ট্র্যাজেডির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু


ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা হচ্ছে, ‘আত্মদ্ব›েদ্ব পরাভূত বা অভিভূত মানব জীবনের করুণ কাহিনীকে ট্র্যাজেডি বলে।’ কোনো সাধারণ চরিত্র ট্র্যাজেডির চরিত্র হয় না, কোনো সাধারণ মৃত্যুও ট্রাজেডি বলে গণ্য হয় না। পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক বড় মাপের চরিত্রই ট্র্যাজেডির উপযোগী চরিত্র। যার উত্থানে একটি জাতির উত্থান ঘটে, যার পতনে একটি জাতির পতন ঘটে তেমন কারো বিয়োগান্তক পরিণতিতে ট্রাজেডির জন্ম হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তেমনি একটি ট্র্যাজিক চরিত্র।

যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না, আওয়ামী লীগ তথা বাঙালি জাতির একটি কঠিন দুঃসময়ে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর পর বিবিসি শ্রোতাদের ভোটে বঙ্গবন্ধু শতাব্দীর সেরা বাঙালি হিসেবে হিসেবে নির্বাচিত হন। রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন দ্বিতীয়, বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

জীবদ্দশায় কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি, লোকান্তরে গিয়েও নির্বাচন বিজয়ী হয়েছেন। রাজনীতির ময়দানে যাদের তিনি গুরু মানতেন, তারা শ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির তালিকায় বঙ্গবন্ধুর অনেক নিচে স্থান পেয়েছেন। এতে সেদিন প্রমাণিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ট্রাজেডির উপযোগী বড় মাপের চরিত্র। তিনি ট্র্যাজেডির মহানায়ক। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরাই তার চরিত্রকে ট্র্যাজেডির মহানায়কে রূপদান করেছে। গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস রাজা ইডিপাস নাটকে দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রে অঘটন ঘটেছে, পাপকর্ম হচ্ছে, এর চরম খেসারতও দিতে হবে, এ ধরনের দৈববাণী হওয়ার পর রাজা উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে। তিনি নিজের বিপদের কথা একবারও ভাবেননি। পাপের শেকড় উৎপাটন করে প্রজার হিত কামনায় তিনি বিপদ মোকাবেলা করার ঝুঁকি নিয়ে, পেছনে নয় যাচ্ছিলেন সামনের দিকে। শেষ পর্যন্ত তিনিই বিপদে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পলায়নপরতা রাজার মধ্যে ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর মধ্যেও পলায়নপরতা ছিল না। রাষ্ট্রে তখন নানা অঘটনের জন্ম হচ্ছে। বিপদের যে দিকটি বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল, সে দিক থেকে বিপদ আসেনি, যে দিকটি নিয়ে তিনি ভাবেননি, বিপদ এসেছে সেই দিক থেকে। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে আর্মি-ক্যু হতে পারে কিংবা আর্মির একটি অপগণ্ড, উচ্ছৃঙ্খল অংশ তার মতো মহানায়কের সমূলে উৎপাটন করবে, একথা তিনি ভাবেননি। ভাবতে পারেননি। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের মধ্যে এখানেই ট্র্যাজেডির বীজ নিহিত।

তখন দেশে বন্যা হয়েছে, দুর্ভিক্ষ হয়েছে, চরমপন্থীরা অস্ত্র লুট করে, থানা লুট করে আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যাচ্ছিল, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ষড়যন্ত্রের ঘোঁট পাকিয়ে যাচ্ছিল, দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল, মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। এই সব পরিস্থিতি বঙ্গবন্ধুকে বিচলিত করেছিল। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি এক পর্যায়ে বলেছিলেন ঔপন্যাসিক মনোজ বসুর কাছে, ‘ভারতীয় সাংবাদিকরা আমার পেছনে লেগেছে কেন? তারা দেখুক না আমি সামাল দিতে পারি কিনা। না পারলে আত্মহত্যা করবো।’ (আমার ভালোবাসার দেশ।)

