২৩ মে ১৯৭৩ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ‘জুলিও-কুড়ি’ শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি শুধু যে একটি স্বাধীন দেশ, একটি পতাকা বা পাসপোর্ট দিয়েছিলেন তা নয়, তিনি শোষণ, বঞ্চনা ও ধর্মীয় বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের কথাও বলেছিলেন। এরপর ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সপরিবারে নিহত হলেন জাতির জনক। একটি মিছিল, একটি প্রতিবাদ হলো না। মুক্তি সংগ্রাম করে যে জাতি বীরের সম্মান অর্জন করেছিল, সেই জাতির কপালে জুটল ‘বেইমান’ পদক। হারিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। বেশ কিছুদিন তার নাম ভুলেও কেউ মুখে আনল না। একদল মানুষ ভারতে গেল, কিন্তু ষড়যন্ত্রে সেটাও ভেস্তে গেল। ১৯৮১-তে এলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। একটু একটু করে বঙ্গবন্ধুর কথা শোনা যেতে লাগল। ঘরোয়া রাজনীতি-রাজনীতি শুরু হলে আস্তে আস্তে মানুষের জড়তা কাটতে লাগল, বঙ্গবন্ধু প্রতিভাত হতে শুরু হলো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলো। বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত হলেন। আবার হারিয়ে গেলেন ২০০১-এ। পূর্ণ মর্যাদায় আবার এলেন ২০০৯-এ পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর।
যখন বঙ্গবন্ধুর বাবা মারা গেলেন। বঙ্গবন্ধু শোকাতুর হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তখন মোশতাক যত কেঁদেছিলেন, বঙ্গবন্ধুও সম্ভবত তত কাঁদেননি। জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য এখন যখন কেউ কেউ অতিমাত্রায় ভক্তিতে গদগদ হয়ে যান, তখন অন্যরা ভীত হন, কারণ ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরের মেঘ দেখলে ভয় পায়’। আগস্ট মাস শোকের মাস, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। অনেক কথাই মনে পড়ে। আমরা তখন ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। শেখ কামালকে বহুবার দেখেছি। টিএসসিতে সবার সঙ্গে বসে তিনি আড্ডা মারতেন। কখনো-সখনো আমরাও সেখানে ছিলাম, তবে পেছনের দিকে। সবার সঙ্গে বসে তিনি বাদাম খেতেন, হাসিঠাট্টা করতেন, তখন মনে মনে ভাবতাম, প্রেসিডেন্টের ছেলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে, অবাক হতাম। শেখ কামালকে কখনোই কেউকেটা মনে হয়নি। আর পাঁচটা ছাত্রছাত্রীর মতোই তিনি ছিলেন একজন সাধারণ ছাত্র। তার পোশাক আচার-ব্যবহারও ছিল একজন সাধারণ বাঙালি যুবকের মতো।
বলে রাখা ভালো, জীবনেও শেখ কামালের সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়নি। পরিচয়ও না, তিনি আমাকে চেনার প্রশ্নই ছিল না। তবে তাকে দেখেছি বহুবার। একবার কার্জন হলের বাইরে একটি মিছিল হয়, শেখ কামাল সেদিন স্লোগান দেন। একটি স্লোগান আমার এখনো মনে আছে, কারণ সেটি ভেবে তখন হেসেছি, এখনো হাসি। শেখ কামাল যখন স্লোগান দেন, ‘আমার ভাই, তোমার ভাই, মুজিব ভাই, মুজিব ভাই’-তখন না হেসে উপায় আছে? এই শেখ কামাল সম্পর্কে আমারা কত আপত্তিকর কথা শুনতাম। ডলি জহুর সেদিন টিভিতে কিছু কথা বলেন, যেগুলো আসলেই তো সত্য। তখনকার সময়ে শেখ কামাল সম্পর্কে অনেক কট‚কথাই চালু ছিল, বলা হতো তিনি ব্যাংক ডাকাত। শেখ পরিবারের ভাবমূর্র্তি নষ্ট করার জন্য তখন কত গল্পই না রটে। এমত একটি চুটকি শোনাই : ঢাকায় তখন বেশ ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছিল। সব দোষ বর্তায় শেখ কামালের ওপর। মাঝে হঠাৎ ক’দিন ব্যাংক ডাকাতি বন্ধ, গল্পটি এরকম : বঙ্গবন্ধু তার পতœীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁ গো, কামাল কি ঢাকায় নাই?’
