শোক ভোলানোর অপচেষ্টা চলছেই


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। সেদিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।’ আর শেষ পৃষ্ঠায় বক্স-নিউজ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপিয়ে তার নিচে লেখা হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন সম্ভব হয়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে স্বাগত জানাতে পারেনি। সেদিন পত্রিকায় মুদ্রিত এই সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছার আগে যে খবরটি পৌঁছেছিল তা ছিল বিশ্বাসঘাতকের চরম আঘাতের খবর, সীমাহীন নিষ্ঠুরতা ও হৃদয় বিদারক ঘটনার খবর- সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার খবর। পরের দিন ১৬ আগস্ট দৈনিক বাংলায় মুদ্রিত হয় ‘খন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি’। এই খবরের সঙ্গেই ছোট হরফে উপশিরোনামে লেখা হয় ‘শেখ মুজিব নিহত : সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি : সশস্ত্র বাহিনীগুলোর আনুগত্য প্রকাশ’। শপথ গ্রহণের ছবিটির নিচে সেদিনের পত্রিকায় লেখা হয় ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপস নেই’ (!)। ঘাতকের মুখে উচ্চারিত এই শব্দগুলো কি ভূতের মুখে রামনাম মাত্র ছিল না? আজ এতদিন পর জাতি সেসব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করছে।

পাকিস্তানি স্বৈরশাসকচক্রের বিরুদ্ধে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন এই ভূখণ্ডটিকে যখন তিলে তিলে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছিল ঠিক সেই সময়েই ক্ষমতালোভী কিছু সংখ্যক বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সম্মুখভাগে তরুণ সেনা কর্মকর্তারা থাকলেও পশ্চাতে সক্রিয় ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতার লোভ আর প্রতিহিংসার লেলিহান দাবানল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান অর্জন করলেও পরাজিত পাকিস্তানসহ তার মিত্রশক্তি বা বন্ধু রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পারেনি। এমনকি, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও প্রদান করেনি। উপরন্তু আমরা এও দেখি যে, পুনর্বার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র কিংবা ফেডারেল শাসনের অন্তর্ভুক্ত করবার পাকিস্তানি ‘খায়েশ’ দীর্ঘদিন লালন করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই খায়েশ পূরণের স্পষ্ট লক্ষ্যেই দেখা যায়- ১৯৭৩ সালে ভুট্টো প্রণীত পাকিস্তানের সংবিধানে ‘পূর্বপাকিস্তান’ শব্দটিও সযতেœ বহাল রাখা হয়। সেই সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এরূপ ভাষ্য ব্যক্ত হয়েছে যে, ‘পূর্বপাকিস্তান প্রদেশের জনগণ যখন বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারবে এবং তার প্রভাবপ্রতিপত্তির বাইরে আসতে পারবে, তখন সেটি ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করবে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদেশি আগ্রাসন বলতে এখানে তৎকালীন ভারতকে বুঝানো হয়েছে। যদিও আমরা জানি যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সুদক্ষ নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো দেশ থেকে মিত্র বাহিনীর সদস্যদের এরূপ আচরণের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এটি সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসী নেতৃত্বের গুণেই। পৃথিবীর সব সচেতন নাগরিকের মতো এ কথা ভুট্টো সাহেবও জানতেন। পাকিস্তানের সংবিধানে ব্যক্ত ‘বিদেশি আগ্রাসনের’ কথা বলার আসল অর্থ ও উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা, বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা। এ লক্ষ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম দেশে ভুট্টো প্রচেষ্টা চালিয়েছে যেন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য পাকিস্তান ও তার মিত্রদের এ দেশের মানুষের ওপর বিশেষত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ú্রতিশোধ গ্রহণের প্রচেষ্টাও থেমে থাকেনি কখনোই। এদেশীয় ক্ষমতালোভীদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রচেষ্টায় তারাও সক্রিয় ছিল। দিনে দিনে সেসব ইতিহাসও বেরিয়ে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা নথি থেকে। প্রমাণিত হচ্ছে যে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক সুবিধাভোগী এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিতরা তথা পাকিস্তানি মনোভাবাপন্নরা একই সুতোয় গাঁথা।

জীবদ্দশায় স্বীকৃতি না দিলেও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো ‘বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের’ জন্য ৫০ হাজার টন চাল এবং ১৫ মিলিয়ন গজ কাপড় পাঠানোর নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের কোনো শেষ ছিল না। এই ষড়যন্ত্র পাকিস্তানি শাসক থেকে শুরু করে এ দেশে তাদের বশংবদ প্রেতাত্মারা এখনো অব্যাহত রেখেছে। তারা এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস ভুলিয়ে বাঙালি জাতিকে এক উন্মুল ভূঁইফোড় জাতিতে পরিণত করার মানসিকতা এখনো পরিত্যাগ করতে পারেনি।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে স্বাধীন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মদদে সপরিবারে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক ও তার অনুসারী কিছু লোভী সেনা কর্মকর্তা। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনীতিক হিসেবে খন্দকার মোশতাক এ দেশের সামগ্রিক রাজনীতিকে যেমন কলঙ্কিত করেছে তেমনি গুটিকতক লোভী সেনা কর্মকর্তার উচ্চাকাক্সক্ষার কাছে কলঙ্কিত হয়েছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী।

