বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ মূল্যায়নে জড়তা কেন?


পুরো আগস্ট মাসই শোকের মাস হিসেবে গৃহীত হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও অনেক আলাপচারিতা হয়েছে। যারা তার ব্যক্তিত্বের বিরোধিতা করেন, তারা বিভিন্ন অসৌজন্যমূলক বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। যারা পক্ষে বলেছেন, লিখেছেন, তারাও প্রকৃত মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেই অনেক বাজে কথা বলেছিল শত্রুপক্ষ। তার মধ্যে স্বৈরাচারী শব্দটাও ছিল। পার্টির অনেক নেতাকর্মীও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বকে সহ্য করতে পারত না। বিশেষ করে উপদলীয় বিভক্তির কারণে তার বিরুদ্ধে পার্টির মধ্যেই নানারকম কথাবার্তা বলাবলি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর পরই তার অনেক নিকটজনও সুবিধা পাওয়ার জন্য অহেতুক নিন্দামন্দ করেছিল। তখন তাদের উদ্দেশ্য ছিল কী করে খোন্দকার মোশতাক এবং সামরিক বাহিনীর লোকজনদের কাছ থেকে হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া। অনেকেই ভেবেছিলেন মোশতাকের মাধ্যমে কিংবা সামরিক বাহিনীর লোকজনের মাধ্যমে ধনকুবের হবেন কিংবা আজীবন বড় মন্ত্রী হয়ে জীবনযাপন করবেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন ক্রমপর্যায়ে দেশের রাজনীতির পুরো নেতৃত্ব এক সময় তাদের হাতেই আসবে। জাসদই কেবলমাত্র সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল, তা নয়। দলছুট আওয়ামীরাও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। উভয়পক্ষই জনতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। যার ফলে তাদের মধ্যে এখন যারা বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন করেন, তখন দেখা যায় প্রকৃত শব্দ চয়নে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। কিংবা ইচ্ছা করেই প্রকৃত ‘বর্ণনা’ দিচ্ছেন না।

বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্ব অনুধাবন করা সম্ভব না। হয়তো আংশিক জানা যেতে পারে। তার কারণ তাকে আন্তরিকভাবে কেউ কখনো দেখার-বোঝার চেষ্টাই করেনি। তাকে অহেতুক স্বৈরাচারী বলা হয়েছে। কিন্তু তার বিশাল পিতৃত্বসুলভ হৃদয়কে দেখা হয়নি। তিনি পার্টিতে যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা ছিল পিতৃত্বসুলভ অভিভাবকত্ব। তিনি জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় তার স্বভাবসুলভ অভিভাকত্বের অনুশীলন করেছিলেন। এ ধরনের অভিভাবকত্বে প্রকাশ বড় বড় সমাজ বিপ্লবীদের মধ্যে দেখা যায়। যেমন লেলিনের বিশাল ব্যক্তিত্বকে অনেকেই ভুল বুঝলেও তার ঘনিষ্ঠজনরা কিন্তু ঠিকই বুঝেছিলেন যে, তিনি জাতির অভিভাবক হিসেবে স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক সময় তার কমরেডরাও বলতে শুরু করেন যে, লেলিন ভুল করতে পারেন না। স্টালিনের মতো দৃঢ়চিত্ত মানুষও এমন কথাই বলতেন। এটি স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গির আলামত নয়। এটি জাতীয় অভিভাবকত্বের আলামত। হো চিমিনের মধ্যেও এ রকম অভিভাবকত্বের প্রকাশ ঘটেছিল। তিনি পিতৃসুলভ স্নেহ ভালোবাসায় এবং ব্যক্তিত্বের অনুশীলন করে অসংখ্য ভিন্ন মতের কমরেডদের এক পতাকাতলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবারই প্রিয় হো-চাচা। মাও জেডাংকেও স্বৈরাচারী বলেছেন কেউ কেউ। ওয়াং মিং অনেক বড় নেতা হয়েও এক সময় মাওকে স্বৈরাচারী বলেছেন এবং জবরদস্তি মতামত চাপিয়ে দেয়ার জন্য নিন্দাও করেছেন। মাও জেডাংয়ের মতো গণতন্ত্রকে তিনি কটুভাষ্যে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মাও জেডাংই সঠিক পথে বিপ্লব করেছেন। তার ঐতিহাসিক লং মার্চ ভুল ছিল না এবং তার সাংস্কৃতিক বিপ্লবও সঠিকই ছিল যে কারণে এখন চীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছে। যে মাকির্নীরা চীনকে এক লহমায় এটম বোমা মেরে ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছিল, সেই মাকির্নিরাও এখন চীনের দ্বারস্থ হয়েছে বহুভাবে। চীনের এই বিশাল উন্নতি সাধিত হয়েছে, তাদের জাতির পিতা মাও জেডাংয়ের অভিভাবকত্বসুলভ ব্যক্তিত্বের অনুশীলনের কারণে। বঙ্গবন্ধুর মধ্যেও ‘অভিভাবকত্বের’ বিকাশ ঘটেছিল। তিনি পার্টির প্রবীণদেরও স্নেহ করতে শুরু করেন। যেমন তার প্রত্যক্ষ প্রতিদ্ব›দ্বী খোন্দকার মোশতাককে তার সব অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন পিতৃত্বসুলভ স্নেহের কারণে। মাহবুবুল আলম চাষীর ব্যাপারটাও তাই। তাকে যখন বলা হয়েছিল, কতিপয় নেতাকর্মী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস অনেক ন্যায়-অন্যায় করেছে, তখন তিনি তাদের শাস্তি না দিয়ে পিতৃত্বসুলভ স্নেহে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাদের অনেককেই যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বড় পদে বসিয়েছিলেন। যে কারণে যোগ্যতার বাইরে ‘বস্তু’ পেয়ে তারা দিশাহারার মতো কাজ-কারবার করেছিলেন। এখন আবার তাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু শব্দ চয়নে আড়ষ্টতা থাকছেই।

বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করে পাঠপুস্তক রচনা করা উচিত। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ইচ্ছা করলেই হ্যান্ডবুক রচনা করতে পারে। এই হ্যান্ডবুকগুলো ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিতরণও করতে পারে। এটির আশু প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কেননা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা প্রকৃত ঘটনা জানে না। তারা বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন বইপুস্তক পড়ে। এই বইগুলো আবার বিভিন্ন রকম তথ্যাদিতে ভরপুর। তার মধ্যে অসংখ্য বই আছে, যেগুলো ইতিহাস বিকৃতিতে ভূমিকা পালন করছে। ক’দিন আগে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। কয়েকটি কলেজের ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে যে, তারা মনে করে মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেননা, সে সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তাজউদ্দীন আহমদ যে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন এবং মাঠ পর্যায়ের যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেটি কারো জানা নেই। ছেলেদের চেয়েও মেয়েদের মধ্যে তথ্য বিভ্রাট বেশি। মনে হয় মেয়েদের মধ্যে এসব মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ হলে হয়তো ছেলেমেয়েদের মধ্যে দ্বিধাদ্ব›দ্ব কেটে যেত। যারা পরিকল্পিতভাবে ইতিহাস বিকৃত করেছে তারা এখন তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তারাও কি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন?

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক হ্যান্ডবুকের প্রয়োজন হয়েছে এ কারণে যে সংক্ষেপে স্বল্প পরিসরে সব কিছুই জানার আর কোনো বই নেই। বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীর জন্য বই ছাপার কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা যেসব বই ছাপায় তার মধ্যে পাঠ্য হিসেবে হ্যান্ডবুকও ছাপা যেতে পারে। কিন্তু হ্যান্ডবুকের বিষয়টি কেবলমাত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার নয়। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ও হ্যান্ডবুক তৈরি করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ও হ্যান্ডবুক তৈরি করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো তিনটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ আছে। মুক্তিযুদ্ধ কেবলমাত্র ইতিহাসের বিষয় নয়, এটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ও। হ্যান্ডবুক তৈরির বিষয়টি সেভাবে দেখতে হবে।

ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ করবেন কলেজের প্রিন্সিপালরা। হাইস্কুলের হেডমাস্টাররা, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রভোস্ট দায়িত্ব পালন করতে পারেন। বেশি সমস্যা গ্রামের হাইস্কুল কলেজগুলোতে। শহরের মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সমস্যাও গ্রামের কলেজের মতো। আমার মনে হয় প্রত্যেক কলেজের বাজেট থেকেই ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপের ব্যয় সংকুলান করা সম্ভব। ইচ্ছা করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিঞ্চিৎ সাহায্য দিতে পারে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকা দেয়ার দরকার নেই। তবে ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ বাধ্যতামূলক না করলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় করবে না। সরকারি কলেজগুলো শিক্ষা সচিবের চিঠি পেলেই হয়তো করবে। কিন্তু প্রাইভেট কলেজ করবে কিনা সন্দেহ। কমপক্ষে ছয়টি ওয়ার্কশপ করবেন প্রিন্সিপাল সাহেবরা। সবাইকে নিয়ে। আর কমপক্ষে ছয়টি ওয়ার্কশপ করবেন বিভাগীয় প্রধানরা। তার বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। তাহলে ধরা যায় ছয় মাসে বারোটি ওয়ার্কশপ হবে। ওয়ার্কশপের আপ্যায়ন খাতের ব্যয়টাই বেশি হবে। কে দেবে এই টাকা? আবার ওয়ার্কশপ যাতে একঘেয়ে না হয় সে জন্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও থাকতে হবে এর সঙ্গে। কে এ খাতের ব্যয়ভার বহন করবে? সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় কি কিঞ্চিৎ ব্যয় বহন করতে পারে? সব কিছু ছড়িয়ে যায় সদিচ্ছার ওপরে। তবে বড় কথা হলো, ছেলেমেয়েদের সঠিক তথ্য দিলেই হবে না, ঠিকমতো বোঝাতে হবে। যে কারণে ওয়ার্কশপ করা দরকার। যদি এমন হয় যে ক’দিন পরেই নির্বাচন তবে কাজ শুরু করতে হবে এক্ষুনি। কেননা আমার মনে হয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ধোঁয়াশায় রেখে এখন নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া একটি জাতির জীবনে ছয় মাস খুব বেশি সময় নয়। ছয় মাসের মধ্যে যদি ইতিহাস বিকৃতি থেকে ছাত্রছাত্রীদের মুক্ত করা যায় তবে ধরে নিতে হবে যে, ছয় মাসে ছয় বছরের কাজ হলো।

ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় জেলার ডিসিদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। কিন্তু অহেতুক রাজনৈতিক চাপ না থাকে সে বিষয়টিও দেখতে হবে। তথাকথিত নেতারা চেহারা দেখাতে যাবে কাজের কাজ কিছুই করবে না। তা হতে পারে না। বিষয়টিকে একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখতে হবে। ওইসব ওয়ার্কশপে ছাত্রছাত্রীদের হাতে হ্যান্ডবুক তুলে দিতে হবে। আমার ভাবতে খারাপ লাগছে যে, এতদিনেও এই কাজটা ‘বাঙালি’ করল না। সমস্যার গভীরতা মনে হয় ভালোভাবে দেখা হয়নি। সরকার কি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে? শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় গুরুত্ব দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু সাংস্কৃতিকমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধা বিষয়কমন্ত্রী কি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন? সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব এই তিন মন্ত্রণালয়ের। অথচ বারবার বলা হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া জঙ্গিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। বাংলা একাডেমি কি হ্যান্ডবুক তৈরি করতে পারে? তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মনে হয় পারবে না। এ ব্যাপারে ব্যয় বা সময় সমস্যা নয়, প্রকৃত সমস্যা আন্তরিকতার। আন্তরিক হলে সব পক্ষই কিছু না কিছু কাজ করতে পারবে।

আশা করি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সরকারি হ্যান্ডবুক বাজারে পাওয়া যাবে। তথ্য মন্ত্রণালয় এ ধরনের কাজে টাকা ব্যয় করতে পারে। তারা কি কিছু টাকা স্কুল-কলেজের জন্য ব্যয় করবে? বাংলা একাডেমিকে টাকা দিলে তারা তাদের হয়ে কাজ করতে পারে। তারা নিজেরা ব্যয় করলে প্রচুর টাকা জলে যাবে। একাডেমিকে টাকা দিয়ে কাজ করানোই ভালো হবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার কেউ নেই বাংলাদেশে। কেবলমাত্র শেখ হাসিনাই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে কাজ করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি কি এই গুরুত্বপূর্ণ এবং ‘বড়’ কাজটা করবেন?

ড. ইশা মোহাম্মদ : শিক্ষক, লেখক।

SUMMARY

1733-B4.jpg