গডফাদারের মতো। তাইতো কর্মীরা এখন ‘ভাই’ সম্বোধনে যেন ভয় পায়। ‘লিডার’ কিংবা ‘বস’ এখন যেন নেতাদের অপরিহার্য সম্বোধন। কয়েক বছর আগে আমি বাড়িতে গেছি। দেখি যুবলীগ করা আমার এক বন্ধু একজন জনপ্রতিনিধিকে লিডার হিসেবে ফোনে সম্বোধন করছে। আমি বিস্ময়ে তাকে বললাম, এর আগেতো আমরা সবাই তার নামের পরে ভাই বলতাম। বলে সময় বদলেছে। অথচ এ বন্ধুটি এলাকার নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী পরিবারের একজন। পার্টি কিংবা এলাকায় জনপ্রিয় এই পরিবার কোনোদিন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেয়নি। আজো তারা এতে নেই। অথচ সেও বলল সময় বদলেছে। কিন্তু কি এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। তাঁরই সঙ্গে পথ চলা দু’এক নেতা কিংবা সাংবাদিকদের মুখে শুনেছি, তারা অকাতরেই বঙ্গবন্ধুকে ‘মুজিব ভাই’ বলতেন। নিজ কর্মীদের তো বটেই, সাংবাদিকদের কিংবা এমনকি বিরুদ্ধবাদীদের এই ‘মুজিব ভাই’ই তাঁর পাহাড়-সমান জনপ্রিয়তায় হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির পিতা।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে যেন পাঠক বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। পল্টনের লাখো জনতার সেই বঙ্গবন্ধু, সাড়ে সাত কোটি মানুষের সেই বঙ্গবন্ধু যেন স্তব্ধ করে দেন তাঁর আবেগ দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে বলছেন, “এক সময় হাসিনাকে বলছে ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমিতো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই, তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝাবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।”- নিজের পরিবার থেকে এভাবেই বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন যেন বিচ্ছিন্ন। ছেলের কাছে আব্বা ছিলেন হাচু আপার আব্বা। পৃথিবীর কয়েকটি মায়াবী শব্দের মাঝে একটা শব্দ আব্বা। অথচ এই শব্দটিও কামালের কাছে ছিল যেন অধরা। অধরা হয়ে একজন বঙ্গবন্ধু হয়তো কামালের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন কিন্তু শিশু কামালের কাছ থেকে দূরে থাকলেও বাংলা আর বাঙালির লাখো-কোটি কামালের তথা জাতির পিতা হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু কি কোনো স্বপ্ন দেখতেন? আমার মনে হয় তিনি স্বপ্ন দেখতেন না। তিনি স্বাপ্নিক ছিলেন না। তিনি স্বপ্ন দেখাতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তিনি ছিলেন দৃঢ়। একটা জাতিকে তিনি লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজ হাতে নিয়েছিলেন। এটা কোনো স্বপ্ন নয়। এটা ছিল বাঙালি জাতির অধিকার। অধিকার স্বপ্ন হতে পারে না। অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়। যে লড়াইয়ে তিনি নেমেছিলেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। তাইতো তার জাদুকরী ডাকে মানুষ সম্মোহিত হয়েছে। ঝাঁপিয়ে পড়েছে কোটি কোটি মানুষ, যুদ্ধ করেছে। লাখ লাখ মানুষ বিসর্জন দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সোনার বাংলা ছিল না। তিনি বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, এটা ছিল বাস্তবতা। দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েছিলেন। তিনি সার্থক। ব্যর্থ শুধু কাপুরুষরাই। কারণ তারা তাকে হত্যা করেছে। মাঝপথে অসমাপ্ত রেখেছে তার দেশ গড়ার কাজ। আর সেজন্যই বক্তৃতায় যারা আজ বলেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, তারা ভুল করেন। বঙ্গবন্ধুর যেমন অসমাপ্ত আত্মজবিনী, ঠিক তেমনি তাঁর অসমাপ্ত কর্মযজ্ঞ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। স্বপ্ন দিয়ে তাকে ঢাকলে চলবে না। যুক্তি-দেশপ্রেম-প্রত্যয় নিয়েই মোকাবেলা করতে হবে আজকের বাংলাদেশের প্রতিক‚লতাকে। পঁচাত্তরের প্লট সৃষ্টি করেছিল যারা, পঁচাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায় রচনা করেছিল যারা, তাদের প্রেতাতœারা ঘোরে এখনো দেশে, হয়তো নিজ দলেও। মুজিব কোট পরে এখনো কি ঘুর ঘুর করছে না কোনো মোশতাক, তার কি কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে? ভাবতে হবে, সে ভাবনাটা থাকতে হবে প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর সমর্থক আর দেশপ্রেমিক জনগণদের।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।

SUMMARY

1740-1.png