এরকম অনেক মুখরোচক গল্প তখন চালু ছিল। আর শুধু শেখ কামাল কেন বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে অনেক গল্পই তখন সবার মুখে মুখে ছিল। এমন একটি গল্প ছিল এরকম : পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের নাম বদলে তখন বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বা বিমান হয়ে গেছে বা হবে। বঙ্গবন্ধু নাকি তার সহযোগীদের ডেকে বলেন, ‘আচ্ছা, জার্মান এয়ারলাইন্সের নাম যদি ‘লুৎফুন্নেছা’ (আসলে লুতফানছা) হতে পারে তবে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স বদলে ‘ফজিলাতুন্নেছা’ হতে দোষ কোথায়? এভাবেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের চরিত্রহনন করা হয়েছে। আমাদের মতো দেশে প্রেসিডেন্টের ছেলের টাকার দরকার হলে ব্যাংক ডাকাতির দরকার হয় না, ব্যাংক বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিয়ে যায়। অথবা বঙ্গবন্ধু যদি চাইতেন, বিমানের নাম তখন যা খুশি তাই রাখতে পারতেন। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এভাবেই শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলেছিল। তার মৃত্যুর পর দেখা গেল কামালের দুই টাকাও নেই, বঙ্গবন্ধুও কন্যার জন্য কিছুই রেখে যাননি। অথচ যাদের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, তারাই বাপের দেয়া তার প্রাণটিও কেড়ে নিয়েছে।
সুলতানা কামালকে নিয়েও আমরা কত গল্প শুনেছি। কামাল জোর করে সুলতানাকে বিয়ে করেছে, সেই গল্প তো সবারই জানা। আসলে কি তাই? প্রেসিডেন্টের ছেলের বৌ হওয়ার সৌভাগ্য কি সব নারীর হয়? কোন পিতা এমত প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন? সুলতানাকে আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখতাম। কার্জন হল থেকে জগন্নাথ হলে ফেরার সময় বিকেল বেলা ভার্সিটির প্যাভিলিয়নের মাঠে সুলতানা দৌড়াচ্ছে, এ ছিল প্রায় নিত্যকার দৃশ্য। মানুষ জানত সুলতানার বাবা রাজি ছিলেন না, জোর করে বিয়ে হয়েছে। সুলতানার মাথার মুকুট নিয়েও তো কত কথা! এখন তো দেখি ওরকম মুকুট মধ্যবিত্তের ঘরেও শোভা পাচ্ছে। শেখ জামাল নিয়ে অত কুৎসা না থাকলেও রোজীর সঙ্গে বিয়ের সময় কিছুটা বদনাম হয়। আর শেখ কামালের সঙ্গে লেডিজ ক্লাবে মেজর ডালিমের গণ্ডগোল তো এতটাই চাউর ছিল যেন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ওটাও একটা অন্যতম কারণ!
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার নেই, আর লিখতে চাইলেও সেটা ‘অন্ধের হাতি দেখার মতো হয়ে যাবে’। এত বড় নেতাকে মাপা সহজ নয়। তবে ১৫ আগস্ট এলে আমার একটি কথা মনে হয়। বঙ্গবন্ধুকে যিনি, অর্থাৎ যেই মাওলানা সাহেব কবর দিয়েছিলেন তার একটি সাক্ষাৎকার আমার নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। আশির দশকে তিনি একবার বাংলার বাণীতে আসেন। সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিম আমায় ডেকে তার একটি ইন্টারভিউ নিতে বলেন। বাংলার বাণীতে এক ক্রোড়পত্রে সেটি ছাপাও হয়েছিল। মাওলানা সাহেবের কাছেই জেনেছিলাম, জাতির জনককে ৫৭০ সাবান দিয়ে শেষবারের মতো গোসল করানো হয়েছিল। মাওলানা সাহেব বর্ণনা দিয়েছিলেন, কতটি গুলি লেগেছিল, কোথায় কোথায় লেগেছিল; মিলিটারি কতক্ষণ সময় দিয়েছিল কবর দেয়ার জন্য ইত্যাদি। দুঃখের বিষয়, বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেছে, লেখাটি আমার কাছে নেই; থাকলে, তথ্য ঠিক রেখে একটু ঘষেমেজে নতুন করে বারবার ছাপানো যেত।
১৩ আগস্ট ২০১৬
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।