বিশ্ব ইতিহাসে বিরল যে হত্যাকাণ্ড


আগস্ট মাস বাঙালির কাছে ট্র্যাজেডির মাস, নির্মমতার মাস। এক বুক দুঃখ ও কষ্ট নিয়ে প্রতি বছর এ মাসটি স্মরণ করা হয়। শুধু বাংলাদেশে নয় বরং বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি বাঙালিই এই মাসকে লালন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সম্রাট। অবিসংবাদিত এ নেতা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত-নির্যাতিত জনতার মুক্তির ইতিহাসে কিংবদন্তি। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন যে, ‘শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উঁচুতে ছিল তার মাথাটি, সহজেই চোখে পড়ত তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সব বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ। এই মহান নেতা জন্মগ্রহণ না করলে হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশ লালিত স্বপ্ন হয়েই থাকত। অথচ তার জীবনেই ঘটল নির্মম ট্র্যাজেডি। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে বিরল নির্মমতারই মুখোমুখি হলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরের সূর্য আলো ছড়িয়ে দেয়ার আগে এক নির্মম হত্যার শিকার হন বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য প্রায় সব সদস্য। এ এক কঠিন নির্মমতা! এ এক অসামান্য ট্র্যাজেডি ও অসমাপ্ত কষ্টের সীমাহীন যন্ত্রণাযুক্ত অনুভূতি।

দুই.

নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’ দক্ষিণ এশিয়ায় এমন কি সমগ্র বিশ্বেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বের ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকন, মাহাত্মা গান্ধী, জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং, ললুম্বা, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিশ্বের যে কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিষ্কার পার্থক্য লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে যা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীতে এমন কোনো হত্যাকাণ্ড হয়নি যেখানে পুরো পরিবারকে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল, একমাত্র বঙ্গবন্ধু পরিবার ছাড়া। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড বাঙালির ইতিহাসে নির্মম ট্র্যাজেডি। এ অভাগা এ জাতির জন্য ১৫ আগস্ট মর্মবিদারি ভয়াবহ শোকের দিন। তাই তো আমাদের জন্য আগস্ট মাস শোকের মাস। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতের আঁধারে এ জাতি হারিয়েছে জনককে। যদিও শেখ রাসেলসহ অনেকেই রাজনীতির বাইরে ছিলেন তথাপিও কেন তাদের হত্যা করা হয়েছিল- সে প্রশ্নের জবাব আজো অমিমাংসিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাষী সদস্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ঘাতকরা সেদিন বাংলাদেশের জাতির জনকের সঙ্গে আর যাদের হত্যার শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, শিশুপুত্র রাসেল, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও পুত্রবধূদ্বয়কে, একমাত্র ভাইসহ অন্য স্বজনদের। হত্যার মাধ্যমে পরাজিতরা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল পরাজিত শক্তিদের নীলনকশা। তাদের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তারা এ জাতির বিরত্বগাথা ইতিহাসকে অপ্রাসঙ্গিক করবে। বাঙালির ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বোপরি ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান এবং লাখ লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা এ স্বাধীনতা অর্থহীন করে দিতেই ছিল তাদের পরিকল্পনা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্রের সংকট মৌলবাদের পুনর্বাসন, জঙ্গিবাদের উত্থান ও যুদ্ধাপরাধী প্রত্যাবর্তন। ১৫ আগস্ট পঁচাত্তর বাঙালি জাতির এক বিশাল কলঙ্কের অধ্যায়। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড সংঘটন হওয়ার পর ইংলিশ এম পি জেমস লামন্ড দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার হতে সময় লেগেছে ৩৪ বছর। বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, জনক হত্যার বিচারের জন্য আদালতে মামলা উঠাতেই সময় লেগেছে ২১ বছর। তথাপিও সুখের বিষয় এই যে, বিচার সম্পন্ন হয়েছে। রায়ও আংশিক কার্যকর হয়েছে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তিন.

আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ রাজনীতিবিদ, কেউ আইনজীবী, কেউ চিকিৎসক আবার কেউ লেখক এসব সম্ভব হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন বলিষ্ঠ নেতার শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে। আমরা যে যেখানে আছি সে অবস্থান থেকেই বিশ্ব ইতিহাসে ঘটে যাওয়া একটি বিরল হত্যাকাণ্ডের শিকার এই অবিসংবাদিত জননেতার মূল্যায়ন করা উচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে বাঙালি জাতি বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হয়ে অহর্নিশ যন্ত্রণার দহনে দগ্ধ প্রতিনিয়ত। জাতি যখন ১৯৭১-এর মতো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তখন বিশ্ব এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর দেখতে পেয়েছে। আর এ বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এমনি এমনি হয়নি বরং এর জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, অগ্নিগিরিতে পরিণত করেছিল, যার পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিল। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিল শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালিকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।

এডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার : আইনজীবী, লেখক।

SUMMARY

1737-1.png