রাজিব দেবনাথ
রাজনীতির কবি, গণমানুষের নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি এই উপাধিগুলো শুধুমাত্র যে মানুষটার সঙ্গে যায় তিনি আর কেউ নন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মানুষটার জন্মই যেন হয়েছিল শোষিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেবার জন্য। তাই তো ছোটবেলা থেকেই জড়িত ছিলেন সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামে। পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছরই কাটিয়েছেন জেলহাজতে।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব জন্ম দিলেন এক মহাকাব্যের। সেই দিনের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন আগামীর স্বপ্নের বাংলাদেশের। বজ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন,
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
তাঁর কথামতো লাখো জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ছিনিয়ে আনে লাল-সবুজের পতাকা। জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের নতুন এক রাষ্ট্রের।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। হাত দেন যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত দেশকে পুনঃনির্মাণের কাজে। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একদিকে চলতে থাকে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের প্রচেষ্টা, অপরদিকে বহিঃবিশ্বে সমর্থন অর্জন। চীনের মতো শক্তিশালী দেশের বিরোধিতার পরেও জাতির পিতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ লাভ করে জাতিসংঘের সদস্যপদ। ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণ মুক্ত সমাজ গড়বো। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। এই দিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে রচিত হয় বাঙালি জাতির সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ের। একদল রক্তপিপাসু সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন জাতির পিতা। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ করে স্বাধীনতা বিরোধীরা।
১৫ আগস্টের পর থেকে একটা সময় ছিল যখন এ দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেওয়া অসম্ভব ছিল। অত্যন্ত সুকৌশলে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে চেষ্টা চালানো হয় যেন এ দেশের ইতিহাস থেকে শেখ মুজিবের নাম মুছে যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পায় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পরিবর্তন হয় অবস্থার।
বর্তমানে অনেক তরুণই মনে-প্রাণে লালন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ। ঐ সকল তরুণ দিন-রাত কাজ করে চলেছে জাতির পিতার সোনার বাংলা নির্মাণে। দেশের কল্যাণে তারা সর্বোচ্চ ছাড়টুকু দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো অনেকেই জাতির পিতাকে ব্যবহার করছে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে। এরা সত্যিকার মুজিব আদর্শে অনুপ্রাণিত নয়। ঘাপটি মেরে আছে আওয়ামী লীগে, ক্ষমতার রদবদলে আবার খোলস পাল্টাবে। পাড়ার মোড়ে যখন কোনো চিহ্নিত খুনি বা ধর্ষক নিজের ছবির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে পোস্টার লাগায় জাতি হিসেবে তা সত্যিই আমাদের জন্য লজ্জাকর।
আরেকটি উদ্বেগের জায়গা হলো অধিকাংশ তরুণই ভাবে বঙ্গবন্ধু হলো আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নিজস্ব সম্পত্তি। তাই একদল তাঁকে জানতে চায় না, আরেক দল জানতে দিতে চায় না, আটকে রাখে নিজেদের গণ্ডিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো হলো গণমানুষের নেতা, সার্বজনীন, সবার চর্চার বিষয়। মূলত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, আর শেখ মুজিব এই শব্দ তিনটিই সমার্থক। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাঁচলেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাঁচবে। আর বাঁচিয়ে রাখবার এই দায়িত্বটুকু নিতে হবে বর্তমান তরুণ সমাজকেই।