কারা আত্মহত্যা করতে চায়? ইদি আমিন, ফ্রাঙ্কো, সালাজার, সাদ্দাম, মার্কোস কিংবা জেনারেল টিক্কা খানের মতো স্বৈরাচারেরা কখনো আত্মহত্যার কথা ভাবে না। যাদের মধ্যে বিবেকের পীড়ন আছে, যারা হৃদয়ের মধ্যে জনগণের জন্য দায়বদ্ধতা বহন করে তারাই আত্মহত্যার কথা ভাবে। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, বার বার মহাত্মা গান্ধী অনশনব্রত পালন করে আত্মহননের পথেই গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুও দেশের সংকট আপন হৃদয়ে উপলব্ধি করে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা বহনের কারণে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সে পথে যাননি, কারণ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফেলেছিলেন। এজন্য তাকে বাকশাল গঠন করতে হয়েছিল। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তিনি মোটামুটি টেনশন মুক্ত ছিলেন। তিনি সব কিছু গুছিয়ে এনেছিলেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিশিষ্ট বিদ্বান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. এ,আর মল্লিককে। ড. মল্লিক অর্থনীতির বিশৃঙ্খল দিকগুলো কঠিন ও দক্ষ হাতে গুছিয়ে ফেলেছিলেন। মুদ্রাস্ফীতি দমিয়ে ফেলেছিলেন। দেশে তখন ভালো ফসল হয়েছিল। চালের দাম ১০ টাকা থেকে ৩ টাকা ৬০ পয়সায় নেমে এসেছিল।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি দিন অতিবাহিত হচ্ছিল। কর্মব্যস্থতার মধ্যে। ১৯৭৫ সালের আগস্টের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন ড. ওয়াজেদ, ‘১লা আগস্ট তারিখে এডভোকেট আবিদুর রেজা খানের নেতৃত্বে ঢাকা বার সমিতির ১৯৩ জন, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জনাব এ,এইচ, এম, কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে উক্ত ব্যাংকের ৪১২ জন, বাংলাদেশ বিমান বন্দর উন্নয়ন সংস্থার ৩৩৩১ জন এবং বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ সংস্থার ১৫৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাকশালে যোগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আবেদন পত্র পেশ করেন। একই তারিখে বাংলাদেশ দমকল বাহিনী, আনন্দ বাজার বণিক সমিতি এবং বাংলাদেশ হোমিও প্যাথ সমিতির পক্ষ থেকে বাকশালের সদস্য পদ লাভের জন্য আবেদন পত্র দাখিল করা হয়। ২রা আগস্ট বিশিষ্ট ন্যাপ (ভাসানী) নেতা জনাব আজাদ সুলতানের নেতৃত্বে উক্ত পার্টির ৪৫০ জন নেতা ও কর্মী ঢাকার সার্কিট হাউস রোডস্থ বাকশালের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দলের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনির কাছে বাকশালে যোগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আবেদন পত্র দাখিল করেন। ৩রা আগস্ট বাংলাদেশের আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে তদঞ্চলে ১৩২ কিলো ভোল্ট লাইনের উদ্বোধন করা হয়।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃ: ২৪২)।

বঙ্গবন্ধু নাকি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, বলেন জনবিচ্ছিন্ন তাত্তি¡করা। তাহলে তো তার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে গণঅভ্যুত্থান ঘটানো যেতো। তা কিন্তু হয়নি। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকে দেখা যায় ইব্রাহীম কার্দির মতো একজন বীর, একজন নায়ককে জেলখানায় ঢুকে হত্যা করেছে প্রতিহিংসা পরায়ণ দেড় আঙ্গুল এক সিপাই। বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও তাই ঘটেছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড পৃথিবীতে অনেক আছে কিন্তু ১৫ আগস্টের মতো ট্রাজিক ঘটনা আর একটিও নেই। এক রাতে তিনটি পরিবারের সকলকে একই সময়ে হত্যা করা হয়েছে। এই বর্বরতার তুলনাই হয় না। এর মধ্যে নারী আছে শিশু আছে। আবুল ফজল বলেছেন, কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে ধানমন্ডির ঘটনার মৌলিক পার্থক্য আছে। কারবালার উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানের হারজিৎ হয়েছে। কিন্তু ১৫ আগস্টের রাতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এমন জঘন্য ঘটনার ভেতর দিয়েও বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের ট্রাজিক মহিমা ফুটে উঠেছে। তিনি যত বড় তত বেদনাবহ বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আবুল ফজল তার ‘মৃতের আত্মহত্যা’ ‘গল্পে ১৫ আগস্টের পাশবিকতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার নবাব সিরাজকে হত্যার পর কী করেছিল লর্ডক্লাইভ, মীরজাফর ও মীরনরা? একই ভূমিকা পালন করেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ডালিম, ফারুক ও জিয়া-মোস্তাকরা। ঈর্ষার অনলে দগ্ধ আমাদের পণ্ডিতকুল এসব একটু তলিয়ে ভাবেন না।

মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।

SUMMARY

1735-B9.jpg