১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের সূর্যসন্তান, সাহসী বীর ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ইতিহাসের বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পথভ্রষ্ট ওই হায়েনার দল বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা করেছিল বাংলাদেশের হৃদয়কে। দেশের বাইরে থাকার ফলে বেঁচে যান তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর আজ বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এখনো একাত্তরের ওই অপশক্তির থাবা থেকে বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের ছত্রছায়ায় হামলে পড়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বেসামাল করতে তৎপর।
একজন রাজনীতিবিদ মানে আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। রাষ্ট্র-সমাজের যে কোনো সংকটে তিনিই সবার আগে এগিয়ে আসেন। যেন সব কর্মভারের দায়িত্ব নিয়েই এই পৃথিবীতে তার আগমন। তিনি রাষ্ট্রের একজন ত্রাতা হিসেবে নিজেকে আমজনতার কাতারে সর্বদা অবিচল রেখে মানবসভ্যতার চাষাবাদ করে যান নীরবে। রাজনীতিবিদ সম্পর্কে উল্লিখিত মন্তব্যের পরিচয় মেলে আমাদের জাতীয় বীর, বাঙালি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে পাঠক এমন এক মহান ব্যক্তিত্বকে খুঁজে পাবেন যিনি রাষ্ট্রীয় ও গণমানুষের স্বার্থে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোকে ব্যয় করেছিলেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তিনি ছুটে গেছেন দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে অনাহারে, অর্ধহারে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ছিলেন। নেতাকর্মীদের মধ্যকার সুসম্পর্ক স্থাপন এবং তথ্যের নিবিড় প্রচারণায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন শেখ মুজিব তথা শেখ সাহেব। তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু মানে এক আপসহীন নেতার নেতৃত্ব। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অন্যতম গুণ ছিল জ্ঞান অনুরাগী, তুখোড় বক্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানসিকতা, কেন্দ্রীয় বিষয়ের প্রতি ঝোঁক, পরোপকারিতা, ন্যায়ের প্রতি অবিচল, আদর্শে অটল। তিনি কখনোই পিছু হটার মতো ব্যক্তি ছিলেন না। বীরদর্পে কেবল সামনের দিকেই ছুটেছেন। এনে দিয়েছেন একটি সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর বর্তমান অবস্থান, তাঁকে কেউ উপহার দেয়নি, বরং তিনি তাঁর ব্যক্তিক যোগ্যতায় বাঙালি জাতির পিতার আসনটি অর্জন করে নিয়েছেন। বিশ্বের প্রভাবশালী নেতারা তাঁদের বক্তব্যে বা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে যথার্থভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা আমাদের জন্য পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় বিবেচিত।
২০১৩ সালের ১৩ জুন প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং এর ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য আনফিনিশড মেময়ারস’। একই দিনে ভারত ও পাকিস্তান থেকে একযোগে প্রকাশিত হয় দ্য আনফিনিশড মেময়ারস। ইউপিএলের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় ভারতে বইটি প্রকাশ করে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানে প্রকাশ করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় এটির রচনা শুরু করেন, কিন্তু তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। বইটিতে তাঁর আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজ জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রত্যক্ষ বর্ণনা রয়েছে। এ ছাড়া বইটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেলের ভেতর ও বাইরের জীবন, পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি ও পরিবার-পরিজনের কথা অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। আমরা জানি, কেবল বই পড়ে কেউ সফল রাজনীতিবিদ তথা সেলিব্রেটি হতে পারে না। সফল ব্যক্তিত্বের আদর্শ অনুসরণ করতে পারলে এবং মননে তা ধারণ করতে পারলেই কেবল সফলতার সিঁড়িতে আরোহণ করা যায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক বইটি পাঠকদের সামনে কিছু নিখুঁত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি আদর্শিক সংগ্রামকে অবলোকন করি।
বর্তমানে তরুণদের একটি বিশাল অংশ ক্ষণিক বা স্বাভাবিক ভালো লাগা থেকে রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করলেও, জাতির জনক ও তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই রাখেন না। তাদের অধিকাংশের কাছে জাতীয় দিবস ও দিবসের প্রেক্ষাপট এখনো বেশ অস্পষ্ট। তারা কেবল কথিত ফায়দা লুটার কাজে ন্যস্ত থাকে। নিজের পকেট পুরো করতে আমজনতার সর্বস্ব লুট করতে তাদের এতটুকু বাধে না। বর্তমানে রাজনীতির মাঠে আদর্শের সংকট চরমে। তাই একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে রাজনীতিতে ভালো মানের অবস্থান তৈরি করতে হলে তাকে প্রথমেই বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, আপসহীন রাজনীতিবিদ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক জীবনবৃত্তান্ত জানা ও তাঁর আদর্শকে ধারণ করার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে- তা অনুধাবন করতে হবে। আজকাল ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রটি খুবই দূষিত, তাছাড়া আদর্শিক সংগঠনগুলোর নামে-বেনামে শাখা সৃষ্টি করে গণমানুষ অতিষ্ঠ অধিকার ভাগ-বাটোয়ারা করতে এসব ভুয়া রাজনৈতিক সংগঠনগুলো উঠেপড়ে লেগেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর মতো নেতৃত্বের আজ বড় দরকার। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসুক আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের কথা ও কাজের মাঝে। গণমানুষ যেন ফিরে পায় স্বাধীনতার অমৃত স্বাদ।
শহিদ রাসেল
চট্টগ্রাম; লেখক।