আজ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। অথচ পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ সময় এ দেশের স্বাধীনতার মহান এই স্থপতির নামটি উচ্চারণের সাহসই পেত না অনেকেই। উল্টো, যারা বিশ্ব ইতিহাসে কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক ও নরঘাতক হিসেবে চিহ্নিত তারা পুরস্কৃত হয়েছিল নানাভাবে নানারূপ উপঢৌকনে। একেই বলে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস! উপরন্তু এসব খুনি যাতে কোনো দিন বিচারের সম্মুখীন না হয় সে জন্য পরবর্তী সময়ের শাসকবর্গ ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের আড়াল করে রাখে। পাশাপাশি, ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ‘ভিলেন’ হিসেবে পরিচিত করে তোলার যাবতীয় প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। এই প্রয়াসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি শাসকবর্গসহ দেশি-বিদেশি অনেকেই সহায়ক শক্তি হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখে- যেমন ভূমিকা রেখেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যায়। ফলে আমরা দেখেছি, দীর্ঘদিন এ দেশে ১৫ আগস্ট কখনো শোক দিবস ছিল না। বরং এই ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় একটি মহল। তারা এই ষড়যন্ত্রেও অংশ হিসেবে ১৫ আগস্টকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ‘জাল’ জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করে নানা আড়ম্বরে পালন ও উল্লাসে মেতে ওঠে। এই উল্লাসে বাঙালি ভুলে থাকবে বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো করুণ ইতিহাসকে- তখন শাসক দলের এমন ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, বিএনপির সমকক্ষ কোনো রাজনৈতিক দল এ দেশে ক্ষমতা গ্রহণ করবে না, করতে পারবে না। তাই আমরা দেখি আজো নির্লজ্জ এক ‘জাল জন্মদিন’ পালনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করে চলেছেন! একটি চরম মিথ্যার ওপর একজন জাতীয় নেত্রী কি করে জনসম্মুখে মুখ দেখান সাধারণ সলজ্জ মানুষ তা ভাবতেও পারে না। যেখানে ইতোপূর্বে এ দেশের মানুষ জেনেছে যে, তার প্রকৃত জন্মদিন বা জন্ম তারিখ সম্পর্কে যথার্থরূপে জ্ঞাত আছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের প্রাক্কালে বিতরণকৃত জীবনবৃত্তান্ত থেকে, তার জন্ম তারিখ সম্পর্কে এ দেশের মানুষ আরো জেনেছে তার প্রথম পাসপোর্ট থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এই ‘নির্ভেজাল’ জন্ম তারিখের প্রমাণ কতই না হাস্যকরভাবে প্রকাশিত হয়েছে! তবু, ঘটা করে জাতীয় শোক দিবসে বয়সের বছরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার জন্মদিনের কেকের ওজন বাড়ছেই বাড়ছে!

কিন্তু পরপর তিন বারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও বেগম জিয়া শুধু ১৫ আগস্ট সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে এ কাজটি করে যাচ্ছেন। আমাদের বিবেচনায় আমরা এটুকু অন্তত বুঝতে পারি যে, পরপর তিন মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লিগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় বিএনপি আর বিকৃত ইতিহাসের পথ বেয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না। যদিও ইতিহাস বিকৃতিই বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনীতির আদর্শিক সম্বল। বাঙালির জাতীয় ইতিহাস বিকৃতির যে ধারাটি বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম সুবিধাভোগী জিয়াউর রহমান শুরু করেছিলেন খালেদা জিয়া যেন তার অসমাপ্ত বিকৃত রুচিটুকুর একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদান করছেন। কিন্তু সময়ের চাকা যে ঘুরে যেতে পারে সে ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা ও জাল জন্মদিন পালনে উপদেশদানকারীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। আজ তারা হয়তো উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে যে, বিএনপির আজকের এই পরিণতির পশ্চাতে ইতিহাস বিকৃতি, মিথ্যাচার ও দাম্ভিকতাই প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। অহঙ্কার পতনের মূল এই চির সত্য রাজনৈতিক দল বিএনপির দিকে তাকালে খুব সহজেই মনে পড়ে। বিএনপি নেত্রীর উদ্দেশে শুধু বলতে চাই, বাঙালির জাতীয় শোকের ১৫ আগস্ট কখনোই কোনো জাল জন্মদিনের উল্লাসে ঢাকা পড়বে না- বরং মিথ্যা মরীচীকারই পতন অবশ্যম্ভাবী। কোনো অপচেষ্টার আড়ালে বিলীন হবে না ১৫ আগস্টের শোক। শত শত জন্মদিনের আনন্দ-উল্লাসে আমরা কোনো দিন ভুলব না এই দিনটির বেদনার্ত হাহাকারের কথা।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

1734-1.png