বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন এগিয়ে নেবে সমৃদ্ধির সোপানে


১৫ আগস্ট বাঙালির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। এ দিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন তাঁর নেতৃত্বে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে। একাত্তরের রক্তঝরা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়ে যে জাতি বিশ্বে পরিচয় পেল বীরের, স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই জাতি পরিচিত হলো ঘাতকের জাতি হিসেবে। বাঙালির এই বিকৃত পরিচয় পক্ষান্তরে বিশ্বে বঙ্গবন্ধুকেও খাটো করেছে। কেননা, বিশ্বের যে প্রান্তেই বঙ্গবন্ধু গেছেন তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হতো তিনি বারবার বলতেন- আমি বাঙালি, আমি বাংলার দুঃখী মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি। তাদের মুখে হাসি ফোটানোটাই আমার রাজনীতির মূল দর্শন। সেই বাঙালির কিছু দিকভ্রান্ত কুলাঙ্গার যখন ধানমন্ডির স্মৃতিময় বাড়ি আক্রমণ করল, তখনো বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতে পারেননি তাঁর ভালোবাসার মানুষগুলো তাঁকে নির্মম বুলেটের আঘাতে জর্জরিত করে দেবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে গেল সেটি। কেন ইতিহাসের এই নির্মমতা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে পনের আগস্ট পূর্ববতী ঘটনাপ্রবাহের কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।

অবিভক্ত ভারতে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর তিনি বুঝতে পারলেন নব্য এ রাষ্ট্রটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক নন। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ মনোবৃত্তি বঙ্গবন্ধুকে সবসময় পীড়া দিত। কিন্তু মানবতাবাদী এ নেতা কখনো পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতে না। বরং তিনি উভয় অঞ্চলের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সর্বদা সরব। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মানুষকে ভালোবাসলে মানুষ জীবন দিয়ে হলেও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে। যখন তিনি বুঝতে পারলেন সব আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মধ্য থেকে বাংলার মানুষের ভাগ্য বদল সম্ভব নয়, তখন তিনি ধীরে ধীরে মানুষকে তৈরি করেন স্বাধীনতার জন্য। এ স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে কল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় চেতনা কাজ করেছে। বিশেষ করে সামরিক সন্ত্রাস, উগ্র মৌলবাদ মুক্ত সাম্যের স্বদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য।

গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। যা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। সংবিধান প্রণয়নের আগে ১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয়দফা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্র সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভ সম্পর্কে বিশদ বলেন- আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, ‘এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।… কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সেখানে গণতন্ত্র নেই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করব। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।…. বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে যাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সা¤প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’

যে সাধারণ মানুষ তাঁকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সীমায় স্থান করে দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছে, যে মানুষের কাছে তাঁর রাজনৈতিক হাতেখড়ি, সেই মানুষের ভাগ্যবদল করাটা ছিল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। রাজনৈতিক কর্মবিচরণে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দ্বারে গিয়ে যে ভালোবাসা, আন্তরিকতা পেয়েছেন রাষ্ট্র শাসনে এসে তিনি তা ভুলতে পারেননি। গরিবের দোয়ার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়, সে বিশ্বাস থেকে তিনি প্রতিজ্ঞ ছিলেন ‘মানুষরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না’। এ কারণে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্ট না হয়েও সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিলেন অবিচল। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যাদের নীচু বলে অবহেলা করা হয়, তারাই একজন রাজনৈতিক নেতার মূল শক্তি। এ শক্তিকে নেতৃত্বগুণে মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসাটাই ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য। সাধারণ জনগণ তার প্রতি কতটা আস্থা রাখতেন সে বিষয়ের অবতারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ‘জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসেবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।

এই শোষণহীন সমাজ, জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করতে গিয়ে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু দেখলেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে অভ্যস্ত আমলাতন্ত্রে কোনো ধরনের পরিবর্তন হয়নি। সমাজের উচ্চবিত্তের মাঝে শোষণ ও লুণ্ঠন চেতনা ছিল তারও কোনো ছেদ ধরেনি। তাই তিনি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার প্রাণান্তর চেষ্টা করেছেন। উচ্চবিত্তের শোষণবৃত্তির রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই উদাহরণ সৃষ্টির জন্য রাজনীতি থেকে ধর্মচর্চা দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। যদিও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তিনি ছিলেন অটুট। তিনি প্রায় বলতেন আমি একজন বাঙালি, আমি একজন মুসলিম। মুসলমান একবার মাত্র জন্ম নেয় এবং একবারই মরে। এই বিশ্বাস ও জনাস্থার প্রতি অবিচল থেকে ঘুণেধরা সমাজ-রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি বারবার হোঁচট খেয়েছেন ঘরে-বাইরের দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে।

সদা সত্য সম্ভাষণী বঙ্গবন্ধুর সরল উক্তি ছিল- ‘আমি ভিক্ষা করে বিশ্ব থেকে আনি গরিব মানুষের জন্য, কিন্তু চাটার দল সব খেয়ে ফেলছে। কেন্দ্র থেকে আমি যা বরাদ্দ দিই প্রান্তিক পর্যায়ে তা পৌঁছতে পৌঁছতে অধিকাংশই নাই হয়ে যায়।’ এই ঘুণে ধরা সমাজ পরিবর্তনের তাগাদা থেকে তিনি বারবার বলেছেন- ‘আমি অন্যায়ের কাছে মাথানত করিনি, করব না।’ যাদের রক্তে ঘামে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতনভাতা হয়, তাদের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য তিনি বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। দুর্নীতি, অনিয়মের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সদা কঠোর। কারা দুর্নীতি করতেন, সেটি তিনি ভালোভাবে জানতেন। তাই তাঁর সরল উক্তি ছিল- ‘আমার কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে প্যান্ট, টাই, শ্যুট পরা সমাজের ভদ্র মানুষগুলো।’ এ কারণে বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্য নায়কদের জানা ছিল রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচিয়ে রেখে সামরিক-বেসামরিক সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপশাসন, মৌলবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। যার নির্মম পরিণতি পনের আগস্ট।

কিন্তু ঘাতকের দল এটা বুঝতে পারেনি যে, জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে। যে বঙ্গবন্ধু জনতার হৃদয় আসনে বসেছেন, সেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাকে তারা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধাঁচে ফিরে নিতে পারবে না। যদিও ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ঘাতকের দল এক্ষেত্রে কিছুটা সফল হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বাতাবরণে মিথ্যা কখনো সত্যে পরিণত হয় না। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণে গড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতার চারদশক পরে সঠিক গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে তার যোগ্য উত্তরসূরির হাত ধরে। বঙ্গবন্ধু বরাবরই সব মানুষের কথা ভাবতেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটেখাওয়া মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। যেটি আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার মাঝেও দেখতে পাই।

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। এই শব্দগুলো বাংলাদেশকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম-উত্তর এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। এগুলো চেতনা, অনুপ্রেরণার, অগ্রসরের প্রতীক। এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা আত্মকেন্দ্রিকতার চর্চা বাংলাদেশকে পথভ্রষ্ট করবে। সুবিধা লুফে নেবে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, পনের আগস্টের ঘাতকের দল। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে যারা হৃদয়ে ধারণ করেন এ শব্দগুলো চর্চায় তাদের অধিকতর আন্তরিক হতে হবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী কোনো বস্তু নয়। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশ মডেল অপরিবর্তনীয়।

আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করি, বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখি তাদের আত্মত্যাগের মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। যে জনগণের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, সেই জনগণের মুক্তি না এলে চেতনার ক্ষণচর্চা প্রহসনে রূপ নেবে। তাই আত্মকেন্দ্রিকতার দায়বোধ ডিঙিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণের জন্য দুর্নীতি, অনিয়ম, দায়হীনতা, উগ্র মতাদর্শ পরিহার করে সমৃদ্ধির সোপানে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার নিতে হবে। যে অঙ্গীকার হবে একটি পরিবর্তনের মডেল। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, দেশপ্রেম থাকবে অগাধ। ১৬ কোটি মানুষের মুক্তির প্রকৃত আস্বাদনে আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হোক। হীনতার গøানি দূর করে মুক্তির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পনের আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করার দৃঢ়তা আমাদের হৃদয় মনকে আলোকিত করুক। এটাই জাতির প্রত্যাশা।

মো. শামসুর রহমান : সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)।

SUMMARY

1730-B9.jpg